জিয়াবুল আলম
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর যখন মানবতার কল্যাণে যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্হান নিয়ে ১৯২০ সালে জাতিপুঞ্জ গঠন করেছিল, তখন সমগ্র জাতির মনে করছিল বোধহয় মানবতার জয় অনিবার্য। তবে সেই ধারণা ছিল হিতে বিপরীত । কারণ জাতিপুঞ্জ যে উদ্দেশ্যে নিয়ে গঠিত হয়েছিল, সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। জাতিপুঞ্জ গঠনের মাত্র কয়েক বৎসরের মধ্যে অক্ষর শক্তি ও মিত্র শক্তির ক্ষমতা প্রদর্শন সহ সাম্রাজ্যে প্রভাব বিস্তার ঘটানোর জন্য ১৯৩৯ সালের দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে বিশ্ব মানবতার উপর খড়গ পড়েছিল ।
পরবর্তীতে ১৯৪৫ সালের আগষ্ট মাসে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসিকা শহরে বিভীষিকাময় পারমাণবিক বোমা হামলায় ব্যাপকহারে মানব হত্যা সমগ্র বিশ্ব জাতির বিবেকে নাড়া দেন। যার পরিপেক্ষেতে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার বাণী নিয়ে ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ গঠন করা হয়। জাতিসংঘ গঠন হলেও জাতিসংগের মানবাধিকার সনদ রচিত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে।এই মানবাধিকার সনদ রচনার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্ব ভেবেছিল বোধহয় ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের যে মূল মন্ত্র" সাম্য, মিত্র এবং স্বাধীনতা"এই বাণী কয়েকশ বৎসর হলেও সমগ্র বিশ্বে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। কিন্তু বাস্তব গুড়ে বালি ছাড়া আর কিছু নয়। কারন ফিলিস্তিনে ইসরায়েল কতৃক ব্যাপক আগ্রসন এবং সমগ্র পৃথিবীতে জাতিগত নিপীড়ন এবং গণহত্যা কোনটিই সমাধান করতে পারেনা। সর্বশেষ ২০১৭ সালে মিযানমার সেনাবাহিনী কতৃক রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত এবং গণহত্যা কোনটিই রোধ করতে পারেনি।
দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্র একটি রাষ্ট্র বাংলাদেশ। জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে অষ্টম স্হানে এই দেশের অবস্থান। এমনিতে জনসংখ্যার ভারে নুয়ে পড়েছে এই দেশ। সে খানে ২০১৭ সালে মায়েনমার সেনাবাহিনী কতৃক বাস্তুচ্যুত সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীর ভার বহন করা বাংলাদেশের জন্য এক মহা হিমালয় বিজয়ের মত দুষ্কর হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠীর উন্থান সহ মাদকের ব্যাপক বিস্তার ও আইন শৃঙ্খলা চরম অবনতির জন্য উখিয়া টেকনাফ বাসী রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরকে দায়ী করেছে। এই ভাবে চলতে থাকলে উখিয়া টেকনাফ বাসীর অবস্হান ফিলিস্তিন হতে বেশি সময় লাগবেনা।
অত্যান্ত দুঃখের বিষয় যে, বিশ্ব মিডিয়া যে ভাবে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কতৃক রোহিঙ্গাদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে যে ভাবে সোচ্চার ছিল, বর্তমানে সে ভাবে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে সোচ্চার নয়।২০১৮ ও ২০১৯ সালে প্রত্যার্তনের জন্য দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হলেও সে আশার আলো যেন ফিকে হতে বসেছে। সর্বশেষ আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের জন্য জাতিসংঘের ৫ দফা প্রস্তাব দেওয়া হয়ে হয়েছিল, সে ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আফ্রিকা ইউনিয়ন সহ বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠন ও মুসলিম বিশ্বের অন্যতম সংগঠন ওআইসি রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করলেও, এই চাপে তারা মোটেই শঙ্কিত নয়। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে জাতিসংঘে শুরুর দিকে আলোচনা করা হলে, এই ব্যাপারে আমাদের সবচেয়ে বন্ধু রাষ্ট ভারত ও চীন নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ।
এই নীরবতার আশ্রয় নিয়ে ভারত ইতিমধ্যে মায়ানমারের সাথে কালাদান প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে সেভেন সিষ্টারে প্রবেশ করার জন্য বিকল্প পথ তৈরী করেছে।মূলত সেভেন সিস্টার্স এর কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ভারতকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম-ইন্ডিপেন্ডেন্ট (উলফা-আই) ও ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ডের (এনএসসিএন) মতো বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত। এ সংগঠনগুলো সাধারণত মিয়ানমার সীমান্ত বা দেশটির ভেতর থেকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। সম্প্রতি তাদের তৎপরতা কিছুটা হ্রাস পেলেও ভূরাজনৈতিক সমীকরণ পরিবর্তন হলে সংগঠনগুলো নতুন উদ্দীপনায় জেগে উঠতে পারে। ভারত মনে করে, মিয়ানমারের সাথে কালাদান প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে মিজোরাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে থাকবে।তাই এই কালাদান প্রকল্পের স্বার্থ ভারত কৌশল অবলম্বন করে রোহিঙ্গা সংকট তাদের অভ্যান্তরীণ বিষয় বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। জাতিসংঘের ভেটো দান কারী আমাদের বন্ধু রাষ্ট রাশিয়া ও চীন নীরব। কিন্ত আন্তর্জাতিক ভেটো দান কারী পাচটি রাষ্ট্রের মধ্যে কয়েকটি রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ভূ রাজনৈতিক কারণে এক হতে না পারার কারণে এই সমস্যা নিরসন করা সম্ভব হবে বলে মনে হয়না।
বিশেষ করে চীন রাষ্ট্র তাদের স্বার্থেের কারণে ভারতেে মত তারাও এই ইস্যু সব সময় এড়িয়ে চলছে। এখানে চীনের প্রধান স্বার্থ দুটি। এর একটি হলো অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার পক্ষে তাদের চিরাচরিত পররাষ্ট্রনীতি - যার পাশাপাশি চীন চায় যে তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারেও অন্য কোন দেশ হস্তক্ষেপ না করুক।
"আর অপরটি হচ্ছে, তাদের কৌশলগত ও বাণিজ্যিক স্বার্থ - যার মূল কথা: তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও তেল-গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য মালাক্কা প্রণালী ছাড়াও মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে আরেকটি স্থলপথকে অক্ষুণ্ণ রাখা।"
তবে চীনে তাদের এই অবস্থান ফিরে আসার জন্য আমাদের কূটনীতিক তৎপরতা বাড়ানো উচিত। কারণ বাংদেশ যখন জাতিসংঘের সদস্য লাভ করার জন্য আবেদন করেন, তখন চীনের ভেটোর কারণে আমরা প্রথমদিকে সদস্যা লাভ করতে পারেনি। পরবর্তী কূটনীতিক ব্যাপক তৎপরতার কারণে চীনে তাদের পূর্বের অবস্হান থেকে সরে এসে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্হান করেন জাতিসংঘে বাংলাদেশেকে স্বীকৃতি দান করেন । তবে ১৯৭০ সালের পরবর্তী ভূ রাজনীতি এবং বর্তমান ভূ রাজনৈতি পাল্টে গেছে। চীন তাদের উপরোক্ত বর্ণিত স্বার্থের কারণে তাদের অবস্হান থেকে সরে আসবে মনে হয়না।চীন যদি তাদের অবস্থান থেকে সরে না আসে, আমাদের পক্ষে রোহিঙ্গা সংকট নিরসন কঠিন হয়ে পড়বে।
এর পরেও আশাহত হওয়া উচিত নয়। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ কতৃক স্বীকৃত সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ এবং ‘রেসপনসিবিলিটি টু প্রটেক্ট’ বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তথা নিরাপত্তা পরিষদের বাধ্যবাধতাকতা বাস্তবায়নে সম্মান্বিত উদ্যােগ নিলে সংকট নিরসন করা সম্ভব। তবে বাংলায় প্রবাদ হচ্ছে বিড়ালের গলায় ঘন্টা ঝুলিয়ে দিবে কে ? বিড়ালের গলায় যাদের মাধ্যমে ঘন্টা ঝুলানোর পরিকল্পনা করেছি, তারা বিড়ালের মহা মিত্র। আর রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবর্তন করা না গেলে উখিয়া টেকনাফ বাসী ভবিষ্যতে কঠিন সংকটে পতিত হবে। যে খানে থেকে কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবেনা। তাই সময় থাকতে উদ্যাগ গ্রহন করে যে কোন পণ্থায় রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবর্তনের ব্যাবস্হা গ্রহন করা হউক।
জিয়াবুল আলম ,চট্টগ্রাম জেলা জজ আদালত