জালাল আহমদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি:
আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে দেশের সর্বস্তরের মানুষের চাহিদার কথা মাথায় রেখে কাঙ্ক্ষিত বাজেট উপস্থাপন করার দাবি জানিয়েছেন দেশের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ, রাজনীতিবিদ এবং অর্থনীতিবিদরা।
আজ ৫ জুন রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে গণতান্ত্রিক বাজেট আন্দোলন এর উদ্যোগে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তারা এই আহ্বান জানান।
এবারের গণতান্ত্রিক বাজেট আন্দোলন এর প্রতিপাদ্য ছিল"সবার জন্য বাজেট,সবাই মিলে বাজেট "। দুইটি পৃথক অধিবেশনে দেশের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ, রাজনীতিবিদ এবং অর্থনীতিবিদরা বাজেট নিয়ে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন।
প্রথম অধিবেশন:
বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার ,পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম বলেছেন, "পৃথিবীর কোন দেশের উন্নতি পাঁচ বছর -দশ বছরে হয় নি। দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনার ফলে সম্ভব হয়েছে।
২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।
আমরা ধারাবাহিকভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি।
এজন্য সবার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা দরকার। আমাদের কৃষি ক্ষেত্রে বিপ্লব হয়েছে। আমাদের আমদানি নির্ভরতা কমেছে।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন কৃষি উন্নয়ন এবং গবেষণায় মনোযোগ দেন। কৃষি উন্নয়নের ফলে
আমাদের শিল্পায়ন বেড়েছে।শিল্পায়নকে গুরুত্ব দেয়া উচিত। আমি এই সমাজে বড় হয়েছি।তাই মানুষের দুঃখ -কষ্ট বুঝি।
আজ ৫ জুন রোববার দুপুর বারোটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে 'গণতান্ত্রিক বাজেট আন্দোলন' নামক সংগঠনের উদ্যোগে "জন -বাজেট সংসদ ২০২২" উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভার প্রথম অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন,
আমি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সফর করেছি। সেখানে দেখেছি মানুষ মৌলিক খাত গুলোকে
বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।
আমাদেরও মৌলিক বিষয় গুলো কে গুরুত্ব দিতে হবে।
আমাদের যেসব খাতে দুর্বলতা আছে এবং ঘাটতি আছে,সে খাত গুলো চিহ্নিত করতে হবে।
আজকের বাংলাদেশ ৪৩০ বিলিয়ন ডলারের বাংলাদেশ।সবাই সব চিন্তা করতে পারে না।সবার লিডারশিপ কোয়ালিটি এক রকম নয়। আগামী বাজেটে জাতির সকল আশা -আকাঙ্খাকে ধারণ করতে হবে।
মানুষের জীবনে প্রযুক্তির প্রভাব সম্পর্কে তিনি বলেন,প্রযুক্তি আবিষ্কারের ফলে মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের প্রাইভেট সেক্টর গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে।
সব শ্রেণী পেশার মানুষ কে বাজেটের আওতায় আনতে হবে।
একজন আইন প্রণেতাকে সঠিক আইন প্রণয়ন করতে হলে সকল মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে। তাহলে তিনি খুব সহজেই আইন প্রণয়ন করতে পারবেন।
মানুষের আকাঙ্ক্ষার কোন শেষ নেই। মানুষের সাথে মিশলে মানুষের আকাঙ্ক্ষার কথা বোঝা যায়। কোভিড -১৯ এর কারণে আমাদের অর্থনীতি অনেক পিছিয়ে পড়েছে। এজন্যই
আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে।
দৈনিক বণিক বার্তা পত্রিকার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ এর সঞ্চালনায় আয়োজিত এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন সেন্টার অন বাজেট এন্ড পলিসি এর চেয়ারম্যান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ।
সভাপতির বক্তব্যে তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তার সুযোগ্য
কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোনার বাংলা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন। আমাদের কে সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
সরকার আগামী বাজেটে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবে। তিনি আরো বলেন, একটা দেশের
উন্নয়ন শুধু জিডিপি দিয়ে হয় না। এবারের বাজেট নির্বাচনী বাজেট। রাজনৈতিক সরকারের বিভিন্ন কৌশল থাকে। আমাদের দেশের তরুণেরা বিদেশে পড়াশোনা করতে গেলে দেশে আসতে চায় না।তারা বিদেশে থেকে যায়। এজন্যই আমাদের দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা দরকার।
এ সময় আরো বক্তব্য রাখেন ডিবিএম এর সহ-সভাপতি আমানুর রহমান,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর এম এম আকাশ প্রমুখ।
এ সময় ডিবিএমের কক্সবাজার, সাতক্ষীরা, রাজশাহী জেলার প্রতিনিধিরা তাদের নিজ নিজ জেলার অর্থনৈতিক দুরবস্থা তুলে ধরে জেলা ভিত্তিক বাজেট দাবি করেন।
অনুষ্ঠানে সমাজের দলিত সম্প্রদায়, নারী, ছাত্র, গার্মেন্টস শ্রমিক প্রতিনিধিরা সমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ বাজেট দাবি করেন।
দ্বিতীয় অধিবেশন:
অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ডক্টর
শামসুল আলম বলেছেন, "২০০৯ বাংলাদেশে কারিগরিতে দক্ষ লোকের সংখ্যা মাত্র ৩% আর এখন ১৮% । ব্যবসা -বাণিজ্য সচল থাকলে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে রাখা যায় ।সমাজে মূল্যস্ফীতি তৈরি হয় অর্থনৈতিক কারণে নয়, ব্যবসায়িক কারণে। বাংলাদেশে প্রথম শেখ হাসিনার সরকার সামাজিক সুরক্ষা কৌশলপত্র প্রণয়ন করেছে । আমি নিজেই এই কৌশলপত্র তৈরিতে যুক্ত ছিলাম। যেমন বিধবা ভাতা ,বয়স্ক ভাতা , মহিলা ভাতা ইত্যাদি সামাজিক সুরক্ষা কৌশল পত্রে যুক্ত করা হয়। দু:স্থ এবং পঙ্গু জনগোষ্ঠী কে জীবন ব্যাপী সহায়তা দেওয়া হয়।
তিনি আরো বলেন, " আমাদের দেশে ৮৫% লোক বেসরকারি চাকরি খাতে যুক্ত। তাদের জীবন-যাত্রার কথা ভাবতে হবে। যেখানেই চাকরি করুক না কেন ,তাদের জন্য যেন কিছু সঞ্চয় থাকে।
বাংলাদেশে এক কোটি লোককে ১০ টাকার খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয় । এজন্যই সামাজিক সুরক্ষা খাতে অনেক টাকা ব্যয় করতে হয়।
দলিত সম্প্রদায় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভারতের সংবিধানে দলিত সম্প্রদায়ের কথা স্পষ্ট উল্লেখ আছে। বাংলাদেশের সংবিধানের দলিত সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ নাই। এখানে ২ জন সংসদ সদস্য (শামীম হায়দার পাটোয়ারী এবং রুমিন ফারহানা) উপস্থিত আছেন। তারাও বলতে পারবেন না যে বাংলাদেশের সংবিধানে দলিত সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ আছে। এজন্যই তাদের জন্য আলাদা কোন কিছু করার সুযোগ নেই।
পদ্মা সেতু এবং মেট্রোরেল আমাদের দেশের গেম চেঞ্জার মেগা প্রজেক্ট বলে তিনি দাবি করেন।
সুশীল সমাজের সমালোচনা করে তিনি বলেন "দেশের সুশীল সমাজের মধ্যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে কোন আগ্রহ নেই।
শুধু বাজেট নিয়ে তাদের আগ্রহ।
বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা: রশীদ ই মাহবুব এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই অধিবেশনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)'র সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেছেন, সংসদে যখন বাজেট নিয়ে আলোচনা করা হয়, তখন সরকারী দলের এমপিরা বাজেটের প্রশংসা এবং বিরোধীদলের সংসদ সদস্যরা বাজেটের বিরোধিতা করে। কিন্তু বিরোধী দলের এমপিদের কথা সরকারের কানে পৌঁছায় না।
শুভংকরের ফাঁকি দিয়ে সাধারণ মানুষকে সন্তুষ্ট রাখা যায় না ।
কোন সরকার যদি ভোট ছাড়াই ক্ষমতায় থাকে, তাহলে তার কাছ থেকে গণতান্ত্রিক বাজেট আশা করা যায় না।
আলোচনা সভায় জাতীয় পার্টির অতিরিক্ত মহাসচিব , গাইবান্ধা -১ সুন্দরগঞ্জ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেছেন, "আমাদের বাজেটে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ বরাদ্দ দরকার। এখানে জনগণের মালিকানা নেই। মালিকানা ব্যবসায়ী ও আমলাদের।যারা ক্ষমতার ভিতরে থাকে , বাজেট তাদের জন্য।যারা দরিদ্র তারা বাজেট থেকে ছিটকে পড়ছে। তিনি আরো বলেন আমার এলাকায় শতভাগ বিদ্যুৎ। কিন্তু বিদ্যুৎ কম থাকে ।
তাহলে লাভ কি? এজন্যই সবকিছুতেই
সরকারের সদিচ্ছা দরকার।
অনুষ্ঠানে শ্রম বাজেট ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রতিনিধি নাজমা ইয়াসমিন শ্রমিকদের বাজেট সম্পর্কে বলেন, শ্রমজীবীদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য তাদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের পেনশন , স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে।
এ সময় দলিত সম্প্রদায়ের পক্ষে তাদের প্রতিনিধি বিভূতোষ রায় বলেন, আমাদের আবাসস্থল নেই, চাকরি নেই। সন্তানদের শিক্ষিত করার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোটা চাই । পড়াশোনার পর সরকারী চাকরীতেও কোটা দরকার।
এ সময় নারী, বেকার যুবক, প্রতিবন্ধী শ্রেণীর প্রতিনিধিরা বাজেটে তাদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দেওয়ার জন্য দাবি জানান।