Spread the love

এম.মনছুর আলম, চকরিয়াঃ

দুইদিন পূর্বেও ছিল বৃদ্ধ আনোয়ার হোছাইন বাড়িতে নাতি-নাতনি ও ছেলে-মেয়েদের হই হুললুড। হঠাৎ অনাকাংখিত দুর্ঘটনায় তার পরিবারে নেমে এলো হরিষে বিষাদ। ঘোর অমানিশার অন্ধকার। একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় মুহূর্তেই তার সুখের পরিবার হয়ে গেল তছনছ। যে দুর্ঘটনা ঘটেছে যা চোখে না দেখলে কারো বিশ্বাস হবে না। সত্যিই বিধাতার কি নিয়তি! পৃথিবীর বুকে আকস্মিক ভাবে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা মানুষের হৃদয়কে খুবই নাড়া দেয়। কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বিএমচর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ বহদ্দারকাটা গ্রামের মৃত মনিরুজ্জামান ছেলে আনোয়ার হোছাইন (৭০) সহ তার দুই আদরের ছেলে একটি দুর্ঘটনায় নিহত হয়। গত বুধবার রাতে তার নিজ বাড়ির সেপটি ট্যাংক পরিস্কার করতে নেমে বাবা-ছেলেসহ এ ঘটনার শিকার হন।
বৃদ্ধ আনোয়ার হোসেনের শেষ ইচ্ছে ছিল একযুগ ধরে প্রবাসে কাটানো পঞ্চম ছেলে রমিজ উদ্দিনকে দেশে ফিরে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে নববধুকে দেখে যাওয়ার। কিন্তু ভাগ্যের কি নিয়তি, মর্মান্তিক একটি দুর্ঘটনায় তার শেষ ইচ্ছাটা দেখে যাওযা হলো না। সুখি একটি পরিবারের মাঝে হঠাৎ এমন এক হৃদয়স্পর্শী ও করুণ ঘটনা সৃষ্টি হয়েছে যা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে।
বৃদ্ধ আনোয়ার হোছাইন সংসার জীবনে ৬ ছেলে ও ৪ মেয়ে সন্তানের বাবা ছিলেন। তার মধ্যে তৃতীয় সন্তান শেকাব উদ্দিন কয়েক বছর পূর্বে মারা যান। অবশিষ্ট ৫ সন্তানের মাঝে দুই ছেলে দেলোয়ার হোছাইন ও রমিজ উদ্দিন দুবাই প্রবাসী।
বড় ছেলে শাহাদাত হোছাইন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, মেজো ছেলে ক্বারী মৌলভী মনজুর আলম চট্টগ্রাম শুলকবহর এলাকায় মাদ্রাসায় শিক্ষাকতা করেন। ওই পরিবারের ছোট ছেলে মৌলানা শহিদুল ইসলাম একজন মাদ্রাসার ছাত্র।
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট চকরিয়ার ইতিহাসে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার পানি ভাটির দিকে নেমে যাওযার সময় বুধবার রাতে বৃদ্ধ আনোয়ার হোসেনের বাড়ির সেপটিক ট্যাংকের ময়লার পানি পরিস্কার করতে নেমে ট্যাংকে আটকে পড়ে অনাকাংখিত দুর্ঘটনার শিকার হন বাবা-ছেলেসহ তিনজন।
ঘটনার দিন রাতে এশার নামাজের পরে বাড়িতে ফেরেন বৃদ্ধ আনোয়ার হোসেন। ওইদিন নিজ বাড়ির সেপটি ট্যাংক পরিষ্কার করতে নামে পরিবারের ছোট ছেলে শহিদুল ইসলাম। সে সেপটি ট্যাংকের ঢাকনা খুলে ভেতরে গেলে উঠে না আসায় তার বড় ভাই শাহাদাত হোছাইন ছোট ভাই শহিদুল ইসলামকে দেখতে গিয়ে তাকে না দেখে সেও ট্যাংকে ডুকে পড়ে। দুই ছেলেকে দেখতে না পেয়ে বৃদ্ধ বাবা আনোয়ার হোসেনও ট্যাংকে উঁকি দিয়ে দুই ছেলেকে না দেখে সেও ভেতরে ডুকে পড়েন। এসময় চিৎকার করলেও বাড়ির কোন লোকজন তাদের কোন আওয়াজ শুনতে পায়নি। স্বামী ও ২ ছেলেকে দেখতে না পেয়ে বৃদ্ধা মনোয়ারা বেগমের শৌরচিৎকার করলে স্থানীয় এলাকাবাসী এগিয়ে আসলে তাদের সহায়তায় সেপটি ট্যাংকি থেকে একের পর এক পিতা-পুত্র তিনজনকে উদ্ধার করে চকরিয়া সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক ২ ছেলেকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে মৃত ঘোষনা করেন।
বৃদ্ধ আনোয়ার হোসেন (৭০) অবস্থা আশঙ্কাজনক হলে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (চমেক) প্রেরণ করেন। রাত আড়াইটার দিকে চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃদ্ধ আনোয়ার হোছাইন মূত্যু ঘটে। হঠাৎ করে এলাকায় হৃদয়বিদারক মর্মান্তিক এ ঘটনাটি ছড়িয়ে পড়লে পুরো এলাকাজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে।
চোখের সামনে একে পর এক নাড়িছেড়া দুই ছেলে ও স্বামীর সারিবদ্ধ লাশের ছবি বৃদ্ধা মনোয়ারা বেগমের চোখে এখনো ভাসছে। তার মনে জমে আছে পাহাড়সম শোকের মেঘ। স্বামী-সন্তান হারিয়ে কোন কথা তার মুখদিয়ে বেরোনোর আগেই বার বার কান্নায় ভেঙে পড়ে মূর্চা যাচ্ছেন।
কারো সাথে কোন কথা বলছেনা। বাড়ির সিড়িতে বসে নীরব চোখে অপলক দৃষ্টিতে বাহিরে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে। সে ভাবছে হয়তো তার স্বামী-ছেলেরা এখনো বেঁচে আছে। বাড়ির আশপাশের লোকজন ও আত্মীয় স্বজন তাকে শান্তনা জানাতে আসলে সে দু’চোখে তাকিয়ে থাকেন।

নিহতের পরিবারের বড় ছেলে শাহাদাত হোছাইন আর্থিক ভাবে খুবই দূর্বল। তার ৪ ছেলে ও এক মেয়ে। বড় দুই ছেলে পরিবারের স্বচ্ছলতা ফেরানোর জন্য রাজমিস্ত্রীর সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। অপর তিন ছেলে-মেয়ের স্থানীয় মাদ্রাসা ও স্কুল পড়ে। তারা বয়সে খুবই ছোট। তাদের এখনো বুঝে উঠার সক্ষম হয়নি তাদের বাবা পৃথিবীতে আর বেঁচে নেই। শাহাদত হোছাইনের স্ত্রী জোসনা বেগম অকালে স্বামী হারিয়ে তার ছোট ছোট ৫ ছেলে-মেয়ে নিয়ে সামনের দিন কি ভাবে অতিবাহিত করবে সে চিন্তায় শোকে স্তব্ধ। তার সাথে কথা বলতে চাইলে সে মুখদিয়ে কথা বলার সাহসও পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে।

দুর্ঘটনায় নিহত বাবা ও দুই ভাইকে সুদূর প্রবাস থেকে দেখতে এবং দাফন করতে আসা প্রবাসী দেলোয়ার হোছাইন ও রমিজ উদ্দিন জানিয়েছেন, তিলে তিলে করা বহুকষ্টে গড়ে তোলা তাদের বাবা’র সাজানো পরিবার ও স্বপ্ন একটি ঘটনায় বিষাদে পরিণত করেছে। কখনো ভাবতে পারিনি বাবা’র সুখের দিনে বাবা ও দুইভাইকে এতো তাড়াতাড়ি তাদের কাছ থেকে হারাতে হবে। বাবা ও দুই ভাইকে হারিয়ে পরিবারের বড় ধরণের ক্ষতি হয়েছে। কখন আমরা এই শোক কাটিয়ে উঠতে পারবো জানি না। পরিবারের জন্য সকলের দোয়া চাই।
হৃদয়বিদারক এ ঘটনায় শোকাহত পরিবারকে সমবেদনা ও শান্তনা জানাতে বড় ধরণের কোন জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা দেখা যায়নি। তবে বাবা ও দুই ছেলে নিহতের শোকাহত পরিবারকে সমবেদনা এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শনে ছুটে যান চকরিয়া সার্কেলের (এএসপি) কক্সবাজার সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপার রকিব উর রাজা, মাতামুহুরী পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের (পুলিশ পরিদর্শক) মো.মিজানুর রহমান, বর্তমান বিএমচর ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম, সাবেক চেয়ারম্যান বদিউল আলম ছাড়া কোন রাজনৈতিক সিনিয়র নেতৃবৃন্দ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দেখা মেলেনি। এনিয়ে পরিবারের সদস্যরা চরম হতাশ।


Spread the love