অধ্যক্ষ এম সোলাইমান কাসেমী
আলা ইন্না আউলিয়া আল্লাহি লা-হাউফুন আলাইহি ওয়ালা-হুম ইয়াহজানুন। (নিশ্চয়ই আল্লাহর আউলিয়াদের কোন ভয়-ভীতি ও সংশয় নেই : সুরা ইউনুস-৬২)। অমানিশার অতল গহ্বরে তলিয়ে যাওয়া মানবগোষ্ঠীকে সত্যের সন্ধান দেওয়ার জন্য এই ভূমন্ডলে যুগে যুগে আগমন ঘটেছে বহু মশাল ধারকের। এঁদের কেউ নবী, কেউ রাসূল, কেউবা অলি, কেউ মুজাদ্দিদ। ‘মানুষকে আপনার প্রভুর পথে আহ্বান করুন হিকমাত তথা প্রজ্ঞা এবং সুন্দরতম নসীহতের মাধ্যমে।’ মহান প্রভুর এই শাশ্বত ঘোষণা কিয়ামত অবধি যেমন বলবৎ থাকবে তেমনি মানুষকে এই পয়গাম পৌঁছে দেওয়ার জন্য যুগে যুগে বিভিন্ন বুজুর্গানে দ্বীনের শুভাগমনও ঘটবে, এটাই নিয়ম। তারই ধারাবাহিকতায় এদেশে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে আসেন হযরত শাহজাজলাল, হযরত শাহ পরান, হযরত খান জাহান আলী, হযরত শাহ মখদুম, হযরত শাহ আমানত, হযরত শাহ আব্দুল মজিদ, হযরত শাহ আব্দুর রশিদ ও হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহ.)-সহ আরো অনেকেই। যাঁদের পদধূলিতে ধন্য আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ।
কক্সবাজার জেলার পেকুয়া থানার উপকুলীয় ইউনিয়ন মগনামার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৩৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন, আলিমে দ্বীন পীরে কামেল আলহাজ্ব শাহসুফি আল্লামা মাহমুুদুর রহমান (রহ.), তাঁর পিতা-মাওলানা ইজ্জত আলী তখনকার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও ধর্মীয় নেতা ছিলেন। তাঁরা ৪ ভাই ৪ বোন। ভাই-বোনদেরে মধ্যে তিনি সবার বড়। তাঁর ৩ ছেলে- শাহসূফী আলহাজ্ব হাফেজ মাওলানা রেজাউল করিম, আ. ম.ম জিয়াউল করিম ও অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আনওয়ারুল করিম। ৪ মেয়ে-ফরিদা ইয়াছমিন, মোরশেদা জাহান সোলতানা, কাউসার জান্নাত ও হুমায়রা জান্নাত। তাঁর পিতা ভারতের দেউবন্দ মাদ্রাসা থেকে লেখাপড়া শেষ করে গ্রামের বাড়ীর পাশে দ্বীনি শিক্ষা ও আধুনিক শিক্ষার প্রসারকল্পে মক্তব, মাদ্রাসা, হেফজখানা ও প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি প্রথমে পিতার প্রতিষ্ঠিত মক্তব ও মাদ্রাসা থেকে পবিত্র কুরআন মজিদ পাঠ শিখে অতি দক্ষতার সাথে মাদ্রাসা থেকে ৪র্থ শ্রেণি সমাপ্ত করে মেধাবী ছাত্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। এরপর ১৯৪৯ সালে দক্ষিণ মগনামা এম.ই. স্কুল হতে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে মেধাবী ছাত্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। পরবর্তীতে দ্বীনি শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে মাদ্রাসায় লেখাপড়া শুরু করেন। ১৯৫৪ সালে পুঁইছড়ি মাদ্রাসা হতে ৮ম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। একই মাদ্রাসা হতে ১৯৫৮ সালে আলিম পরীক্ষায় আবারও কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। পরবর্তীতে ১৯৬০ সালে সাতকানিয়া মাহমুদুল উলুম আলীয়া মাদ্রাসা হতে ফাযিল পাশ করেন। তিনি দ্বীনি শিক্ষার পাশাপাশি আরও জ্ঞান অর্জনের জন্য পেকুয়া জি.এম.সি. উচ্চ বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং উক্ত বিদ্যালয় হতে ১৯৬৩ সালে এস.এস.সি পাশ করেন। তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসাবে ১৯৬৭ সালে এইচ.এস.সি এবং ১৯৭১ বি.এ ও ১৯৯১ সালে কক্সবাজার হাশেমীয়া আলীয়া মাদ্রাসা হতে কামিল পাশ করেন।
কর্মময় জীবনের শুরুতে তিনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পদের জন্য পরীক্ষা দিলে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরই মধ্যে তৎকালীন বদরখালী সমবায় সমিতির ম্যানেজার মাস্টার আলী আহমদ এর বিশেষ অনুরোধে তিনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষদ পদের চাকুরি না করে বদরখালী কলোনীজেশন উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পরের বছর ১৯৬৭ সালে চকরিয়া সহকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পান। তিনি ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত একই স্কুলের ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি ১৯৭৫ সাল থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ ইংরেজি পর্যন্ত দীর্ঘ ২৩ বছর চিরিঙ্গা বাস ষ্টেশন জামে মসজিদের ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। একাধারে শিক্ষকতা এবং মসজিদের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ইমামতি ও মাহফিলের দাওয়াত রক্ষা করতে কোন দ্বিধাবোধ করেন নাই। তিনি তাঁর দীর্ঘ কর্মময় জীবনে ইচ্ছাকৃতভাবে কোন দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকেন-নি।
জানা যায়, তিনি ইসলামের এমন অনুরক্ত ছিলেন যে কখনো তাহাজ্জুদ নামাজ না পড়ে ঘুমাতেন না। তাঁর মধ্যে সবসময় দুটো বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল, এক অল্প আহার দুই স্বল্প বাচন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অত্যন্ত বিনয়ী ও মার্জিত স্বভাবের অধিকারি ছিলেন। তিনি কখনও কারও সমালোচনা করেনি ও কারো মনে আঘাত দেয়নি। তিনি কথা নয় কাজে বিশ্বাসী ছিলেন। বিলাসীতাকে পছন্দ করতেন না। খুবই আতিথেয়তা পরায়ন ছিলেন। ধনসম্পদ পদ-মর্যাদা নয় রেয়াজতই তাঁর নিকট নৈকট্যের মাপকাঠি ছিল। তাঁর নিকট গরীব ও ধনীর কোন পার্থক্য ছিল না, সবাই তাঁর কাছে সমান ছিলেন। তিনি তাঁর সম্পূর্ণ জীবন কুরআন-সুন্নাহের নীতির আলোকে পরিচালিত করেন, এর পরিপন্থি কোন কাজে লিপ্ত ছিলেন এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি। তিনি কোন লোককে বিরোধী কোন কাজে লিপ্ত থাকতে দেখলে সাথে সাথে তার প্রতিবাদ করতেন ঐ লোক যত বড় হোক না কেন। তিনি পীর হিসেবে শরীয়ত ও ত্বরিকতের জ্ঞান দ্বারা পরিপূর্ণ ইলমে শরীয়তের যেমন নিঁখুত শিক্ষা দিয়েছেন তেমনি এলমে ত্বরকিতেরও পরিপূর্ণ শিক্ষা দিয়ে গেছেন। তাঁর আদর্শবাদি জীবন তাঁকে সমাজের সর্বস্তরের লোকের নিকট গ্রহনযোগ্য ও শ্রদ্ধাশীল করে তুলেছিলেন।
প্রথাগত দ্বীনি শিক্ষা শেষ করার পর তাঁর অতৃপ্ত হৃদয় মাবুদের সন্ধানে ব্যাকুল হয়ে পড়ে। তখন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, বাতেনী শিক্ষা ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য হাছিল করা কিছুতেই সম্ভব নয়। তাই বদরখালী মাদ্রাসার শিক্ষক মরহুম রশিদ আহম্মদ (রহ.) -এর প্রেরণায় ১৯৬৯ সালে তৎকালীন দেশের শ্রেষ্ঠ পীর সুলতানুল আউলিয়া মোর্শেদে বরহক্ব গারাংগিয়ার হযরত আলহাজ্ব শাহ আল্লামা আব্দুল মজিদ (রহ.) (বড় হুজুর কেবলা) -এর নিকট গিয়ে তিনি তাঁর দস্ত মোবারকে বায়াত গ্রহণ করেন, এক পর্যায়ে ১৯৭৪ সালে বড় হুজুর কেবলার কথামত খেলাফতের দায়িত্ব পালন করতে লাগলেন তখন ছোট হুজুর কেবলাও তাঁকে ডেকে একে একে সব তরিকতের ৮ (তরিকার) খেলাফত প্রদান করেন। সর্বশেষ তরিকায়ে মোহাম্মদীয়া নামে যে তরীকতের প্রচার করেন তাঁর দায়িত্বও দিয়ে যান। তিনি মৃত্যুর আগমহুর্ত পর্যন্ত মোট আট তরিকতের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে গেছেন। তিনি মনে করেন যে, যুব সমাজই একমাত্র সমাজের পট পাল্টে দিতে পারে। তাই তিনি বাস ষ্টেশন জামে মসজিদের ইমামতির দায়িত্বের পাশাপাশি শাহ মজিদিয়া কমিটি নামে একটি সংগঠন করেন। পরবর্তীতে দেখতে পেল যে আশেপাশের স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসার ছাত্ররা পথহারা হয়ে যাচ্ছে। তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য ‘শাহ মজিদিয়া খানকা শরীফ মগনামা’ ‘শাহ মজিদিয়া খানকা শরীফ চিরিঙ্গা’, ‘শাহ মজিদিয়া মাদ্রাসা চিরিঙ্গা’ ‘মগনামা শাহ রশিদিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা ও মসজিদ’, ‘শাহ রশিদিয়া মাদ্রাসা ও মসজিদ চিরিঙ্গা মৌলভীর চর’, ‘হাজীয়ান এবতেদায়ী মাদ্রাসা’,স্কুল ক্যাম্পাস জামে মসজিদ,‘চিরিঙ্গা ষ্টেশন জামে মসজিদ সম্প্রসারণ’, তিনি এই মসজিদ সংস্কারকল্পে এলাকার যুব সম্প্রদায়কে নিয়ে ‘মসজিদ উন্নয়ন কমিটি’ নামে আর একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ ইমাম সমিতি চকরিয়া থানা সভাপতির দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ ইংরেজি বৃহস্পতিবার সকাল ১০.৩০ মিনিটের সময় ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী, আত্মীয়স্বজন ও বহুগুণগ্রাহী রেখে আল্লাহর সান্নিধ্য চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়ে আল্লাহর ডাকে সাঁড়া দেন। পরের দিন জুমাবার সকাল ১০.৩০ টার সময় চকরিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। জানা যায়, ৮০ হাজারেরও অধিক লোক শরীক হন বলে ধারণা করা হয় এবং ২০১২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তার স্ত্রী দিলরুবা তাহেরা ও ইন্তেকাল করেন। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে পীরে কামেল আলহাজ্ব শাহসুফি আল্লামা মাহমুদুর রহমান (রহ.) -এর বার্ষিক ইছালে সাওয়াব মাহফিলে হাজার হাজার মানুষ অংশ গ্রহণ করে যে ফুয়ুজাত, বারাকাত ও কৃপাদৃষ্টি হাসিল করেন আমরাও তাদের একজন হয়ে এই মহান মোর্শেদে বরহক্ববের কাছে কৃপা দৃষ্টি কামনা করছি। এবছর ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ইংরেজি তাঁর ২৩তম বার্ষিক ইছালে সাওয়াব মাহফিল চকরিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হবে। এতে সকলের প্রতি দাওয়াত জানিয়েছেন শাহ রহমানিয়া ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ। আল্লাহ আমাদের প্রত্যেককে তাঁর খেদমত ও স্মরণকে কবুল করুন, তাঁর রুহানী ফুয়ুজাত ও মেহেরবানী আমাদের সকলকে নসীব করুন। আমিন! “ওয়ামা তাওফীকী ইল্লা বিল্লাহ, ওয়ামা আলাইনা ইল্লাল বালাগ”।
লেখক : অধ্যক্ষ এম সোলাইমান কাসেমী, পিএইচডি গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।