মাহ্ফুজুল হক
মাথার উপর অসীম আকাশ, সীমা-সংখ্যাহীন তারকারাজি, চাঁদ, সুরুজ। দিনের বেলা সূর্যের প্রখর খরতাপ, রাতে চাঁদের মায়াবী আলো। চাঁদহীন রাতের বিভিন্ন প্রহরে অসংখ্য তারকারাজির মিটি মিটি আলোয় সুশোভিত আকাশ। মেঘের আনাগোনা, বজ্রের ভয়ংকর ধ্বনি, বিদ্যুতের চমক, প্রবল বারিপাত, তুষারপাত, শিলাবৃষ্টি, মৃদু-মন্দ বা প্রবল বায়ু প্রবাহ - সব মিলিয়েই তো নভোমন্ডল। বিশাল আকাশ মানুষকে সতত মুগ্ধ করে, আকর্ষণ করে, উৎসুক করে। পাখির উড়ে বেড়ানো, আকাশে ডিগবাজি খাওয়া মানুষকেও উদ্বুদ্ধ করে পাখির মতো, মেঘের মতো আকাশে ভেসে থাকতে, উড়ে বেড়াতে। শুরু হলো মানুষের আকাক্ষাকে বাস্তবে রূপ দেবার প্রচেষ্টা। রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের নিরলস চেষ্টায় মানুষ আকাশে উড়ে চলার উপায় খুঁজে পেলো ১৯০৩ সনে। আবিষ্কৃত হলো বিমান যা পর্যায়ক্রমে আজকের সুপারসনিকের মতো দ্রুতগামী বিমানের দরজা খুলে দিয়েছে। শুধু পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে নয় এর বাইরেও যে বিশাল জগত তাকেও মানুষ জয় করতে চায়। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের পরিধি মাত্র ৪০০ কিলোমিটার। চললো গবেষণা। আবিষ্কৃত হলো টেলিস্কোপ ১৬০৮ সনে। খালি চোখে মানুষ সর্বোচ্চ যে সাত হাজারের অধিক তারা দেখতে পেতো, তার সংখ্যা হাজার গুণ বৃদ্ধি পেলো। মানুষের ঔৎসুক্য গেলো বেড়ে। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের বাইরে যে বিশাল আকাশ তাকে বলা হয় মহাশূণ্য বা মহাবিশ্ব (Space or universe )। বায়ুমন্ডল ভেদ করে মহাবিশ্বে যেতে যে তীব্র গতি সম্পন্ন যন্ত্রের দরকার তা বিমানে নেই। ১৯৫৭ সনে রাশিয়া আবিষ্কার করলো প্রথম রকেট প্রযুক্তি স্পুটনিক। উইরি গ্যাগারিন ১৯৬১ সনে প্রথম বার ওই স্পুটনিকে চড়ে পৃথিবীর অক্ষরেখা (Orbit) বরাবর ভ্রমণ করলেন। বলা হয়, তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি মহাবিশ্ব পরিভ্রমণ করলেন অর্থাৎ প্রথম নভোচারী। এরপর পর্যায়ক্রমে একমাসের ব্যবধানে মহাবিশ্বে পাড়ি জমালেন আমেরিকার এলান শেপার্ড এবং তারপরের বছর জন গ্লেন। পরবর্তীতে মানুষ চাঁদে গেলো, মহাশূণ্যে স্টেশন বানালো, বিভিন্ন গ্রহে স্পেসশিপ পাঠিয়ে খবরাখবর সংগ্রহ করতে থাকলো।
আমরা বলছি, মহাবিশ্ব অসীম, বিশাল। কিন্তু আসলে তা কতো বড় ? মহাবিশ্ব কতগুলো গ্যালাক্সির সমষ্টি তার সংখ্যাও আবার বিলিয়ন বিলিয়ন। এক একটি গ্যালাক্সিতে মিলিয়ন মিলিয়ন নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ, গ্যাস, ডাস্ট ইত্যাদি বিদ্যমান। আমাদের সৌরজগত (Solar system) ছায়াপথ বা মিল্কিওয়ে (Milky way) নামক গ্যালাক্সির একটি সদস্য মাত্র। তার মানে আকাশ বিভিন্ন স্তরে স্তরে সাজানো (The sky is actually layers)। মহান আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, ‘যিনি সাত আসমান স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন। পরম করুণাময়ের সৃষ্টিতে তুমি কোন অসামঞ্জস্য দেখতে পাবে না, তুমি আবার দৃষ্টি ফেরাও, কোন ত্রুটি দেখতে পাও কি ?’ বাস্তবে মহাবিশ্ব কত বড় ? মহাবিশ্বের দূরত্ব মাপার মাধ্যম হলো আলোক বর্ষ (Light year)। প্রতি সেকেন্ডে আলোর গতি ৩ লক্ষ কিলোমিটার। আলো ১০ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয় এক বছরে। বিজ্ঞানীদের ধারনা, মহাবিশ্ব শত শত মিলিয়ন আলোক বর্ষের দূরত্ব পর্যন্ত বিস্তৃত (Outer space extends for hundreds of millions of light years)।
নভোচারী (Astronaut) বলা হয় তাকে যিনি পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের বাইরে ভ্রমণ করেন স্পেসশিপে চড়ে (A person who travels in a space-ship into outer space)। যেমন গ্যাগারিন গিয়েছেন স্পুটনিকে চড়ে, নীল আর্মস্ট্রংরা গিয়েছেন এ্যাপোলো ১১তে চড়ে ইত্যাদি।
মুসলিম রেনেসাঁর কবি গোলাম মোস্তফা বলেন, আমাদের প্রিয় নবীজী মুহাম্মদ সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সল্লাম ছিলেন সর্বপ্রথম নভোচারী। নবীজী বোরাক নামক বাহনে চড়ে রাতের বেলা পবিত্র মসজিদুল হারাম (মক্কা শরীফ) থেকে জেরুজালেম সফর করলেন ৬২০ সনে যখন তাঁর বয়স ৫০ বছর। উইরি গ্যাগারিনেরও ১,৩৪১ বছর আগে। ওই বোরাক নামক স্পেসশিপের গতির ব্যাপারে হাদীস শরীফে বলা হয়েছে, তা কদম রাখতো দৃষ্টিসীমানার শেষ প্রান্তে। অর্থাৎ আলোর গতির চাইতেও দ্রুতগতি সম্পন্ন ছিলো নবীজীর বাহন। দৃষ্টির গতি আলোর গতির চেয়েও দ্রুততর। যেমন, আমরা চোখের পলকে খোলা আকাশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত দেখতে পাই। পবিত্র মসজিদুল আকসা থেকে তিনি ঊর্ধাকাশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। মহান আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, ‘পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে রাত্রে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায়, যার পরিবেশ আমি বরকতময় করেছিলাম, তাঁকে আমার নিদর্শন দেখানোর জন্য, নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’
তিনি বোরাকে চড়ে সপ্তাকাশ পরিভ্রমণ করলেন এবং সপ্তম আকাশের উপর ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ নামক স্থানে পৌঁছালেন, যেখানে ফেরেশ্তা জিবরাইল (আঃ) থেমে গেলেন এবং নবীজী একাকী ‘রফরফ’ নামক অপর বাহনে চড়ে ‘বায়তুল মামুর’ এ উপনীত হলেন। এরপর নবীজী রফরফে চড়ে মহাপ্রভূর দরবারে উপস্থিত হলেন। তিনি সেখানে একটি পর্দার অন্তরাল থেকে মহান আল্লাহ্ তায়ালার সান্নিধ্য লাভ করলেন এবং একান্ত আলাপ চারিতায় লিপ্ত হলেন। আল্লাহ্ তায়ালা তাঁকে সৃষ্টিজগতের বিশেষ রহস্য বুঝিয়ে দিলেন, জান্নাত-জাহান্নাম পরিদর্শন করালেন এবং সবশেষে পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের বিধান নিয়ে আবার ঐশী বাহনে করে মুহূর্তের মধ্যে ধরায় ফিরে এলেন। মে’রাজ শেষে ফেরার পথে নবীজী মসজিদুল আকসায় এসে দেখলেন পূর্ববর্তী প্রায় সকল নবীগন (আঃ) সেখানে একত্রিত হয়েছেন এবং তাঁর আগমনের প্রতীক্ষায় ছিলেন। তিনি সকলকে সাথে নিয়ে সেখানে তাঁর ইমামতিতে দু’রাকায়াত নামাজ আদায় করলেন। যেহেতু বছর খানেক পর পবিত্র মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে তিনি তথায় এক ইসলামি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছেন, সুতরাং সেই নব, বৃহৎ ও আদর্শিক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকা পালনার্থে তাঁর গৃহিত পদক্ষেপ যাতে কোনভাবে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, নিঃসংশয় ও স্থির চিত্তে তিনি যাতে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারেন সে লক্ষ্যে বিষয়ের শ্রুত জ্ঞান নয় বরং প্রত্যক্ষ ও স্বচক্ষে দেখা জ্ঞান অর্জনের নিমিত্ত এই রাত্রিকালীন ঊর্ধ্বাকাশ ভ্রমণ অনুষ্ঠিত হয়। বই পড়ে, কারো কাছে শুনে বা অন্য কোন উপায়ে একটি বিষয় সম্বন্ধে যতই জ্ঞান অর্জন করা হোক না কেন, বাস্তবে তথায় গিয়ে সরেজমিন দেখে জ্ঞান অর্জন করার মাঝে বিস্তর ফারাক। তাই তো বলা হয়, প্রত্যক্ষ ও বাস্তব জ্ঞানের কোন বিকল্প নেই। মহা শক্তিধর এক প্রভূ আছেন যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, পরিচালন ও নিয়ন্ত্রণ করছেন - এইসব শোনা কথা যখন সরাসরি কেউ স্বচক্ষে দেখেন তখন নিশ্চয় তাঁর বক্তব্যের স্টাইল আতœবিশ্বাস সঞ্ছাত, এর ভিত্তি অনড় এবং বিশ্বাস অবিচল হতে বাধ্য। মহাপ্রভূর জ্ঞানের কিয়দংশ, তাঁর অপরিসীম নিদর্শনের কিছু প্রাসঙ্গিক অংশ তাঁর অতি প্রিয় বন্ধুকে তিনি দেখালেন তাঁর কাছে ডেকে নিয়ে। মহাপ্রভূর আতিথেয়তা, ঔদার্য আর শক্তির মদমত্ততা দেখে বন্ধু অভিভূত হলেন, বাধিত হলেন, অভূতপূর্ব জ্ঞানের অধিকারি হলেন। প্রকৃতই মহাজগতে এই জাতীয় ঘটনার আর একটিরও বর্ণনা ইতোপূর্বে কেউ শুনেননি। একমাত্র এবং অনন্য এই নৈশ ও নভোভ্রমণ আর মহাপ্রভূর পক্ষ থেকে অনন্যসাধারণ আয়োজন।
বিষয়টি অসাধারণ হলেও অবাস্তব বা কল্পনাপ্রসূত নয় বরং একেবারেই বিজ্ঞানভিত্তিক। মহাপ্রভূ স্বয়ং বিজ্ঞানময় আর তাঁর কর্মকান্ডও যুক্তিগ্রাহ্য, বিবেক বুদ্ধি সঞ্ছাত। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেছেন, বিজ্ঞান তখনই পরিপূর্ণতা পায় যখন তা কোরআনের বক্তব্যের সাথে মিলে যায়। আমরা ছোটবেলায় ইউনিভার্সাল ট্রুথ হিসাবে পড়েছি, The Sun is stationary পবিত্র কোরআন বলে যে, সবকিছু সন্তরণশীল। ‘আর তিনিই রাত ও দিন এবং সূর্য ও চাঁদ সৃষ্টি করেছেন ; সবাই নিজ নিজ কক্ষপথে বিচরণ করে।’ বড় হয়ে দেখি পাঠ্য বইতে আগের কথাটি আর নেই। এখন বিজ্ঞানীরাও আর সূর্যকে স্থির বলছেন না। কবি গোলাম মোস্তফা বলেন, Space traveling ধারণা প্রথম আল কোরআনই দেয়। হযরত মুহাম্মদ (সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সল্লাম) ছিলেন আধুনিক যুগের প্রথম নভোযাত্রী।’ ‘বিবরণে প্রকাশ, হযরত যখন বোরাকে চড়িয়া রওয়ানা হন, তখন তাঁহার অজু করিবার স্থান হইতে অজুর পানি যেইরূপভাবে গড়াইয়া যাইতে দেখিয়াছিলেন ফিরিয়া আসিয়া ঠিক সেইরূপভাবেই গড়াইয়া যাইতে দেখিলেন। নিমেষের মধ্যে কি করিয়া এতবড় কান্ড ঘটিল? সন্দেহবাদীদের প্রশ্ন। বিজ্ঞানই তো বলে, সময়ের স্থিরতা কিছুই নাই, ইহা আমাদের একটা মনের খেয়াল মাত্র। যে হিসাবে আমরা কোন ঘটনাকে নির্ণয় করি, প্রকৃতি সেই হিসাবের ধার ধারে না। আল্লাহ্র ঘড়ির সাথে আমাদের ঘড়ি মিলে না। অন্য গ্রহে আমাদের ঘড়ি অচল। বৈজ্ঞানিকেরা ত পরিষ্কারই বলিয়া দিয়াছেন, স্বভাবের প্রকৃত সময় (True time of nature) আজও তাহারা জানেন না। দর্শকের নিজস্ব গতির উপরে কালের গতি নির্ভর করে। একস্থানে দাঁড়াইয়া থাকিলে যেভাবে কোন ঘটনাকে ঘটিতে দেখিব দ্রুতবেগে দৌঁড়াইয়া গেলে সে গতিতে দেখিব না। মনে করুন, কোন ব্যক্তি তাহার ইচ্ছামত যেকোন বেগে শূণ্যলোকের মধ্য দিয়া উড়িয়া যাইতে পারে। সে যদি আলোকের গতি অপেক্ষা কম গতিতে ছোটে, তবে দেখিব স্বাভাবিকভাবেই ঘটনা ঘটিয়া যাইতেছে। অর্থাৎ সময় সম্মুখের দিকে অগ্রসর হইতেছে। অন্য কথায় রবির পর সোম, সোমের পর মঙ্গল আসিতেছে। সে যদি আলোকের সম গতিতে অর্থাৎ প্রতি সেকেন্ডে ১৮৬,০০০ মাইল বেগে ছুটিতে পারে, তবে দেখিব সময় স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া আছে অর্থাৎ সকাল কি সন্ধ্যা কিছুই বুঝা যাইতেছে না। আবার আলোকের গতি অপেক্ষা বেশী দ্রুত যদি সে ছুটতে পারে তবে দেখি সময়ের গতি উল্টা দিকে চলিতেছে, অর্থাৎ কোন ঘটনা ভবিষ্যতের দিকে না গিয়া পিছাইয়া যাইতেছে ; অন্য কথায় রবির পর শনি, শনির পর শুক্র আসিতেছে। ইহা দ্বারা বুঝা যায়, গতির তারতম্যে সময়ের তারতম্য ঘটিয়া যায়। গতির উপর থাকিলে সময় অস্বাভাবিকরূপে খাটো হইয়া যায়। আইনস্টাইন বলিয়াছেন, There is no standard time, all time is local. স্থান বা কালের ন্যায় গতি আপেক্ষিক। নির্দিষ্ট কোন গতির কথা কেহই বলিয়া দিতে পারে না। মনে করুন, একখানি ট্রেন ঘন্টায় ৫০ মাইল বেগে ছুটিতেছে। একজন যাত্রী তাহার কামরা হইতে বাহির হইয়া খাবার গাড়িতে যাইতেছে। কিন্তু রেল লাইনের ধারে কোন বাড়ির জানালায় দাঁড়াইয়া যদি একটি লোক এই চলন্ত গাড়ির দিকে তাকাইয়া থাকে, তবে সে কি দেখিবে ? সে দেখিবে লোকটি ৫০ মাইল বেগে যাইতেছে। আবার মঙ্গল গ্রহ হইতে দেখিলে দেখা যাইবে পৃথিবীর আহ্নিক গতির সম গতিতে (অর্থাৎ ১০০০ মাইল বেগে) লোকটি ছুটিয়া চলিয়াছে।’
তারিখ : কক্সবাজার : ১লা মার্চ, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ, মঙ্গলবার