মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :
বন বিভাগের পাহাড় কেটে ঘর তৈরি করার অপরাধে আদালতে দোষী সাব্যস্থ হন ২ আসামী। এজন্য আসামীদের প্রত্যেককে আইনানুযায়ী এক বছর সশ্রম কারাদন্ড, ১০ হাজার টাকা করে সরকারকে ক্ষতিপূরণ এবং ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ড, অর্থদন্ড অনাদায়ে আরো এক মাস সশ্রম কারাদন্ডের রায় দেন বিজ্ঞ বিচারক। কিন্তু আসামীদের অপরাধের জন্য এই সাজার পরিবর্তে তাদের বয়স ও মামলার গুরুত্ব বিবেচনায় শুধুমাত্র ক্ষতিপূরণ প্রদান, গঠনমূলক কর্ম সম্পাদন, ভাল আচরণ করার জন্য আসামীদের প্রাবেশন সাজা অর্থাৎ বিকল্প সাজা দিয়ে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত নম্বর-৫ এর বিজ্ঞ বিচারক আসাদ উদ্দিন মো: আসিফ গত ২০ এপ্রিল এ রায় দেন।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ হলো : ২০১৭ সালের ১২ জুলাই বিকেল সাড়ে ৩ টার দিকে রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের মিয়াজি পাড়ার বন বিভাগের সংরক্ষিত বনে মাটি কেটে ঘর তৈরি করা অবস্থায় বন বিভাগের লোকজন একই এলাকার দক্ষিণ মৌলভীকাটার দানু মিয়ার পুত্র মোঃ নুরুল আমিনকে আটক করে এবং মৃত মোঃ সাচি'র পুত্র ছালে আহম্মদ ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। পরে বন বিভাগের সংরক্ষিত বনে অবৈধভাবে নির্মিত ঘর বন বিভাগের লোকজন ভেঙে দেয়।
এ ঘটনায় বন বিভাগের কর্মকর্তা তপন কান্তি পাল বাদী হয়ে বাদী হয়ে আসামীদ্বয়ের বিরুদ্ধে ১৯২৭ সনের বন আইনের (২০০০ সালে সংশোধিত) ২৬ (১ক) ধারায় অভিযোগ এনে আদালতে মামলা দায়ের করেন।যার বন মামলা নম্বর ৫৬/২০১৭ (রামু)। ২০১৭ সালের ১৬ অক্টোবর বিচারের জন্য কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত নম্বর-৫ এ মামলাটির চার্জ (অভিযোগ) গঠন করা হয়।
আদালতের বিজ্ঞ বিচারক আসাদ উদ্দিন মো: আসিফ মামলাটির বাদী সহ ২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। সাক্ষী ২ জনকে আসামী পক্ষের আইনজীবী জেরা করেন। মামলার অন্যান্য বিচারিক সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর ১৯২৭ সনের বন আইনের (২০০০ সালে সংশোধিত) ২৬ (১ক) ধারায় আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বিজ্ঞ বিচারক আসাদ উদ্দিন মো: আসিফ আসামীদের প্রত্যেককে এক বছর সশ্রম কারাদন্ড, ১০ হাজার টাকা করে সরকারকে ক্ষতিপূরণ এবং ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ড, অর্থদন্ড অনাদায়ে আরো এক মাস সশ্রম কারাদন্ডের রায় দেন।
কিন্তু এই সাজার পরিবর্তে আসামীদ্বয়ের বয়স ও লঘু অপরাধ বিবেচনায় শুধুমাত্র ক্ষতিপূরনের অর্থ পরিশোধ, গঠনমূলক কর্ম সম্পাদন ও ভাল আচরণ করার জন্য আসামীদের প্রাবেশন সাজা অর্থাৎ বিকল্প সাজার আদেশ দেন বিজ্ঞ বিচারক। যাতে আসামীরা সংশোধন হওয়ার সুযোগ পায়।
প্রবেশন আদেশে আসামিদ্বয়ের প্রত্যেককে ১০০টি করে বৃক্ষ রোপন সহ ৮ টি শর্তারোপ করা হয়েছে। রায়ে বিজ্ঞ বিচারকের দেওয়া প্রবেশন আদেশের ৮টি শর্ত হচ্ছে :
(১) রায় ঘোষণার তারিখ হতে পরবর্তী এক বছরের জন্য প্রতি সপ্তাহের মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার আসামীরা সংশ্লিষ্ট রেঞ্জ কর্মকর্তা কর্তৃক নির্ধারিত 'প্রত্যাহিক সেবামূলক কর্ম' সম্পাদন করবেন। রায়ে প্রদত্ত ক্ষতিপূরণের অর্থ চালানের মাধ্যমে জমা করে আদালতে চালানের কপি দাখিল করতে হবে। আসামীরা কোন অপরাধকর্মে জড়িত হবেন না। অনুরূপ অপরাধ আর করবেন না মর্মে ৩ কপি বন্ড সম্পাদন করে, বন্ডের এক কপি সংশ্লিষ্ট থানায়, এক কপি বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয়ে এবং এক কপি মামলার নথিতে দাখিল করতে হবে।
(২) আসামীদ্বয়ের বয়স, কর্মক্ষমতা ও প্রচলিত আইন বিবেচনায় আদালতের রায় অনুযায়ী বাঁকখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা তাদের জন্য কর্ম পরিকল্পনা তৈরি করে তাঁর এলাকায় একজন ভিলেজার/শ্রমিক যেভাবে কাজ করেন, সেভাবে আসামী মোঃ নুরুল আমিন ও ছালে আহম্মদকে দিয়ে প্রত্যাহিক সেবামূলক কর্ম সম্পাদন করিয়ে নেবেন।
(৩) রেঞ্জ/বন কর্মকর্তা কর্তৃক নির্ধারিত জমিতে প্রত্যেক আসামী ১০০ টি করে বৃক্ষ রোপন করবেন।
(৪) সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখবেন এবং ভাল আচরণ ও ভাল ব্যবহার করবেন।
(৫) বিচারক/আদালত, আইনশৃংখলা বাহিনী কর্তৃক তলব করা হলে তদানুসারে উপস্থিত হতে আসামীরা বাধ্য থাকবেন।
(৬) কোন প্রকার মাদকদ্রব্য সেবন করবেন না, বহন, হেফাজতে রাখা যাবে না এবং কোন মাদকদ্রব্য সেবী বা বহনকারী বা হেফাজতকারীর সাথে মেলামেশাও করা যাবে না।
(৭) রামু'র প্রবেশন কর্মকর্তা আসামীদ্বয়ের নিয়মিতভাবে প্রবেশন তত্বাবধান ও পর্যবেক্ষন করবেন। প্রতি ২ মাস অন্তর অন্তর ধার্য তারিখে প্রতিবেদন দাখিল করবেন।
(৮) কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য, বিজ্ঞ আইনজীবী হারুনুর রশিদ এর মাধ্যমে আসামীদের প্রবেশন কর্মকর্তার কাছে হাজির করতে হবে।
এদিকে, ব্যতিক্রমী ও গঠনমূলক কর্ম সম্পাদন করার এ ধরনের রায় ঘোষণার খবরে কক্সবাজার আদালত পাড়ায় বেশ কৌতুহল সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা আদালতের এমন রায়কে প্রশংসনীয় উল্লেখ করে সাধুবাদ জানান। সেই সাথে তাঁরা মনে করেন, বিজ্ঞ বিচারকের এমন রায়ে অপরাধীদের অনুসুচনা ও সংশোধনের সুযোগ তৈরি হয়েছে।