ক্যাপশন : লামা পৌরসভা এলাকায় নির্মাণাধিন সেচ ড্রেন কাজের একাংশ। -লামা প্রতিনিধি।
মো. নুরুল করিম আরমান, লামা প্রতিনিধি:
সেচ সুবিধা না থাকায় বান্দরবান জেলার লামা উপজেলায় বর্ষা মৌসুম ব্যতিত বাকি সময়গুলোতে শুধু পানির অভাবে অনাবাদি পড়ে থাকত শতশত একর উর্বর পাহাড়ি জমি। কৃষি ক্ষেত্রকে গুরুত্ব দিয়ে বান্দরবানের লামা উপজেলায় সেচ ড্রেন নির্মান ও পাম্প স্থাপন প্রকল্প গ্রহণ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। এ ধারাবাহিকতায় উপজেলার একটি পৌরসভা ও ৫টি ইউনিয়নে ১৭হাজার ৯শত মিটার সেচ ড্রেন নির্মান ও পাম্প মেশিন স্থাপন প্রকল্পে মোট ব্যয় হচ্ছে ১২কোটি ১৮লাখ টাকা। আগামী ২০২৩ সালের জুন মাসের নির্ধারিত সময়ে কাজ সম্পন্ন হলে উপজেলার ১৩শত একর পাহাড়ি জমি চাষাবাদের আওতায় আসবে। এতে কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হবে। পাল্টে যাবে পার্বত্য কৃষি চিত্র। সূচিত হবে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি’র একান্ত প্রচেষ্টায় কাজটি বাস্তবায়ন হচ্ছে বলে জানান প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, পাহাড়ের অধিকাংশ মানুষ কৃষিনির্ভর। প্রচুর উর্বর জমিও রয়েছে। কিন্তু সেচ সুবিধা না থাকায় বর্ষা মৌসুম ব্যতিত বাকি সময়গুলোতে শুধু পানির অভাবে অনাবাদি পড়ে থাকত শতশত একর উর্বর পাহাড়ি জমি। বিষয়টি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি’র নজরে আসলে সেচ ড্রেন ও পাম্প স্থাপনের গুরুত্¦ারোপ করে জমি চাষের আওতায় আনতে সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড সেচ ড্রেন নির্মাণ কাজে গুরুত্বারোপ করে সেচ ড্রেন নির্মান প্রকল্প গ্রহণ করে। এ প্রকল্পের কাজ শেষে অনাবাদী জমিতে প্রচুর পরিমাণে সবজি, ধান, ভুট্টা, কলা, পেঁপে, লেবু, পেয়ারা, আনারসসহ বিভিন্ন ফল ফসল উৎপাদন করা যাবে। এতদিন সেচ সুবিধা না থাকায় শুষ্ক মৌসুমেও বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করা য়ায়নি ওইসব জমিতে।
গৃহীত প্রকল্পের মধ্যে লামা সদর ইউনিয়নে ওয়ার্ডের নেওয়াজ বাড়ী মন্টু বসাকের ঝিরিতে বাঁধ দিয়ে নিচের জমিতে ৭০লাখ টাকা ব্যয়ে ১ হাজার মিটার সেচ ড্রেন নির্মান ও পাম্প মেশিন স্থাপন, গজালিয়া ইউনিয়নের বাইশপাড়ি এলাকায় ৭০লাখ টাকা ব্যয়ে চাষাবাদের জন্য ১হাজার মিটার সেচ ড্রেন, সেচ পাম্প ও ড্যাম নির্মান, সদর ইউনিয়নের মেরাখোলা মগেশ্বরী মন্দিরের সামনে হতে মুসলিম পাড়া পর্যন্ত ৯৮লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে ১হাজার ৫শত মিটার সেচ ড্রেন ও পাম্প মেশিন স্থাপন, রূপসীপাড়া ইউনিয়নের দরদরী বড়ুয়াপাড়া বিমলের বাড়ী হতে বিকাশ বড়ুয়ার বাড়ী পর্যন্ত ১কোটি ৩০লাখ টাকা ব্যয়ে ২হাজার মিটার সেচ ড্রেন ও পাম্প মেশিন স্থাপন, রূপসীপাড়া ইউনিয়নের শিলেরতুয়া নয়া মার্মা পাড়া হতে শিলের তুয়া বাজার পর্যন্ত ১কোটি ৩০লাখ টাকা ব্যয়ে ২হাজার মিটার সেচ ড্রেন নির্মান ও পাম্প মেশিন স্থাপন, রূপসীপাড়া ইউনিয়নের মাষ্টারপাড়া আলী আক্কাসের বাড়ী হতে হাফেজপাড়া মসজিদ পর্যন্ত ১কোটি ৩০লাখ টাকা ব্যয়ে ২ হাজার মিটার সেচ ড্রেন নির্মান ও পাম্প মেশিন স্থাপন, রূপসীপাড়া ইউনিয়নের রাঙ্গাঝিরি হাজি নুরুল কবিরের বাড়ি হতে রাঙ্গাঝিরি ও বটগাছ তলা পর্যন্ত ৭০লাখ টাকা ব্যয়ে ১ হাজার মিটার সেচ ড্রেন ও পাম্প স্থাপন, পৌরসভা এলাকার সাবেক বিলছড়ি শাহজাহানের বাড়ি হতে আনিচ মিয়ার বাড়ি পর্যন্ত ১কোটি ১০লাখ টাকা ব্যয়ে ১হাজার ৫শত মিটার সেচ ড্রেন ও পাম্প মেশিন স্থাপন, কলিঙ্গাবিল মাষ্টার খলিফার বাড়ি হতে লামা মুখ পর্যন্ত ৫০লাখ টাকা ব্যয়ে ১হাজার মিটার সেচ ড্রেন নির্মান ও পাম্প স্থাপন, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ছৈয়দ ও মুসলিমের জমি হতে আবুল কাশেমের জমি হয়ে তাজুল ইসলামের জমি পর্যন্ত ৯০লাখ টাকা ব্যয়ে ১হাজার ২শত মিটার সেচ ড্রেন ও পাম্প স্থাপন, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের বনফুর জোড়া ব্রীজ হতে রাজা পাড়া পর্যন্ত ১কোটি ১০লাখ টাকা ব্যয়ে ১হাজার ৫শত মিটার সেচ ড্রেন ও পাম্প স্থাপন। এর মধ্যে ১১টি প্রকল্পের কাজ প্রায় ৬০শতাংশ থেকে ৭০শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন পার্বত্য চট্রগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের বান্দরবান কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী ত্রিদীপ চাকমা। তিনি আরো জানান, বাকী দুইটি প্রকল্পের কাজ শিগ্রই শুরু হবে। প্রকল্প দুইটি হলো- ফাইতং হেডম্যান পাড়া হতে বড়মুসলিম পাড়া পর্যন্ত ৭০লাখ টাকা ব্যয়ে ১হাজার মিটার সেচ ড্রেন ও পাম্প স্থাপন ও ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের বাঁশখাইল্যা ঝিরি মুসলিমপাড়া হতে ইয়াংছা বড় পাড়া পর্যন্ত ৯০লাখ টাকা ব্যয়ে ১২শত মিটার সেচ ড্রেন ও পাম্প স্থাপন নির্মান কাজ।
এ বিষয়ে পার্ত্য চট্রগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের বান্দরবানের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্ ুবিন মো. ইয়াছির আরাফাত বলেন, বর্ষা মৌসুম ব্যতিত বাকি সময় গুলোতে শুধু পানির অভাবে প্রচুর জমি পতিত থাকত। এসব জমি চাষের আওতায় আনার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য মন্ত্রীর নির্দেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক সেচ ড্রেন নির্মাণ কাজে গুরুত্বারোপ করা হয়। এসব সেচ ড্রেন নির্মাণের ফলে কৃষি সেক্টরে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হবে। পাল্টে যাবে পার্বত্য কৃষি চিত্র। সূচিত হবে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের তত্বাবধানে এসব সেচ ড্রেন নির্মাণ হচ্ছে। উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলীদের সার্বিক মনিটরিং এ সব কাজ চলছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে রুপসীপাড়া ইউনিয়নের ইব্রাহীম লিড়ার পাড়ার স্কীম ম্যানেজার মাহবুবুর রহমান জানান, আমাদের এলাকায় প্রায় ১শ একর সমতল জমির মালিক প্রান্তিক কৃষক। জমিগুলো সেচের আওতায় আসায় এসব কৃষকদের দৈন্যতা দূর হবে। সেচ ড্রেনের কাজ শতভাগ হয়েছে। আমাদের দেখা মতো কাজে কোন অনিয়ম বা দূর্ণীতি হয়নি। একই কথা জানালেন, কলিঙ্গাবিল স্ক্রীমের ম্যানেজার নাজমুল হাসান সমীর। তিনি বলেন, দৈনিক তিন চার বার কাজ পরিদর্শন করি। তাই হলফ করে বলতে পারি কাজে কোন ধরণের অনিয়ম কিংবা নিম্মমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করার সুযোগ নেই। এ কাজ সম্পন্ন হলে আমার স্কীমের প্রায় ৬০জন কৃষক উপকৃতি হবেন। নিবিড় তদারকির মাধ্যমে সেচ ড্রেন নির্মাণ কাজ চলছে বলে জানায় উন্নয়ন বোর্ডের কার্য সহকারী কৃষান দাশ।
সরজমিনে সেচ ড্রেন নির্মাণ কাজ পরিদর্শনের গেলে লামা পৌরসভার সভার কলিঙ্গাবিল এলাকার মো. হেলাল (৪০), মো. জাফর আলী (৭৪), মো. বেলাল হোসেন (৩২), আবদুল আউয়াল (৪১) সহ অনেকে সেচ ড্রেন কাজের গুণগতমানে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। তারা জানান, সেচ ড্রেন ও পাম্প স্থাপন হলে গ্রামের ৪০-৫০ একর জমি চাষের আওতায় আসবে। এতে প্রায় ৮০-৯০জন কৃষক সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। সেচ ড্রেন নির্মাণের ফলে পাহাড় অনাবাদি বিস্তৃত জমিগুলোতে বছরে তিন ফসলি ধান উৎপন্ন করা সম্ভব হবে। এতে স্থানীয় কৃষকরা উপকৃত হবেন বলেও দাবী করেন তারা।
পার্বত্য জনপদকে কৃষি সমৃদ্ধ করতে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সেচ ড্রেন নির্মাণ প্রকল্পটি যুগান্তকারী উদ্যোগ বলে মন্তব্য করেছেন, রূপসী পাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান চাচিং প্রু মার্মা ও লামা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিন্টু কুমার সেন। তারা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড জনবান্ধব উন্নয়নে রেকর্ড করেছেন। এর জন্য উপজেলার হাজারো কৃষক সুবিধা ভোগ করতে পারবেন।
গত ১৮জানুয়ারী সেচ ড্রেইন নির্মান কাজ পরিদর্শনে আসেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল আলম চৌধুরী। তিনি কাজ পরিদর্শনে এসে কাজের গুণগতমান পরীক্ষা নিরিক্ষা করে দেখেছেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের জানান, সেচ সুবিধার ফলে পাহাড়ে আর বর্ষা নির্ভরতা থাকবে না। উপত্যকার সেচের আওয়ায় আনা জমিতে বছরে দুই থেকে তিন বার আউশ-আমন ধান চাষ করা যাবে।