তাওহীদুল ইসলাম নূরী
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আদর্শের বিশ্বমানব বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (স.) সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলেছেন "রাসূল (স.) এর জীবনে তোমাদের জন্য রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ"।
সাধারণত মানুষের যে গুণটি অনুসরণ ও অনুকরণ যোগ্য সেটাকে আদর্শ বলে। আর বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (স.) এর জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্তই আমাদের জন্য আদর্শ। এখানে রাসূল (স.) এর পারিবারিক, সামাজিক, সাংগঠনিক, সামরিক এবং রাজনৈতিক জীবন নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব।
পারিবারিক জীবনঃ
সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রতম একক হচ্ছে পরিবার। পরিবার থেকেই শুরু হয় নেতৃত্বের গোড়াপত্তন। রাসুলের ক্ষেত্রে দেখা যায় তিনি পরিবারের একজন সন্তান, স্বামী এবং পিতা হিসেবে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। চাচা আবু তালিবের ঘরে থাকাকালীন সময়ে তিনি দেখলেন চাচার আর্থিক অবস্থা তেমন ভাল না। তাই, শিশু বয়সে তিনি বকরী চরনোর পথ বেছে নেন। "আমি অভাব-অনটনের মধ্যে থাকতে চাই। একবেলা আহার করব তো আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করব, আরেক বেলা না খেয়ে ধৈর্য ধারণ করব" যেই নবী বলেছিলেন সেই নবী সাধ্যের মধ্যে তাঁর স্ত্রীদের সর্বোচ্চ আভিজাত্যপূর্ণ, সম্মানজনক এবং উন্নতভাবে চালিয়েছেন। সন্তানদেরকেও সেরূপে মানুষ করেছেন। তিনি বলছেন, "তোমাদের মধ্যে সেই লোক উত্তম, যে তার স্ত্রীদের কাছে উত্তম। আমি আমার স্ত্রীদের কাছে সর্বোত্তম।" বিশ্বনবীর ইন্তেকালের পর তাঁর সহধর্মিণী হযরত আয়েশা (র.) কে তাঁর (রাসুলের) চরিত্র কেমন ছিল জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তরে বলেছিলেন "তোমরা কি কোরআন পড় নি? একটা জীবন্ত কোরআন যদি দেখতে চাও তাহলে রাসুল (স.) এর দিকে তোমরা তাকাও।" এখান থেকেই আমরা বিশ্বনবীর পারিবারিক জীবন মূল্যায়ন করতে পারি।
সামাজিক জীবনঃ
আদর্শ সমাজ গঠনের জন্যও বিশ্বনবী (স.) ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে স্মরণীয় হয়ে আছেন।হত্যা,রাহাজানি,খুন-খারাবি,চুরি-ডাকাতি,মারামারি,কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়া,মদ্যপান,জুয়া,সুদ-ঘোষ,ব্যাভিচারসহ এক অন্ধকারে ভরা আরব সমাজে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। সেই সমাজে তিনি নীতিনৈতিকতা,শান্তি-শৃঙ্খলা,সৌহার্দ্য,সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে এনেছিলেন এক অবিস্মরণীয় পরিবর্তন। আমাদের আজকের সমাজ সেই পরিবর্তনের ধারাতেই। যে কন্যা সন্তানদের হয় জীবন্ত কবর দেয়া হত নয় পন্যের মত বাজারে ক্রয়-বিক্রয় করা হত, বিশ্বনবীর "মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত" উক্তি সমাজে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। নবুওয়ত লাভের আগে থেকেই আত্মীয়তার সম্পর্ক জোড়া লাগানো, অসহায়ের পাশে থাকা, ক্ষুধার্তের অন্ন যোগান, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র প্রদান, প্রাকৃতিক দুর্যোগে জনগণের পাশে দাঁড়ানোসহ নানান মানবিক কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করা যায় তাঁর জীবনে। "যে ব্যক্তি ছোটদের স্নেহ করে না এবং বড়দের শ্রদ্ধা করে না সেই ব্যক্তি আমার দলভুক্ত নন" রাসুলের এই বাণী সমাজে ছোট-বড় সকলের অধিকার নিশ্চিত করেছে। এসব কারণেই হয়ত অমুসলিম মনীষী টমাস কার্লাইল এবং মন্টমেগেরি ওয়াট বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (স.)কে একজন প্রভাবশালী, ইতিবাচক এবং ঐতিহাসিক সংস্কারক হিসেবে অবিহিত করেছেন।
সাংগঠনিক জীবনঃ
যেকোন একটা বিষয় সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে সংগঠনের বিকল্প নাই। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে নিজের সকল মানবীয় গুণ সমাজের মানুষের মাঝে সৃষ্টি করতে যুবক বয়সে রাসুল (স.) সংগঠনের তাগাদ অনুভব করেন। এই মহান উদ্দেশ্য তথা আর্তের সেবা, অত্যচারীকে প্রতিরোধ, অত্যচারীতকে সাহায্য, যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ করে গোত্রে গোত্রে শান্তি, শৃঙ্খলা এবং সম্প্রীতি বজায় রাখতে হিলফুল ফুজুল নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। জাতিসংঘসহ আজকের বিশ্বে আলোচিত সংগঠনগুলো মূলত বিশ্বনবীর হিলফুল ফুজুলকে অনুসরণ করেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সামরিক জীবনঃ
হযরত মোহাম্মদ (স.) সমগ্র পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সফল সমর নায়ক। পরিবেশ পরিস্থিতি, পটভূমির প্রাসঙ্গিক লক্ষ্মণসমূহ এবং পরিণতি বিবেচনায় তিনি ছিলেন অতুলনীয়। মূলত এসব মাথায় রেখেই তিনি সামরিক অভিযানসমূহ পরিচালনা করতেন। সৈন্য সমাবেশ, যুদ্ধ পরিকল্পনা, অবস্থান নির্ণয় এবং সমর কুশলতায় তাকে কেউ অতিক্রম করতে পারে নি। এজন্যই তো তার পরিচালিত সকল যুদ্ধে মসুলমানরা বিজয়ী হয়েছে। উহুদ এবং হুনাইনের যুদ্ধে মূলত কিছু মসুলমানের ব্যক্তিগত দূর্বলতার কারণেই পরাজয় হয়েছে, রাসুল (স.) এর নিদের্শনা মানলে পরাজয় দূরের কথা কোন লক্ষ্মণও ছিল না পরাজয়ের। উহুদে তো বিজয়ী হয়ে রাসুলের নির্দেশ না মানার কারণেই এমন ফলাফল। উহুদের মাধ্যমে আল্লাহ মূলত নেতার নেতৃত্ব মানার গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় রাসুল (স.) মোট ৮০ টা সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছেন। যেখানে ২০ টিরও কমক্ষেত্রে লড়াইয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে। সকল যুদ্ধে মসুলমান-কাফের মিলে হতাহতের পরিমাণ এক হাজারের কমবেশি হতে পারে। যেখানে মসুলমান শহীদ হওয়ার সংখ্যা প্রায় তিনশত এবং কাফের নিহত হওয়ার পরিমাণ সাতশত। বাকি সব কাফেরকে বিশ্বনবী (স.) পাইকারি হারে ক্ষমা করে দিয়েছেন। অন্ধকার যুগে যুদ্ধ মানে যেখানে লুটতরাজ,হত্যা-ধ্বংস,অবিশ্বাস্য রকমের বাড়াবাড়ি, যুলুম-অত্যাচার, নারীদের ইজ্জত লুন্ঠন, শিশুদের এবং বৃদ্ধদের সাথে নিষ্ঠুর ও নৃঃশংস আচরণ ছিল বিশ্বনবী (স.) এটিকে পবিত্র জিহাদে রূপ দিয়েছেন। মুহাম্মদ (স.) প্রদর্শিত জিহাদের হচ্ছে মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে যুলুম-নির্যাতনের পথ থেকে বের করে এনে একটি ন্যায় ও সুবিচারমূলক ব্যবস্থায় নিয়ে আসার প্রচেষ্টা।
রাজনৈতিক জীবনঃ
আল্লাহর কোরআন এবং রাসুলের হাদীস তথা ইসলাম নিজে পালনের পাশাপাশি রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করতে রাজনীতির কোন বিকল্প নাই। রাজনীতির সংজ্ঞা যাই হোক না কেন আল্লাহর দ্বীন কায়েমের জন্য রাজনীতি ইসলামের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইসলামি রাজনীতিতে ঘটে একটি সুন্দর পার্থিব ও আধ্যাত্মিক জীবনের সমন্বয়। ইমাম নববী ও নাসির উদ্দীন আলবানী (র.) যারা রাজনীতি ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে তাদেরকে জাহেল এবং পথভ্রষ্ট বলেছেন। কারণ, যতদিন পর্যন্ত ইসলাম রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা না হবে ব্যক্তিগতভাবে যে যেভাবেই দাওয়াতের কাজ করুক না কেন সফলতা আসবে না। দ্বীনকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে চাই রাজনীতি। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে যে কাফের, জালেম ও ফাসেকমুক্ত নেতৃত্বের কথা বলছেন সেটার জন্য রাসুল (স.) এর রাজনৈতিক দর্শন থেকে শিক্ষা নেয়া জরুরি। মদিনা সনদ, হুদাইবিয়ার সন্ধি ছিল রাসুল (স.) রাজনৈতিক দুরদর্শিতার ফসল।
ইসলাম হচ্ছে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। জীবনের সকল ক্ষেত্রেই সমস্ত কর্মপরিসরে এর ব্যাপকতা বিরাজমান। সমগ্র মানবতার আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকসহ সকল ক্ষেত্রেই এর রয়েছে নিখুঁত নীতিমালা। যে নীতিমালার মূল হচ্ছে আল কুরআন ও নবী (সা.) এর আদর্শ। কুরআন এই শিক্ষা প্রদান করে যে, ইসলাম শুধু প্রচারের জন্য নয়, বরং অনুশীলন করে তা বাস্তবায়নের জন্য। সঠিকভাবে একে উপস্থাপন করে সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে। সঠিক ইসলাম বাস্তবে রূপ দেয়ার ক্ষমতা কুরআনুল কারীমে সূরা হজ্জের ৪১ আয়াতে মুসলিম রাষ্ট্রনায়কদের হাতে ন্যাস্ত করা হয়েছে। তারা যদি তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন, তাহলে জাতির বিপর্যয় অবশ্যসম্ভাবী। বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে, রাসূল (সা.) বলেছেন: বনী ইসলাঈলের রাজনীতি পরিচালনা তাদের নবীরাই করতেন। একজনের মৃত্যুর পর অন্যজন সে দায়িত্ব অব্যাহত রাখতেন। কিন্তু আমার পরে আর কোন নবী নেই। আমার পরে এ দায়িত্ব পরিচালনা করবে খলিফাগণ। সাহাবায়েকেরাম প্রশ্ন করলেন তখন আমাদের করণীয় কি হবে? তিনি বললেন, তোমরা পর্যায়ক্রমে তাদের নিকট বায়াত পূর্ণ করবে। তাদের প্রাপ্য হক আদায় করবে। আল্লাহর নিকট ঐ জিনিষের প্রার্থনা করবে যা তোমাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে। আর তাদের দায়িত্বের জবাব আল্লাহ কিয়ামতের ময়দানে নিবেন।”
পারিবারিক, সমাজিক, সাংগঠনিক, সামরিক এবং রাজনৈতিক তথা ঘর থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে অত্যন্ত সফলতার সহিত পদচারণা করেছেন মোহাম্মদ (স.)। তার তুলনা হতে পারে দ্বীতিয় এমন কেউ নাই। তার তুলনা তিনি নিজেই। সেজন্য আমাদের উচিত তার আদর্শ আমাদের জীবনে অনুসরণ ও অনুকরণের মাধ্যমে দুনিয়া, আখিরাত উপযোগী একজন মানুষ হওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন।
লেখকঃ আইন বিভাগ (অধ্যয়নরত), আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম।
শাহারবিল সদর, চকরিয়া, কক্সবাজার।