অ্যাডভোকেট জি এ এম আশেক উল্লাহঃ
কক্সবাজারে যে কয়েকজন জনপ্রতিনিধির নাম মানুষ এখনও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন তন্মধ্যে মওলানা মোখতার আহমদ অন্যতম। তিনি কক্সবাজারের ঝিলংজা ইউনিয়ন পরিষদের দুই মেয়াদে চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮৮সাল পর্যন্ত। জনগণের খেদমত,ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা,চুরি ডাকাতিসহ অসমাজিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ করে তিনি নজির সৃষ্টি করেছিলেন। শুধু তাই নয় বছর শেষে মওলানা মোখতার জনসমাবেশ ডেকে পরিষদের আয় ব্যয়ের হিসেব দিতেন। সেই হিসেব থেকে বাদ যেতনা সিকি আধুলি এমনকি পরিষদের আঙিনায় থাকা নারিকেল গাছে ডাব নারিকেল ইত্যাদি বিক্রির টাকা পয়সার হিসেবও। একারণে মওলানা মোখতার আহমদ এখনও মানুষের স্মৃতিতে ভাস্বর। একজন ত্যাগী জনপ্রতিনিধি হিসেবে এখনও মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। সেই মোখতার চেয়ারম্যানের পরে ঝিলংজাবাসী আরেকজন চেয়ারম্যান পেয়েছিলেন তিনি হচ্ছেন মওলানা আবদুল গফুর প্রকাশ গফুর হুজুর। যাঁর মাঝে ছিল মোখতার চেয়ারম্যানের ছায়া ও আদর্শ। যিনি ০২ জুন ২০২২ বৃহস্পতিবার দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে পরজগতের বাসিন্দা হয়েছেন।
আমার জীবনে খুব কাছ থেকে দেখা কয়েকজন আলেমে দ্বীনের মধ্যে মওলানা আবদুল গফুর রাহিমাহুল্লাহ একজন। তাঁর সাথে আমার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা ছিল এবং সান্নিধ্যে থেকে ওনাকে দেখেছি। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের মুসলমান,নিরলস জ্ঞানতাপস,নিষ্ঠাবান,আবেদ আলেমে দ্বীন,সমাজসেবক,এবং আল্লাহর পথে একজন একনিষ্ঠ মুজাহিদ। কথা এবং কাজে কখনও আমি তাঁর কাছে অমিল খোঁজে পাইনি। দেখা হলেই সবসময় শিশুর মতন সরল হাসিতে মুখখানি উজালা করেই জিজ্ঞেস করতেন সবকিছু। তাঁর ভদ্রতা,সততা,ন্যায়পরায়নতা এবং সুন্দর ব্যবহার আমাকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করতো। দেশের বিদ্যমান চিত্র হচ্ছে, চেয়ারম্যান হওয়ার পর অনেক নেতা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন কিন্তু মওলানা আবদুল গফুরকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর আরও জনবান্ধব হয়ে পড়েন এবং তাঁকে কাছে পাওয়া যেত খুব সহজেই। তিনি ১৯৯২ সালে বিপুল ভোটে ঝিলংজা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সফলতার সাথে। চেয়ারম্যান হয়ে তিনি এলাকার মানুষের জীবন মান উন্নয়নে কঠিন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এলাকার দরিদ্র মানুষের খবর নিতে দিনরাত ছুটে যান এঘর থেকে ওঘরে। মানুষের সুখ-দুখ যেন তাঁরই সুখ-দুখ। তাঁর কাছে কেউ কোন বিচার নিয়ে আসলে তিনি অতি দ্রুততার সাথে তা ফায়সালা করে দিতেন। এমনকি তিনি বিচারপ্রার্থীর বাড়িতে গিয়ে সমস্যা সমাধান করতেন। এতে উভয় পক্ষ খুব খুশি হতেন। একবার একটা বিচারে আমিও উপস্থিত ছিলাম। বিচারটা ছিল জমিজমা সংক্রান্ত এবং বেশ জটিল। ওই বিচারের শুনানীতে আমি ওনার ফারায়েজ আইন সম্পর্কে পান্ডিত্য দেখে আশ্চর্য হই। ওনি বিচারের বিষয়বস্তু সহজেই আমলে নিতে পারতেন। এছাড়া উভয়পক্ষকে তিনি বুঝিয়ে-সুঝিয়ে দারূণভাবে শান্ত করতে পারতেন। ফলে বিরোধ গড়াত না আদালত পর্যন্ত। আচরণে শিশুসুলভ, অত্যন্ত পরিশ্রমী, বিনয়ী এই মানুষটি ছিলেন গরীব দুঃখী মেহনতী মানুষের আস্থাভাজন বন্ধু। চেয়ারম্যানশীপ ছাড়ার পরও মানুষ তাঁর কাছে ছুটে যেতেন নানা সমস্যা নিয়ে। ছয় বছর চেয়ারম্যান থাকাকালে এবং দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার পরও কেউ তাঁর বিরুদ্ধে অসততার অভিযোগ খোঁজে পাননি কিংবা কেউ বলতে পারেননি তিনি সরকারি অর্থ বা প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়মের ব্যত্যয় করেছেন। ১৯৯৭ সালের পরের নির্বাচনে তিনি জনগণের কাঙ্খিত প্রার্থী হয়েছিলেন বটে কিন্তু ভোট ডাকাতি করে তাঁর নিশ্চিত বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হয়। তাতে তাঁর কোন আফসোস ছিলনা বরং আমৃত্যু পাশে থেকে সেবা করে গেছেন এলাকার মানুষের। ওনার সততা কর্মনিষ্ঠা ও উন্নয়নমূলক কাজের পুরস্কারস্বরূপ তাঁকে সরকারিভাবে শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যান হিসেবে স্বর্ণপদক দেয়া হয়।
তিনি ১৯৩৫ সালে চান্দেরপাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মলাভ করেন। শিক্ষাজীবনে তিনি স্থানীয় মক্তব,ছুরতিয়া আলীম মাদরাসা,চট্টগ্রামের দারূল উলুম আলীয়া মাদরাসা থেকে ১৯৬০ সালে কামিল পাশ করেন। এরপর কর্মজীবনের শুরুতে তিনি ছুরতিয়া মাদরাসায় সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং ওই মাদরাসায় পরে সুপার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি কক্সবাজার হাশেমিয়া কামিল মাদরাসায় সিনিয়র প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং ২০০১ সালে অবসর নেন। তবে খন্ডকালিন শিক্ষক হিসেবে হাশেমিয়া আলীয়া মাদরাসায় তিনি ২০১১সাল পর্যন্ত পাঠদান করেন। তিনি ছিলেন এক আধ্যাত্মিক পুরুষ। আযান হলে তিনি দ্রুত মসজিদে ছুটে যেতেন। প্রাতিষ্ঠানিক পাঠদান ছাড়াও তিনি মানুষের চরিত্র গঠনে অসামান্য ভুমিকা রেখেছেন। নিজের চিন্তা কর্ম এবং ধন সম্পদ সময় তিনি আল্লাহার রাহে উৎসর্গ করেছেন। তিনি অন্যায়ে বিরুদ্ধে প্রতিবাদি ছিলেন। কোন অন্যায় কাজ দেখলে তিনি চিৎকার দিয়ে তার প্রতিবাদ করতেন।
পারিবারিক জীবনে তিনি স্ত্রী,চার ছেলে এবং তিন মেয়ের জনক। ছেলে মেয়েদের তিনি উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন এবং সকলেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। রাজনৈতিক জীবনে তিনি ১৯৬৫ সালে জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন এবং কক্সবাজার জেলা জামায়াতের বিভিন্নস্তরে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর নামাজে জানাযায় হাজার হাজার শোকার্ত মানুষের উপস্থিতি তাঁর প্রতি মানুষের ভালবাসার প্রমাণ। জানাযার পূর্বে অনেকে সাক্ষ্য দিয়েছেন তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন ও কর্ম নিয়ে। কক্সবাজার সদর রামু আসনের সাবেক সংসদ সদস্য লুৎফুর রহমান কাজল বলেন,‘ মওলানা আবদুল গফুর জনপ্রতিনিধিদের জন্য অনুপ্রেরণা এবং অনুরকনীয় মানুষ ছিলেন। তিনি সেবাকে মানুষের ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। চেয়ারম্যানের সীল এবং প্যাড তাঁর পকেটে থাকতো । বিচারপ্রার্থীর বাসায় গিয়ে তিনি বিচার করে দিতেন। গম কিংবা সরকারি বরাদ্দ নিয়ে অনেক জনপ্রতিনিধির বদমান শুনা যায় কিন্তু মওলানা আবদুল গফুর সাহেবের বিষয়ে এখনও পর্যন্ত বিন্দুমাত্র কোন বদনাম শুনা যায়নি।’
জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল ও চট্টগ্রাম মহানগরী আমীর মওলানা মুহাম্মদ শাহজাহান বলেন,‘ তিনি শুধু হাজারো আলেমের নয়,বরং সর্বস্তরের মানুষের প্রেরণা ছিলেন। সালাত আদায়ের ক্ষেত্রে তিনি কখনও জামায়াত কাজা করতেন না। কুরআন এবং হাদীসে একজন মুমিনের যে সকল বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হয়েছে এর অধিকাংশ বৈশিষ্ট্য আমি তাঁর জীবনে দেখতে পেয়েছি। তিনি দুনিয়ায় একজন সফলকাম ব্যক্তি এবং আখেরাতেও তিনি আল্লাহর রহমত লাভ করবেন। তিনি একজন সফল জনপ্রতিনিধি ছিলেন। তাঁর কাছে কখনও অহংকার ছিলনা।’ কক্সবাজার সদর উপজেলা চেয়ারম্যান কায়সারুল হক জুয়েল বলেন,‘ মওলানা আবদুল গফুরের রাজনৈতিক আদর্শের সাথে আমার মিল ছিলনা তবুও তাঁকে আমি গভীর শ্রদ্ধা করতাম তিনি আমাকে পিতার মত স্নেহ করতেন, খোঁজ খবর নিতেন। ওনি একাধারে মাদরাসার শিক্ষক,রাজনৈতিক নেতা এবং একজন সফল জনপ্রতিনিধি ছিলেন আমি মনে করি ওনার মৃত্যুতে শুধু জামায়াতের নয়,কক্সবাজারবাসীর অপুরণীয় ক্ষতি হয়েছে।’
পরিশেষে বলতে চাই মহান আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করুন। বেহেশতের উচ্চ মাকাম তাঁকে দান করুন। তাঁর রেখে যাওয়া স্মৃতি আলোকবর্তিকা তথা অনুপ্রেরণার বাতিঘর হয়ে থাকুক অযুত- সহস্র বছর। আমীন।
অ্যাডভোকেট জি এ এম আশেক উল্লাহ
সভাপতি, সাংবাদিক ইউনিয়ন কক্সবাজার
নির্বাহী পরিচালক,
নজরুল-আব্বাস উদ্দীন সেন্টার কক্সবাজার
০৩ জুন ২০২২