আবদুর রহমান খান
পাকিস্তানে রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থার মধ্যে দেশটির সুপ্রীম কোর্ট এবং জাতীয় সংসদ আবারো একবার মুখোমুখি অবস্থানে চলে এসেছে।
সর্বশেষ খবরে জানা যায়, গতকাল ( ৭ এপ্রিল) সন্ধ্যায় পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ সর্বসম্মত রায়ে চারদিন আগে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ভেঙ্গে দেওয়া জাতীয় সংসদকে পুর্জাগরিত করে দিয়েছে। একই সাথে শনিবার ( ৯ এপ্রিল) সকাল দশটায় সংসদ অধিবেশন ডেকে প্রধান্মন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে আনীত অনাস্থা প্রস্তাব সুরাহা করতে বলেছে। বিষয়টি সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত সংসদ অধিবেশন চালিয়ে যেতে হবে এবং কোনো সদস্যকে সংসদের অধিবেশনে যোগদানে বাধা দেওয়া যাবেনা ।
এর আগে গত ৩ এপ্রিল, প্রধায়মন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে আনীত অনাস্থা প্রস্তাবকে বিদেশি ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করে জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করে দেন ডেপুটি স্পীকার কাসিম সুরী । এর পর পরই প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে দেশটির রাষ্টপতি ডঃ আরিফ আলভি জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেন।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে এমন নাটকীয় পট পরিবর্তনের মাঝে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান গত রাতে এক টুইট বার্তায় জানিয়েছেন, তিনি আজ (০৮ এপ্রিল) তার মন্ত্রি পরিষদের সাথে বসবেন এবং জাতীর উদ্দেশ্যে ভাষন দেবেন। তিনি শেষ বলটি পর্যন্ত খেলে যেতে চান।
পাকিস্তানের বহুল প্রচারিত ইংরেজী দৈনিক ডন পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, পার্লা্মেন্ট ভেঙ্গে দেওয়া সংক্রান্ত রাষ্টপতির আদেশকে অসাংবিধানিক আখ্যায়িত করে রায় দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়াল। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এ মর্মে রাষ্টপতিকে পরামর্শ দিয়ে সংবিধানের ৫৮ ধারা লংঘন করেছেন। এ ধারায় বলা আছে, সরকারের বিরুদ্ধে কোনো অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপিত হলে তা সমাধান না করে সংসদ বিলুপ্ত করা যায় না।
উচ্চ আদালতের এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বিরোধী দলীয় নেতা শাহবাজ শরীফ বলেছেন সুপ্রীম কোর্ট জনগনের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছে।
উচ্চ আদালতের রায় ঘোষনার আগে, প্রধান বিচারপতি বান্দিয়াল শ্রী লঙ্কা পরিস্থিতির প্রসংগ টেনে মন্তব্য করেন, দেশটিতে বিদ্যুৎ সহ মৌলিক চাহিদা পুরনের মত অর্থ নেই। আজকে পাকিস্তানে ডলারের মূল্য ১৯০ রুপী হয়ে গেছে। এ অবস্থায় পাকিস্তানে একটি শক্তিশালী সরকার প্রয়োজন।
কেনো ইমরানকে বিরোধীতা করা হচ্ছে?
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক সংকটের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করে ওয়াশিংটন পোষ্ট পত্রিকায় বলা হয়েছে ২০১৮ সালে নির্বাচনে ইমরান খানের দল তেহরিক –ই – ইনসাফ বিজয়ী হবার পর থেকেই বিরধীতার শুরু। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রভাব খাটিয়ে অন্য দলের সমর্থনে জোড়াতালির সরকারে তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে- এমন অভিযোগ শুরু থেকেই চলে আসছিল।
সাম্প্রতিক সময়ের অর্থনৌতিক সংকট, বৈদেশিক ঋনের বোঝা, রূপীর মূল্য মান কমে যাওয়া, এবং দুর্নীতির ব্যাপকতা ইমরান খানের জন্য নতুন সংকটের জন্ম দেয়। এর সাথে যুক্ত হয় আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক ভু-রাজনৈতিক জটিলতা।
চীনের প্রতি অধিক নির্ভরতা, সৌদি আরবের সাথে সম্পর্কের অবনতি , তালেবানদের মদ্ত দিয়ে মার্কিন বাহিনীকে আফগানিস্তান ছেড়ে যেতে বাধ্য করা, ইরান ও রাশিরা সাথে ঘনিষ্টতা বৃদ্ধি এবং বিশেষ করে ইসলামী উম্মার অগ্রগতির জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠার কারনে ইমরান খান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা দেশগুলির গাত্রদাহের কারণ হয়ে উঠেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের পত্রিকা মিডল ইষ্ট আই - এ প্রকাশিত (৬ এপ্রিল ) এক নিবন্ধে বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক পিটার অবরনি উল্লেখ করেছেন , রাজনীতিবিদ হিসেবে ইমরানের অনেক শিক্তিশালী দিক রয়েছে। তবে তার মুল দুর্বলতা হচ্ছে- আত্মবিশ্বাস, ইসলামি বিশ্বাস, এবং নিজেকে দুর্নীতি মুক্ত রাখা।
তবে ইমরানের এবারের সংকট বিষ্ফোরিত হয়েছে পাঞ্জাবের চীফ মিনিস্টার উসমান বাজদার-এর ব্যাপক দুর্নীতির ফলে। এ ব্যাক্তি পাঞ্জাবে ইমরানের সবচেয়ে ঘনিষ্ট । তাই রাজনৈতিক কারনেই ঝড় ইমরানের বিপক্ষে বইতে শুরু করে।
ইমরান খানের সরকারের গত তিন বছরে বিরোধী নেতাদের দিন কেটেছে কারাগারে, আদালত চত্তরে এবং দুর্নীতির অভিযোগ সামলাতে। এতদিনে তারাও নিজেদের মধ্যে একরকম সমঝতায় পৌছেছে যে ইমরান সরকারের পতন ঘটাতে হবে, যে করেই হোক না কেন। এ ব্যাপারে পাকিস্তা্নের রাজনীতিতে প্রভাবশালী শক্তি সেনাবাহীনির উর্দ্ধ মহলের সহানুভুতিও কিছুটা যোগার করা গেছে বলে পর্বেক্ষকগন মনে করছেন।
ওয়াশিংটন পোষ্ট উল্লেখ করেছে, গতবছর থেকে সেনাপ্রধান ওমর বাজোয়া’র সাথে ইমরান খানের সরকারের মতান্তর দেখা দিতে শুর করে। সরকারের বিভিন্ন কর্মকান্ড , অর্থনৈতিক সংকট এবং দুর্নীতি বিরোধী তৎপরতা নিয়ে এ বিরোধ স্পষ্ট হতে শুরু করে।
তবে প্রধান বিরোধটা দেখা দেয় পররাষ্টনীতি প্রসঙ্গে। তার সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার দায়ে মার্কিন যুক্ত্রাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করে ইমরান খান প্রকাশ্যে বক্তব্য দিলেও তার সেনা প্রধান মার্কিনিদের ঘনিষ্ট মিত্র হিসেবে উল্লেখ করছেন।
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর পাকিস্তানে মার্কিন সামরিক ঘাটি গুটিয়ে নিতে ইমরানের দাবী এবং রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্ব বাড়ানর উদ্যোগ আমেরিকাকে বেশ অসন্তুষ্ট করেছে।
উইওন বার্তা সংস্থা মস্কো থেকে পরিবেশিত এক খবরে জানিয়েছে , রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্টতা বৃদ্ধির জন্য ইমরানকে সায়েস্তা করতে চাইছে আমেরিকা। রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানের প্রস্তুতি পর্বে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ইমরান খান মস্কো সফর করেছেন। আমেরিকার পক্ষ থেকে এ নিয়ে হুশিয়ার করে দেয়া হয়েছে বলে ইমরান নিজেই দাবী করেছেন।
রুশ পররাষ্টমন্ত্রী মারিয়া যাখাোরোভা এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেছেন, আমেরিকা পাকিস্তানের রাজনীতিতে নগ্ন হস্তক্ষেপ করছে।
কী হতে পারে?
আদালত নির্দেশিত পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের শনিবারের অধিবেশনে কী হবে? ইমরান খান চাইছে তার সরকার ও সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে নতুন আগাম নির্বাচন দেওয়া হোক। আর বিরোধীরা চাইছেন অনাস্থা ভোটে ইমরানের সরকার পতন হোক এবং বর্তমান সংসদের মাধ্যমে নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হোক। নতুন সরকার গঠিত হোক।মেয়াদ পুর্তি পর্যন্ত পার্লামেন্ট বহাল থাকুক ।
ইমরানকে হটিয়ে বিরোধীরা যদি সরকার গঠন করে সেক্ষেত্রে ইমরান তার গণমূখী কৌশল অবলম্বন করে বিরোধীতায় নামবে এবন আন্দোলন সংগঠিত করার চেষ্টা করবেন এটা অবধারিত।
এ অবস্থায় সকল পক্ষকে নিয়ে একটা সর্বসম্মত নির্বাচন অনুষ্ঠান বেশ কঠিন হয়ে পড়বে।
তবে, অনেককিছুই নির্ভর করছে দেশটির সেনাবাহিনী কী ভূমিকা নেবে তার ওপর। রাজনৈতিক সংকট যদি দির্ঘায়িত হয় এবং অর্থনোইতিক সংকট আরো তীব্র হয়ে ওঠে, তবে অতীতের মতে আর একবার পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নিতে পারে। ###