আবদুর রহমান খান

একজন আজীবন যোদ্ধা। বয়স এখন সাতাত্তর বছর। নাম তার লুলা। পুরো নাম লুইজ ইনাসিউ লুলা ডি সিলভা। বিশ্বের জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতাদের অন্যতম লুলা ডি সিলভা গত ৩০ অক্টোবরে সাধারন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন কট্টর দানপন্থী প্রেসিডেন্ট জাইর বোসোনারোকে পরাজিত করে ব্রাজিলের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন । আগামী পহেলা জানুয়ারীতে তার দায়িত্ব গ্রহনের কথা ঘোষনা করেছেন লুলা।

লাটিন আমেরিকান দেশ ফুটবল আর সাম্বা নাচের জন্য খ্যাত ব্রাজিলের দরিদ্র পরিবারের সন্তান লুলা । পরে বাম-পন্থী ট্রেড ইউনয়ন নেতা এবং অবশেষে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে পরপর দূ’ দফায় ২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন। দেশটির সংবিধান অনুযায়ী টানা তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করা যায় না বলে লুলাকে সরে দাড়াতে হয়েছে। ক্ষমতা ছাড়ার সময়ও লুলার জনসমর্থন ছিল শতকরা আশি ভাগ।

লুলা ডি সিলভা টানা আট বছর প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তার উদ্ভাবনী চালিকা শক্তি এবং সম্মহোনী নেতৃত্বের ফলে দেশটির অর্থনীতি ও ব্যাবসা-বানিজ্যে ব্যাপক উন্নতি ঘটে । শ্রমিকদের মজুরী বাড়ানো হয় এবং সাধারন মানুষদের জন্য নানাবিধ কল্যানমূলক কর্মসূচী চালু করা হয়। অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির কারণে লক্ষ লক্ষ দরিদ্র পরিবার মধ্যবিত্তের কাতারে উন্নীত হয়।

লুলার ক্ষমতা ত্যাগের পর তার সমর্থিত দলীয় নেত্রী ডিমলা রুসেফ ২০১৪ সালে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এ সময় ল্যাটিন আমেরিকায় মার্কিন সমর্থিত ধনিক লুটেরা শ্রেনী বামপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র শুরু করে। আর্থিক অব্যাবস্থাপনা এবং নানা দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয় ডিমলা রুসেফ সরকারের বিরুদ্ধে । অতঃপর ২০১৬ সালে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে পতন ঘটে ডিমলা রুসেফ সরকারের।

২০১৭ সালের জুলাই মাসে দুর্নীতির অভিযোগে লুলা ডি সিলভা ন’বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়। পরে মানি লন্ডারিং মামলায় আরো তেরো বছরের কারাদন্ড দিয়ে লুলাকে উত্তরের শহর কুরিতিবায় ফেডারেল পুলিশ ভবনের চারতলায় ১৬০ বর্গ-ফুটের একটি কক্ষে আটক রাখা হয়। দলের অবস্থা তখন দারুন ভাবে বিপর্যস্ত। কিন্তু , ব্রাজিলের শ্রমিক আর নিম্ন আয়ের সাধারন মানুষদের কাছে লুলা তখনো এক জনপ্রিয় নেতা।

গত রোববারের ( ৩০ অক্টোবর) রাতে নির্বাচনে বিজয়ের খবর জানার পর দলীয় নেতা-কর্মী-সমর্থকদের উদেশ্যে দৃঢ়চেতা বিপ্লবী লুলা ডি সিলভা নেতাকর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, “ওরা আমাকে জীবন্ত কবর দিতে চেয়েছিলো। আমি এখন এখানে । একটি বিপর্যয়কর অবস্থায় দেশটি পরিচালনার দায়ীত্ব নিতে হয়েছে। ঈশ্বরের ওপর আমার আস্থা আছে। জনগনের সহায়তা নিয়ে আবার দেশটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবো।“

বিজয়ের উৎসবে রাজধানী সাও পোলোর প্রধান সড়কে হাজারো সমর্থকের ধল নামে। উৎসবে যোগ দিয়ে দেশটির একজন ঐতিহাসিক ক্লাডিয়া মারকোস গনমাধ্যমকে বলেছেন।আমি সেদিন খুব কেঁদেছিলাম, যেদিন লুলাকে জেলে নেওয়া হয়েছিল। আজ আমি কাঁদছি, কারণ সেই লুলা আবার দেশটিকে নেতৃত্ব দিতে নির্বাচিত হয়েছেন। লুলা আমাদের ফিনিক্স পাখি। তিনি পারবেন। কারণ, তার রয়েছে অভিজ্ঞতা এবং জাদুকরি নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষমতা।

নির্বাচনে জয়ী হয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির অফিসে সাংবাদিক এবং কর্মী-সমর্থকদের উপস্থিতিতে এক লিখিত বিবৃতিতে লুলা বলেছেন, কেবল মাত্র কতগুলি বছর গুনেই মানুষ বৃদ্ধ হয় না। উদ্দেশ্যহীন জীবন অর্থহীন। আমার জীবনের উদেশ্য দেশ ও দেশের মানুষদের সেবা করা। তিনি আরো জানান,” ২০২৩ সালের প্রথম দিন থেকে ২১৫ মিলিয়ন নাগরিকের দেশ ব্রাজিলকে পরিচালনার দায়িত্ব নে্বো। যারা আমাকে ভোট দেন নি তাদের জন্যও কাজ করবো । তিনি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, এ যাত্রায় মাত্র একবারের মেয়াদে শেষবারের জন্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

কে এই লুলা ?

১৯৪৫ সালে ব্রাজিলের দক্ষিনাঞ্চলে এক দরিদ্রপীড়িত পরিবারের অষ্টম সন্তান হিসেবে লুলার জন্ম। জীবিকার তাগিদে সেখান থেকে মা সন্তানদের নিয়ে এসে আশ্রয় নেন রাজধানী সাও পোলোর উপশহরের ঘিঞ্জি এক বস্তিতে। সেখানে জুতা পালিশের কাজ করে জীবিকা অর্জনের লড়াইয়ে যুক্ত হন কিশোর লুলা। এর পর চৌদ্দ বছর বয়সে মেটাল কারখানার শ্রমিক হয়ে যোগ দেন জীবন সংগ্রামে। সেখানে একজন সক্রিয় শ্রমিক নেতা থেকে হয়ে ওঠেন শ্রমিক ইউনিয়ন নির্বাচিত নেতা । ১০৭০ এর দশকে সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পরেন। ১৯৮০ সালে সমমনা রাজনৈতিক শক্তি মিলে গড়ে ওঠে ব্রাজিলের সর্বদলীয় ওয়ার্কার্স পার্টি। সরাসরি ভোটে নির্বাচনের দাবীতে আন্দোলন গড়ে তোলে ওয়ার্কার্স পার্টি। কারখানায় ধর্মঘট পালনের দায়ে লুলাকে জেলে নেওয়া হয় এবং আন্দোলনের মুখে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯৮৯ সালে পার্টির মননীত প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে প্রতদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান। এ পর আরো দু’বার পরাজয়। অবশেষে ২০০২ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ব্রাজিলে প্রথমবারের বামপন্থি সরকার গঠনের ইতিহাস রচনা করেন লুলা ডি সিলভা । ২০০৩ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে ২০১০ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত দু’ দফা ক্ষমতায় থাকাকালে লুলা ব্রাজিলের জন্য অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং নিম্ন আয়ের মানুষদের জীবন মানের ব্যাপক উন্নতি সাধন করেন। এ সময় তিনি দেশটির দারিদ্র বিমোচন, এবং নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য নানাবিধ কল্যান মুলক কর্মসূচী চালু করেন।

এবারের নির্বাচনে লুলার বিজয়ের অন্যতম কারন হিসেবে এগুলি বিবেচনায় নিয়েছেন দেশটির সংখ্যাগুরু ভোটারগন । এ ছাড়া বিশ্ব প্রকৃতির ফুস্ফুস বলে অভিহিত আমাজান নদীবিধৌত অঞ্চলের বনভুমি এবং সেখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় তার দৃঢ় সংগ্রামকে লুলার বিজয়ের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকগন ।

বিশ্ব মহামারি কোভিডে আক্রান্ত হয়ে ব্রাজিলে সাত লক্ষ মানুষের প্রান হানি ঘটেছে । কোভিডে বিপর্যস্থ হয়ে গেছে দেশটির অর্থনীতি । এ অবস্থায় লুলার পক্ষে দেশ পরিচালনা করে অগ্রগতি ও সমৃদ্দধি অর্জন যথেষ্ট কঠিন হবে বলে ধারনা করা হচ্ছে।

এদিকে, লুলাক নিম্ন আদালতে দেওয়া দন্ডের বৈধতা এবং যথার্থতা বিবচনার কাজ শুরু করেছে দেশটির সুপ্রীম কোর্ট। লুলার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সরকারের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে নিম্ন আদালতের বিচারক পক্ষপাতদুষ্ট রায়ে তাকে সাজা দিয়েছে।

প্রেরণদায়ক প্রেমপত্র।

২০১০ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা ত্যাগের পর লুলা কান্সার রগে আক্রান্ত হন এবং কেমথেরাপী নিয়ে সুস্থ হন। তার বিরুদ্ধে পরিচালিত দীর্ঘ তদন্ত ও হয়রানি মোককাবেলা করতে গিয়ে মানসিক চাপে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরনে তার স্ত্রী মারিসা ল্যাটিসিয়া ২০১৭সালের ফেব্রুয়ারী মাসে মারা যান। কারাগারর দিন গুলিতে তার প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে তার দলের মহিলানেত্রী ৫৮ বছর বয়সী সমাজবিজ্ঞানী রোসানগেলা’ র প্রেমপত্র। লুলার আইনজীবী লুইস কার্লোস সপ্তাহান্তে একবার কারাগারে তার সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। বার্তা সংস্থা এপি-কে দেওয়া সাক্ষাতকারে কার্লোস জানিয়েছে, কারাগারে দেখা করার সুযোগে সেসব প্রেমপত্র কোটের পকেটে লুকিয়ে নিয়ে যেতেন এবং কারারক্ষীদের আগোচরে লুলার কাছে পৌঁছে দিতেন। প্রতিবার চিঠি পেয়ে লুলার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠতো।

লুলা ডি সিল্ভা তানা ৫৮০দিন কারাগারে কাটিয়ে আদালতের নির্দেশে মুক্তি পেয়ে সমাজবিজ্ঞানী রোসানগেলাকে জীবন সংগী হিসেবে গ্রহন করেন এবং নির্বাচনী প্রচারাভিযানে নেমে পড়েন। প্রতিটি গনসংযোগ কর্মসূচীতে রোজেঞ্জেলা ছিল তার ছায়া সঙ্গী। গত সেপ্টেম্বর মাস এরকম এক প্রাচারাভিযানে লুলা জানিয়েছেন, ঈশ্বর চাইলে রোজেঞ্জেলার প্রেমপত্র এক সময় প্রকাশ করা হবে। তবে সেটা অবশ্যই হবে ১৮ বছরের বেশি প্রাপ্ত বয়ষ্কদের জন্য।