# ১১৮ জনের মৃত্যু, রোহিঙ্গা ৬১
ইমাম খাইর, সিবিএন:
কক্সবাজারে হঠাৎ বাড়ছে যৌনবাহিত রোগ এইডস/এইচ.আই.ভি. (মানব প্রতিরক্ষা অভাব সৃষ্টিকারী ভাইরাস) সংক্রমণ। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে এইডস রোগীর সংখ্যা নিয়ে শঙ্কিত জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ। রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। যুবক, যুবতিরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে এই রোগে।
বুধাবার (৬ জুলাই) কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের রেজিস্ট্রার থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সাল থেকে এই পর্যন্ত ৭১০ জনের এইচ.আই.ভি. শনাক্ত হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে সদর হাসপাতালের আওতায় ৫০৫ জন ও উখিয়ায় ২০৫ জন চিকিৎসাধীন। শুধু গত এক মাসে এইচআইভি রোগি ধরা পড়েছে ১১ জন।
এইচআইভি আক্রান্ত হয়ে ২০১৫ সাল থেকে এই পর্যন্ত ১১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। সেখানে ৬১ রোহিঙ্গা এবং ৫৭ জন স্থানীয় বাসিন্দা। মোট আক্রান্ত ৭১০ জনের মধ্যে ৬১২ জন রোহিঙ্গা। বাকি ৯৮ জন স্থানীয় বাসিন্দা।
এইচআইভি মানুষের দেহে রোগ-প্রতিরোধের ক্ষমতা বা প্রতিরক্ষা তথা অনাক্রম্যতা হ্রাস করে। এর ফলে একজন এইডস রোগী খুব সহজেই যে কোনও সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যু ঘটাতে পারে।
এইচআইভি-এইডস নিয়ে কাজ করা এনজিও ও কক্সবাজার সদর হাসপাতালের এইচআইভি ট্রিটমেন্ট সেন্টার সূত্রে পাওয়া গেছে ভয়াবহ চিত্র।
তথ্য মতে, কক্সবাজারে ভয়াবহভাবে বিস্তার ঘটছে মরণব্যাধি এইডসের। বিশেষ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে এইডস রোগের বিস্তার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয়রাও রয়েছে এইডস ঝুঁকিতে। পেশাদার-অপেশাদার যৌনকর্মী ও মাদকাসক্তদের অবাধ যৌনাচারের কারণে বর্তমানে জেলায় এইডস আক্রান্তের সংখ্যা ৭১০ জন। সঠিক তথ্যানুসন্ধান করলে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে।
জরিপ যাই হোক, কক্সবাজার যে ভয়াবহ এইডস ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এ নিয়ে কারও দ্বিমত নেই। কারণ, প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে ৩২ শতাংশ যৌনকর্মী এইডস রোগে আক্রান্ত। কক্সবাজারের সর্বত্র এখন মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ছড়াছড়ি।
কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ও এইচআইভি ফোকাল পারসন ডাঃ আশিকুর রহমান বলেন, ২০১৫ সাল থেকেই কক্সবাজার সদর হাসপাতালে এইচআইভি বা এইডস স্ক্যানিংয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। যেখানে এইডস নির্ণয়, কাউন্সিলিং ও চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের বাইরে যারা আছেন, তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসার আওতায় আনার বিষয়ে আমরা কাজ করছি। গত ৬ জুলাই পর্যন্ত ৭১০ জনের শরীরে এইচআইভি ভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে। হিজড়ার শরীরেও এইচআইভির জীবাণু পাওয়া গেছে। এ রোগে আক্রান্ত ৬১ রোহিঙ্গাসহ ১১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
তবে মারা যাওয়া ছাড়া এইডস আক্রান্ত জীবিতরা কে, কোথায়, কোন অবস্থায় আছে তার কোনো হিসাব সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে নেই।
ডাঃ আশিকুর রহমান বলেন, আমাদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। ভিন্ন রোগ নিয়ে আসছে। চিকিৎসা পরীক্ষায় ধরা পড়ছে এইচআইভি।
এইডস/এইচআইভি প্রতিরোধে জেলা সদর হাসপাতালে নানা উদ্যোগ ছাড়াও মাঠপর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে উখিয়া ও টেকনাফে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার ১২টি টিম কাজ করছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, কক্সবাজার এইডসের জন্য এখন বিপদজনক এলাকা। রোহিঙ্গারা যে হারে এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে সে তুলনায় শনাক্ত করা হচ্ছে কমই। প্রকৃত অর্থে আক্রান্তের সংখ্যা আরো অনেক বেশি।
কক্সবাজারের বিভিন্ন হোটেল, মোটেল ও গেস্ট হাউসে ৫ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা তরুণীর যাতায়াত। তারা অনিরাপদভাবেই দেশি-বিদেশি পর্যটক ও স্থানীয়দের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করছে। শহরের লালদিঘী পাড় কেন্দ্রিক কিছু আবাসিক হোটেলে পতিত-খদ্দেরের অবাধ যাতায়াত। এতে কক্সবাজারে এই রোগ ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। রোহিঙ্গা যৌনকর্মী ছাড়াও পর্যটন শহর হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে টাকা আয়ের উদ্দেশ্যে যৌনকর্মীদের ব্যাপকহারে কক্সবাজার আগমনও এইডস বিস্তারের আরেকটি অন্যতম কারণ।
ভাসমান যৌনকর্মী ছাড়াও প্রবাসী অনেকেই এইডস আক্রান্ত হয়ে দেশে ফিরছেন। যাদের অনেকেই বিদেশে অবস্থানের সময় সেখানকার যৌনকর্মীদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করে এসব রোগ দেশে বহন করে এনেছে। এইচআইভি সংক্রামক রোগ হওয়ায় এসব ব্যক্তির কারণে তাদের স্ত্রীদেরও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
এইচআইভি নিয়ে কাজ করা এনজিওদের কাছ থেকে জানা গেছে, বর্তমানে জেলায় রোহিঙ্গা ছাড়াও স্থানীয় ২ হাজারের মতো যৌনকর্মী রয়েছেন। যাদের বেশিরভাগের এইচআইভি সম্পর্কে স্বচ্ছ কোনো ধারণা নেই। ফলে তাদের মধ্যে কতজনের শরীরে এইচআইভি ভাইরাস রয়েছে তা জানা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়াও সমকামীদের বিষয়টি অনেকেই জানে না অথবা জানলেও লজ্জায় অনেকেই মুখ খুলে না বলেও জানা যায়।
জনস্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এইচআইভির বিস্তারের নেপথ্যে রয়েছে অসচেতনতা। রয়েছে সামাজিক নানা কুসংস্কার। এসব মিলে পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। অন্য সব রক্ষণশীল সমাজের মতোই কারো দেহে এইচআইভি পাওয়া গেলে তাকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে।
তাদের ভয়, ওই ব্যক্তির দেহ থেকে এইচআইভি ছড়াতে পারে। আবার যাদের দেহে এই ভাইরাস পাওয়া গেছে তারা চিকিৎসা নিতে গড়িমসি করে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (উপসচিব) মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা বলেন, জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য অনেক সংস্থা কাজ করছে। বেশ কিছু এনজিও এইচআইভি তথা যৌন সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কর্মসূচিও চালাচ্ছে।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।