লামা প্রতিনিধি:

বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে রাবার প্লটের নামে ৩টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি পাড়ার ৩৯টি পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস পাহাড়ি জুমের জায়গা জবর দখল অব্যাহত রেখেছে। শুধু তাই নয়, প্রতিবাদ করলে প্রতিনিয়ত মামলা ও হামলার হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি পরিবারগুলোর অভিযোগ, লামা রাবার ইন্ড্রাষ্টিজ নামের একটি কোম্পানী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিদের বংশ পরস্পরায় ভোগ দখলীয় জায়গা দখল করতে ভয় দেখাচ্ছে। কোম্পানী জায়গা দখলের উদ্দেশ্যে গত কয়েক দিনে শতশত বনজ ফলদ গাছ কেটে দেয় ও একটি খামার ঘর আগুনে পুড়িয়ে দেয়। এ ঘটনায় থানায় লিখিত অভিযোগও করা হয়। বর্তমানে ভূমিদস্যুদের হুমকিতে ভীত তিন পাড়ার সবাই। এসব বিষয়ে পাড়াবাসীরা প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে জায়গা জবরদখল বিষয়ে আবেদন করে আসলেও কোন সূরাহা হয়নি বলে পাড়াবাসীর অভিযোগ। জায়গা দখল বেদখলকে কেন্দ্র করে যে কোন মুহূর্তে দুই পক্ষের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সচেতন মহল।

অভিযোগে জানা যায়, উপজেলার সরই ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি লুলাইং সড়কের পাশে লাংকম কারবারী পাড়া, জয় চন্দ্র ত্রিপুরা কারবারী পাড়া ও রেংয়েন ¤্রাে কারবারী পাড়ার অবস্থান। এ তিন পাড়ার ৩৯টি পবিারের প্রায় প্রায় ২০০ নারী পুরুষ ও শিশুর বসবাস। এ পাড়ার লোকজন বংশ পরস্পরায় পাড়াগুলোর আশপাশের প্রায় ৪০০ একর পাহাড়ি জায়গায় জুষ চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। কিন্তু ২০১৯ সালে এসে লামা রবাার ইন্ড্রাস্টিজ নামের একটি কোম্পানী রাবার প্লটের নামে জোর করে জুমের জায়গা দখলে নিতে অপচেষ্টা শুরু করেন। দখলে বাঁধা দিলে মামলা, হামলা, খুন ও পুলিশের ভয়ও দেখানো হচ্ছে তাদের। তিন গ্রামবাসীরা ওইসব ভূমি তাদের বংশ পরম্পরায় চাষ করা জুমভূমি এবং বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন বলে দাবি করেন। এদিকে সরই মৌজা হেডম্যান দূর্যধন ত্রিপুরা ও মৌজা হেডম্যানের সাবেক মুহুরী হাজিরাম ত্রিপুরার মদদে কোম্পানী এসব জায়গা জবর দখলে সাহস পাচ্ছে বলে জানান পাড়াবাসী। তবে অভিযুক্ত দূর্যধন ত্রিপুরা বলেন, আমি একজন হেডম্যান হয়ে কোম্পানীকে মদদ দেওয়ার প্রশ্নই উঠেনা। আমার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। একটি মহল শত্রুতা মূলক আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে মাত্র।

সোমবার সকালে পাড়া ৩টি ও আশপাশ ঘুরে দেখা যায়, শতাধিক শ্রমিক লাগিয়ে দখলদাররা ম্রো ও ত্রিপুরাদের পাড়ার পশ্চিমে জুমের জায়গাগুলোতে রোপিত বিভিন্ন্ প্রজাতির গাছ ও জঙ্গল কাটছে। গত ২০-২৫ দিনে শতাধিক শ্রমিক লাগিয়ে ২৫০-৩০০ একর জায়গার জঙ্গল ও বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটেছে কোম্পানীর লোকজন। এ সময় পাড়ার মেনসিং ¤্রাে, মেনরাও ¤্রাে, সংরুং ত্রিপুরাসহ অনেকে অভিযোগ করেন, ভূমি দখলকারীর লোকজন তাদের ভয়ভীতি ও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে এ কাজ করেছ। অথচ উপজেলা চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে আমাদেরকে ১৫০ একর জায়গা ছেড়ে দিবে কোম্পানী। কিন্তু সেসব স্থান থেকে কাঠ, বাঁশ, লাকড়ি সংগ্রহ করতেও বাধা দিচ্ছে তারা। সব কেটে আগুন লাগিয়ে পুড়ে দিচ্ছে। এমনকি সেখানে তাদের গরু চরাতেও দেওয়া হচ্ছে না। জঙ্গল কাটার সময় রোহিঙ্গা শ্রমিকসহ লাঠিয়াল বাহিনী পাহারা দিয়ে থাকার পাশাপাশি মদ জুয়ার আড্ডা বসায় সেখানে। তারা আরো জানায়, কোম্পানীর জবর দখলের কারণে এখন আছে শুধু পাড়ার জায়গাগুলো। লোকজন পাড়ার বাইরে গরু-ছাগল চরাতে গেলে দখলদারদের লোকজন বাধা দেয়। তারা প্রশ্ন করেন, জুমচাষ করতে না পারলে, চলাচল করতে না পারলে, গরু-ছাগল পালতে না পারলে খাব কী? নিরুপায় হয়ে কি পাড়া ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে ?

পাড়ার অনারাম ত্রিপুরা বলেন, ৪৫ বছর ধরে ৩০৩নং ডলুছড়ি মৌজাস্থ নিজেদের জায়গায় জুমচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছি। অথচ এত বছর পরে কোম্পানী এসে বলছে, এসব জায়গা তাদের। এ জুমচাষ ছাড়া আমাদের চলার কোন বিকল্প ব্যবস্থা নেই। যে কোন মুহুর্তে কোম্পানীর লোকজন আমাদের উপর হামলা করতে পারে। দখলকৃত জায়গা-জমির মধ্যে রোপিত বাঁশ-গাছ কাটা ও চাষাবাদের কাজে কোম্পানীর লোকজন বাধা দিচ্ছেন।

লাংকম পাড়ার কার্বারি লাংকম ম্রো বলেন, ইউনিয়নের ডলুছড়ি মৌজার তিন পাড়ায় তাঁরা বংশ পরম্পরায় বসবাস করে আসছেন। যুগ যুগ ধরে পাড়াগুলোর আশপাশের জায়গাতে জুমচাষ করে আসছেন পরিবারগুলো। এখন লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ দখল করার চেষ্টা করছে। গত বছরও ১০০ একরের মত দখল করেছে। এ বছরও প্রায় দখলের উদ্দেশ্যে ২৫০ থেকে ৩০০ একর জায়গার জঙ্গল ও গাছ কেটে পরিস্কার করেছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপক আরিফ হোসেন বলেন, কোম্পানীর শেয়ারহোল্ডার গণের নামে ১৯৮৮-৮৯ সালে রাবার বাগানের জন্য ইজারা নেওয়া জমিতে এতদিন ম্রো ও ত্রিপুরারা অবৈধভাবে বসবাস করেছেন। তাদের নামে কোন বন্দোবস্তি বা বৈধ কাগকপত্র নেই। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি পরিবারগুলোকে কোনো হুমকিও দেওয়া হয়নি। এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা বানোয়াট। সমাধাকৃত বিষয়টিকে ভিন্নখাতে প্রভাবিত করতে মিথ্যা অভিযোগ তুলছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিরা। তাছাড়া তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতেই স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মধ্যস্থতায় কোম্পানী স্বইচ্ছায় ১৫০ একর জায়গা তিন পাড়ার লোকজনকে ছেড়ে দিয়েছেন। এরপর কোম্পানীর সাথে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির আর কোন বিরোধ থাকার কথা না।

এ বিষয়ে ডলুছড়ি মৌজা হেডম্যান যোহন ত্রিপুরা জানান, লামা রাবার ইন্ড্রাস্ট্রিজের লোকজন যে জায়গাগুলো পরিস্কার করছে, মূলত সে জায়গাগুলো লাংকম কারবারী পাড়া, জয় চন্দ্র ত্রিপুরা কারবারী পাড়া ও রেংয়েন ¤্রাে কারবারী পাড়াবাসীর। তারা বংশ পরস্পরায় ওই জায়গায় জুম চাষের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। মাঝখানে যখন আমার হেডম্যানসিপ ছিলনা, তখন এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কোম্পানী ওইসব জায়গা জবর দখল শুরু করেন। এদিকে লামা উপজেলা চেয়ারম্যান মো. মোস্তফা জামাল জানায়, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি ও লামা রাবার ইন্ড্রাষ্টিজের মধ্যে জায়গা নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ মিমাংশায় বৈঠকে হয়েছে। বৈঠকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি পরিবারগুলোর দাবীর প্রেক্ষিতে কোম্পানী কর্তৃক ১৫০ একর জায়গা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। উভয় পক্ষ এ সিদ্ধান্ত মেনেও নিয়েছেন। এতে আর কোন বিরোধ থাকার কথা না।