কাজী গুলশান আরাঃ
যে শিক্ষা বোধসম্পন্ন মানুষের জ্ঞানের বিকাশ ঘটায় এবং যার মাধ্যমে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং নৈতিক মূল্যবোধ প্রসার লাভ করে সেটাই মানসম্মত শিক্ষা।

অন্যভাবে বলা যায় একটি নির্দিষ্ট মানদণ্ডের আলোকে যখন কোন শিক্ষাকে বিচার করা হয়, সেটা হয় মানসম্মত শিক্ষা।

মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সরকার বেশ কিছু কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।এই কর্মসূচী গুলো হলোঃপাঠ্যবই ও শিক্ষা সামগ্রীর মান বাড়ানো ও যথাসময়ে বন্টন,শিক্ষকদের সক্ষমতা বাড়ানো, নতুন স্কুল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা,পুরোনো প্রতিষ্ঠান গুলো কে ঢেলে সাজানো এবং সঠিক ব্যবস্হাপনা।মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ সম্পর্কে এখানে আলোকপাত করা হলো।

মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি সৃষ্টি করা হয়েছে। ২০১০ সালে ৫-৬বছরের শিশুদের জন্য ৩৭ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক বছর মেয়াদি অবৈতনিক প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হয়েছে। এ পর্যায়ে শিক্ষা পদ্ধতিকে মানসম্পন্ন করার লক্ষ্যে সরকার ২০১১ সালে জাতীয় প্রাক- প্রাথমিক শিক্ষাক্রম প্রনয়ন করে।জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এন সি টি বি)এই শিক্ষাক্রমের ভিত্তিতে শিক্ষা সামগ্রী প্রস্তুত করে।এরপর জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর মিলে এনজিও এবং অন্যান্য সহযোগীদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য একটি প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল প্রস্তুত করে।প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের জন্য প্রত্যেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি করে মোট ৩৭ হাজার ৬৭২ টি সরকারি শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করে নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়।ইতোমধ্যে ৩৫ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ বিগত কয়েক বছর প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় বেশ অগ্রগতি লাভ করেছে। বর্তমানে প্রাক-প্রাথমিকে ভর্তির হার ২০১০ সালের তুলনায় তিন গুণ বেড়েছে। ২০১২ সালে শতকরা ৫০ ভাগ প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীর প্রাক-প্রাথমিক
শিক্ষার অভিজ্ঞতা ছিল। ২০১৫ সালে এই হার দাঁড়িয়েছে শতকরা ৯৬.১ ভাগ।বতর্মানে এই হার প্রায় শতভাগ। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার ভবিষ্যৎ লক্ষ্য হলো প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানকারী সকল বিদ্যালয়ে একটি নির্দিষ্ট মান বজায় রাখা এবং মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে আরো একধাপ এগিয়ে যাওয়া।

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এখন সংস্কৃতি আর্থ-সামাজিক অবস্থান থেকে উঠে আসা ও নানা রকম শারিরীক প্রতিবন্ধকতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে সক্ষম শিশুদের চাহিদার প্রতি বিশেষ ভাবে মনোযোগী।শারীরিক প্রতিবন্ধি শিশুরা এখন মূলধারার স্কুলে ভর্তি হতে ও শিক্ষা লাভ করতে পারছে। দরিদ্র প্রবণ এলাকার ও দরিদ্র পরিবারের শিশুসহ সকল শিশুদের জন্য পরিচালিত হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা উপবৃত্তি কর্মসূচী ও রিচিং -আউট -অব-চিলড্রেন প্রকল্প(রস্ক)।এখন প্রথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা ২কোটির ও বেশি শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পেয়ে থাকে। বৃত্তির টাকা সরাসরি মায়েদের মোবাইল ফোনে জমা হয়।এসময় বিভিন্ন স্তরে ৮০ হাজার প্রতিবন্ধি শিশুকে উপবৃত্তি প্রদান করা হয়। এছাড়া সমাজে সুবিধা বঞ্চিত গোষ্ঠী যেমন বেদে ও হরিজনদের সন্তানরা লেখাপড়া চালিয়ে নিতে মাসিক বৃত্তি পেয়ে থাকে।বর্তমানে তিন কোটির বেশি শিক্ষার্থী স্কুল ফিডিং কর্মসূচীর আওতায় খাদ্য সহায়তা পাচ্ছে। এই পদ্ধতি বর্তমানে ১৫০টি উপজেলায় চালু আছে। এরমধ্যে ৮৫টি উপজেলার কার্যক্রম চলছে সরকারি অর্থায়নে।পূর্বে ঝরে পড়া প্রায় ৯৮ হাজার ২১১ জন শিক্ষার্থী ২০১২ সালে রক্স প্রকল্প চালু থাকাকালীন প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। চতুর্থ উন্নয়ন কর্মসূচীর(পিইডিপি-৪) আওতায় বিদ্যালয়ের বাইরে থাকা দশ লক্ষ শিশু শিক্ষা কেন্দ্র প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছে। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করণের লক্ষ্যে সরকার প্রতিনিয়ত পাঠ্যক্রম,সিলেবাস ও পাঠ্যপুস্তকের বিষয়গুলো উন্নত করা,শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং বিদ্যালয়ের পরিবীক্ষণ প্রক্রিয়া উন্নত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষকের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষাবান্ধব অবকাঠামোর পেছনে প্রচুর বিনিয়োগ ও গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। দক্ষতা নির্ভর পাঠ্যক্রমের সাথে সামঞ্জস্য আনার জন্য শিখন-শেখানো পদ্ধতি ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়া ক্রমাগত পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এইসকল প্রচেষ্টার কারনে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া কমেছে। শিক্ষার মান ও শিক্ষা সমাপনের হার বেড়েছে।

প্রাথমিক স্তরে ভর্তির হার ২০০৫ সালে ৮৭% ছিল। ২০১৭ সালে তা প্রায়১০০% হয়েছে। ২০১৭ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় সাফল্যের হার ৯৫.১৮%,২০১৫ সালে এই হার ছিল ৮২%। ২০১২ সাল প্রাক -প্রাথমিকের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন শিশু প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে ৫০%। ২০১৫ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৯৫%। ২০১৮ সালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের মাঝে ৫৮,২৫৫ টি বই বিতরণ করা হয়েছে।দৃষ্টি প্রতিবন্ধিদের মাঝে ব্রেইল বই বিতরণ করা হয়েছে ২৮,২০০ টি।২০১৭ সালে ৮০,০০০ জন প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পেয়েছে। বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ১৫০০ টি নতুন বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে এবং বিগত ৫ বছরে ২৩,৩৭০ টি শ্রেণিকক্ষ স্হাপন করা হয়েছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপাত্ত অনুযায়ী ২০১৬ সালে প্রাথমিকে গমন উপযোগী শিশুদের ৯৭.৯৪ শতাংশ ভর্তি হয়েছিল।২০২৩ সালে এই হার বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৯৮%।এ থেকে স্পষ্ট যে, এক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য নিরসন ও সম্ভব হয়েছে। কারণ মেয়ে ও ছেলে শিশু উভয়েই প্রায় শতভাগ ভর্তি ছাড়া এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব ছিল না। ২০০৫ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ৪২.২ শতাংশ, ২০১৫ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ২০.৪ শতাংশ। বর্তমানে ২০২৩ সালে এই হার দাঁড়িয়েছে ১৪.১৫ শতাংশ। তবে প্রত্যাশিত মানের শিক্ষা অর্জনের জন্য সার্বিক যে ইতিবাচক পরিবেশ প্রয়োজন তা থেকে বাংলাদেশ এখনো বেশ কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। এর সবথেকে বড়ো কারণ হয়তো-বা আমাদের বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী এবং তাদের জন্য শিক্ষার মান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান বিভিন্ন অন্তরায়।

এ প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন যে, মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে উপযোগ ভিত্তিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে জোরালো সামাজিক ও মানসিক মূল্যবোধে বলীয়ান শিক্ষাও নিশ্চিত করতে হবে। একই স্তরের শিক্ষার্থীদের শেখার ক্ষেত্রে অসমতা, বিভিন্ন ধরনের শিক্ষার মধ্যে ব্যাপক ফারাক,দূর্বল শিখন মূল্যায়ন,শিক্ষকের উন্নয়ন ও জবাবদিহিতা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা, শিক্ষক প্রনোদনার অভাব,ঝরে পড়ার উচ্চ হার,অতি দরিদ্র বা দূর্গম এলাকার শিশু ভর্তি না হওয়া, প্রাথমিক পরবর্তী পর্যায়ে শিক্ষার্থী বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থী হ্রাস,নগর অঞ্চলে দরিদ্র জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং মানসম্মত দক্ষতা প্রশিক্ষণমূলক শিক্ষার অভাব প্রভৃতি কারণসমূহ মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের প্রধান অন্তরায়।

মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছর থেকে ৫ বছরের জন্য চতুর্থ উন্নয়ন কর্মসূচী ( পিইডিপি -৪) বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।এই কর্মসূচীর প্রধান উদ্দেশ্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিখন-শেখানো পদ্ধতির মানোন্নয়ন করা।এই প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষাক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতির উন্নয়ন, একদল সুশিক্ষিত শিক্ষক তৈরি এবং স্কুলের নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম মূল্যায়নে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা হচ্ছে। যেহেতু মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষকের ভূমিকাই মূখ্য, তাই সরকার তাদের সক্ষমতা নিশ্চিত করতে চায়। সে লক্ষ্যে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন এর পাশাপাশি এর ইংরেজি, বাংলা, প্রাথমিক গণিত, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়, প্রাথমিক বিজ্ঞান, সংগীত, চারু ও কারুকলা ও শরীরচর্চার মতো বিষয় গুলো শিখন – শেখানো পদ্ধতি প্রশিক্ষণ চলমান রয়েছে। এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদনে প্রয়োজন পর্যাপ্ত আর্থিক বরাদ্দ। ইউনেস্কোর নীতিমালা অনুযায়ী একটি দেশের শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ মোট জিডিপির ছয় শতাংশ হওয়া উচিত যা মোট বাজেটের ২৫ শতাংশ। সেখানে এ ক্ষেত্রে বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ১.৯ শতাংশ।পরবর্তীতে তা বাড়িয়ে ২.৪ শতাংশ করা হয়।কিন্তু ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে এই বরাদ্দ কমিয়ে জিডিপির মাত্র ১.৭৬ শতাংশের কথা বলা হয়েছে।

যেহেতু দেশে একটি শিক্ষা বান্ধব সরকার কাজ করছে, তাই ধরে নেয়া যায় যে,সামনের বছর গুলোতে এই খাতে অধিক বিনিয়োগ আসবে।মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে শিক্ষা ক্ষেত্রের অভিষ্ঠ লক্ষ্য অর্জন করতে হবে সর্বাগ্রে।তবেই বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যেই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় শিক্ষা সংক্রান্ত সব লক্ষ্য অর্জন করতে সমর্থ হবে।

লেখকঃ কাজী গুলশান আরা
প্রধান শিক্ষক।

Spread the love