ডেইলি স্টার: গত শুক্রবার রাতের দুঃসহ স্মৃতি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না দিপালী রাণী সাহা। সেদিন চোখের সামনে নিজের বাড়িঘর আগুনে ধ্বংস হয়ে যেতে দেখেছেন তিনি।

‘একদল লুট করে চলে যাওয়ার পর আরেকদল লুট করতে এসে কিছু না পেয়ে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়,’ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন তিনি।

হামলার সময় বড় ছেলে গোবিন্দ সাহাকে নিয়ে খাটের নিচে লুকিয়ে ছিলেন ৬২ বছর বয়সী দিপালী।

নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া সাহাপাড়ায় দিপালী সাহার বাড়িসহ ৩ বাড়ি ও কয়েকটি দোকান ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার
‘যে ঘরটিতে আমরা লুকিয়ে ছিলাম সে ঘরটির দরজা ভাঙতে না পেরে হামলাকারীরা পাশের বাড়ির মন্দিরে হামলা করে প্রতিমা ভেঙে দেয়।’

সেই রাতে নড়াইলের দিঘালিয়া ইউনিয়নের সাহাপাড়া গ্রামের দিপালীর বাড়িসহ ৩ বাড়ি ও কয়েকটি দোকান ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে এই হামলা হয়। ১৮ বছর বয়সী কলেজ শিক্ষার্থী আকাশ সাহা ফেসবুকে ওই পোস্ট করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

হামলাকারীরা শুক্রবার জুমার নামাজের পর থেকেই জড়ো হতে থাকেন এবং গ্রেপ্তারের দাবিতে ওই শিক্ষার্থীর বাড়ির সামনে বিক্ষোভ করেন।

আকাশকে না পেয়ে তারা প্রতিবেশী, যারা ফেসবুক পোস্ট সম্পর্কে কিছুই জানেন না তাদের বাড়ির সামনে ছড়িয়ে পড়তে থাকেন।

আকাশের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার প্রস্তুতি চললেও সেদিন বিকেলে ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে’ আনতে আকাশের বাবা অশোক সাহাকে আটক করে পুলিশ।

যদিও হামলাকারীদের কাউকেই এখন পর্যন্ত আটক করা হয়নি।

গতকাল শনিবার দুপুরে পোড়া বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বিলাপ করছিলেন দিপালী।

৮ মাস বয়সী নাতনি রাই সাহাকে কোলে নিয়ে তিনি বলেন, ‘এমনকি নাতনির খেলার পুতুলগুলোও হিংসার হাত থেকে বাঁচেনি।’

‘ওই ছাত্র হিন্দু। আমিও হিন্দু। শুধুমাত্র এই কারণে আমার বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’

‘এই সহিংসতা কত দিন আমাদের তাড়িয়ে বেড়াবে আমি জানি না। কার কাছে বিচার চাইবো? কে জীবনের নিরাপত্তা দেবে? হামলার সময় আমাকে যদি সামনে পেতো তাহলে নিশ্চিত মৃত্যু ছিল আমার। ভগবান আমাকে বাঁচিয়েছেন। কিন্তু, এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়? আমার পরনের এই শাড়িটা ছাড়া এখন আর কিছুই নেই।’

গত শুক্রবার রাতে ভয়াবহ হামলার পর শনিবার সকাল থেকে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অনেকে গ্রামটিতে এসে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে আশ্বাস দিচ্ছেন।

তবুও আশ্বস্ত হতে পারছেন না দিপালী।

নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া সাহাপাড়ায় দিপালী সাহার বাড়িসহ ৩ বাড়ি ও কয়েকটি দোকান ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার
একটু দূরে বসে বিদেশ থাকা আত্মীয়দের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলেন তার ছেলে। কাঁদতে কাঁদতে লুট হওয়া জিনিসপত্রের বর্ণনা দিচ্ছিলেন তিনি। হামলার রাতে তার স্ত্রী চন্দ্রা সাহা বাড়িতে ছিলেন না। গতকাল সকালে ফিরে এসে ধ্বংসস্তূপ দেখে বিমর্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি।

‘আমি এখানে আমার সন্তানদের নিয়ে থাকতে চাই না। আমি হামলার শিকার হতে চাই না,’ বলেন তিনি।

এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হলেও এখনো অনিরাপদ বোধ করছেন সেখানকার বাসিন্দারা।

হামলার পর থেকে এলাকাটি প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছে।

স্থানীয় দিঘলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনের সাবেক মহিলা সদস্য বিউটি রানী ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘দিঘলিয়া গ্রামে প্রায় ৩০০ পরিবারের বাস। তার মধ্যে ১০৮ হিন্দু পরিবার সাহা পাড়ায় থাকেন। হামলার পরে জীবন বাঁচাতে সেসব পরিবারের সদস্যরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। অধিকাংশ বাড়ির দরজা তালাবদ্ধ। কিছু পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তিরা বাড়িতে আছেন, তারাও ভীতি-সন্ত্রস্ত।’

গতকাল দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, সাহাপাড়ার অধিকাংশ বাড়িতেই কেউ নেই। একটি বাড়িতে বয়োজ্যেষ্ঠ ২জন আছেন। তাদের মধ্যে একজন ৬৫ বছর বয়সী স্থানীয় রাধা গোবিন্দ মন্দিরের সভাপতি শিবনাথ সাহা।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘গ্রামে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। কিন্তু, আমরা তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারছি না। বিকেলে অশোককে আটক করার পর থানার ওসি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমাদের নিরাপত্তার জন্য অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনের কথা বলেছিলেন। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ এসে সাহা পাড়ায় হামলা চালায়। হিন্দুদের বেছে বেছে মারধর করে।’

নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া সাহাপাড়ায় দিপালী সাহার বাড়িসহ ৩ বাড়ি ও কয়েকটি দোকান ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার
পুলিশের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ বিউটি রাণীর। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘যখন গ্রামে একের পর হিন্দু পুরুষদের মারধর করা হচ্ছিল, তখন পুলিশ ছিল। তারা দূরে থেকে দেখছিল। কাউকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি। পুলিশের ওপর আর আস্থা রাখা যায় না। গ্রামের মানুষ তাই এলাকা ছেড়েছে।’

দিঘলিয়া বাজারের সার ব্যবসায়ী গোপাল সাহা তার ওপর হামলার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘আমি ২২ বছর ধরে এই বাজারে ব্যবসা করছি। আমাকে মারধরের একমাত্র কারণ ছিল আমি হিন্দু। ওই ছেলেটির বাড়ি আমার বাড়ি থেকে অনেক দূরে। এ কেমন দোষ আমার? একজন হিন্দু হিসেবে আমি এই গ্রামে আর নিরাপদ বোধ করি না।’

দিঘলিয়ার ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আজগর আলী বলেন, ‘আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেছি। শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা যায় কি না, পুলিশ এই ব্যাপারে আলামত খতিয়ে দেখছে।’

হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সরকারের পক্ষ থেকে ২৬ হাজার টাকা এবং যেসব ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে সেগুলো সরকারি খরচে মেরামত করে দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

লোহাগাড়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হারান চন্দ্র পাল ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘হামলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তবে, এই ঘটনায় কাউকে এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি বলে জানান তিনি।