জিয়াবুল আলম
বাংলাদেশের একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র । একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট তখনই সফল হবে, যখন জাতীয় স্বার্থে সকল জাতি ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করবে। যেটি করতে পেরেছিল বিশ্ব নবী রাসূল সাঃ ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা থেকে মদিনা হিজরতের পর ৪৭ অনুচ্ছেদ বিশিষ্ট যে সনদ প্রণয়ন করেছিল সেখানে। যে সনদের মধ্যে একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনা স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে ।যে চেতনার উপর ভিত্তি করে তৎকালীন মদিনার সকল উম্মাহ জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ছিল। যদিও অনেক আধুনিক রাষ্ট চিন্তাবিদরা মদিনা সনদকে পাশ কাটিয়ে ১৭৭৬ সালের আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা কিংবা ১২১৫ সালের ম্যাগনাকাটা কিংবা ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের মূল মন্ত্রকে অসাম্প্রদায়িক চেতনা কিংবা মানব মুক্তির সনদ হিসাবে উল্লেখ করে থাকেন। কিন্ত তার বহু আগে অসাম্প্রদায়িক চেতনার উপর ভিত্তি করে মদিনা সনদের রচনা হয়েছিল। যাইহোক মূল কথা হল, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সংবিধানের ৮ নাম্বার অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গনতন্ত্র এবং ধর্ম নিরপেক্ষ আদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা ছিল আমাদের মূল লক্ষ্য। কিন্ত অপ্রিয় হলে সত্যি যে, ১৯৪৭ সালে থেকে বর্তমান সময় কাল পর্যন্ত রাজনীতিতে ঠিকে থাকার জন্য সবাই ধর্মকে অপব্যাবহার করেছে। কেউ ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য, আবার কেউ ক্ষমতায় আসার জন্য। তবে তাদের অসৎ উদ্দেশ্য সাময়িকের জন্য সফল হলেও কেউ ধর্ম ব্যাবহার করে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে পারেনি।
গত কিছুদিন আগে হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজায় কুমিল্লার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়, সেটি আমাদেরকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। কারণ ১৯৭১ সালে যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মানে যে স্বপ্ন দেখেছি, সেটি কি আজকে অমাবস্যার চাদ হতে বসেছে? কেন স্বাধীনতার ৫০ বৎসর পর একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মান করতে পারলাম না? এর কারণ কি? বারবার কেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা?
এসবের কারণ যদি আমরা অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখি, মূলত রাজনীতিতে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী কিংবা ক্ষমতায় আসার জন্য ধর্মকে পূজি হিসেবে ব্যাবহার করেছে। যেমন ১৯৪৭ সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে যখন বিট্রিশ বিরোধী আন্দোলন শুরু করল, তখন বিট্রিশরা আমাদের জাতীয় ঐক্যের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করার জন্য সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যাবহার করেছে। শুধু এখানে শেষ নয়,এদেশের জনতা যখন আইব বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলেছে,তখনও সাম্প্রদায়িকতাকে পূঁজি হিসাবে ব্যাবহার করেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে-ও রাষ্ট্র ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা লক্ষ্যে সেই ধর্মীয় অস্ত্র ব্যাবহার করেছে বারবার।।।
অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অন্যতম আরেকটি কারন হিসাবে চিহ্নিত করতে পারি বাংলাদেশের আইনের দুর্বলতাকে। কারন আমাদের দেশে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এর বিরুদ্ধে যে আইনের বিধান সেটি খুবই প্রাচীন। ১৮৬০ সালের দন্ডবিধির ২৯৫ থেকে ২৯৮ ধারায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের যে শাস্তি সেগুলো খুবই লঘু। যদিও বর্তমানে আফগানিস্তান, অস্ট্রিয়া, অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান, সোমালিয়া, মালয়েশিয়াতে সহ অনেক দেশে ব্লাসফেমি আইন চালু রয়েছে। তাদের আদলে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তৈরি করা হয়েছে, সেখানে প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বা ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত করার শাস্তি আরও বাড়ানো হয়েছে।
এই আইনের ২৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ কোন কিছু প্রকাশ, সম্প্রচার, ওয়েবসাইট বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রচারের মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কারো ধর্মীয় বিশ্বাস বা মূল্যবোধে আঘাত করেন, তাহলে সেটা একটা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।
এ ধরণের অপরাধ করলে অনূর্ধ্ব সাত বছরের কারাদণ্ড এবং অনূর্ধ্ব ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।
তবে কেউ যদি দ্বিতীয়বার একই ধরণের অপরাধ করেন, তাহলে তার অনূর্ধ্ব ১০ বছরের কারাদণ্ড, ২০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে। কিন্ত এই আইনে প্রয়োগ হয় শুধু মাত্র ধর্মীয় অনুভূতি আঘাতে উদ্দেশ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার ছড়ানো হলে। তবে কোন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার না করে, সেই ক্ষেত্রে পূর্বউক্ত ধারা অনুসারে মামলা করা যায়না।এই ক্ষেত্রে দন্ড বিধির ২৯৫/২৯৬/২৯৭/২৯৮ /৫০৫ ধারার অপরাধের যে বিধান, সেটি অনুসরণ করতে হয়। কিন্ত এই আইনের শাস্তি খুবই লঘু হওয়ার কারণে এই ধরণের শাস্তিকে অপরাধীগণ তেমন ভয় পায় না। তাই পাকিস্তানের মত সকল সাম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের শাস্তি মৃত্যু দন্ডের পাশাপাশি দেশের জন সাধারণকে নৈতিক এবং ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করলে সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতা রোধ করা সম্ভব। উল্লেখ্য যে পাকিস্তানে শুধু মাত্র একটি জাতির ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করা হয়েছে। তবে আমাদের দেশে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের আইন পাশের ক্ষেত্রে সংবিধান ২৭ অনুচ্ছেদ অনুসরণ করা যেতে পারে। তাই সংবিধানের ২৭/৩৯/৪১ অনুচ্ছেদ অনুসারে আইনের সুশাসন নিশ্চিত করণ সহ এবং রূপকল্প ৪১ বাস্তবায়নের জন্য সকল সাম্প্রদায়িক অপশক্তি রুখে দিয়ে জাতীয় স্বার্থে সমস্ত জনগোষ্ঠী ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের মত ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করলে, দ্রুত স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মান সম্ভব ।তাই আসুন সাম্প্রদায়িকতা রুখে সবাই ঐক্যবদ্ব ভাবে সোনার বাংলাদেশ বিনির্মান করি। পরিশেষে সকল প্রকার অশুভ শক্তি বিনাশ হউক এবং সোনার বাংলাদেশ বিনির্মিত হউক।
লেখক: আইনজীবী( চট্টগ্রাম জেলা জজ আদালত)