ওমর ফারুক
দুর্যোগের খবর সামনে আসলে আমাদের চেতনা একদিনের জন্য জাগ্রত হয় বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে যেসকল মানুষ বসবাস করে তাদের নিয়ে ভাবতে। আরেকবার চিন্তা হয় যখন দুর্যোগে নানারকম কষ্টসহ্য করে প্রতিকুল পরিবেশে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে এই মানুষগুলো।
আজকের দিনটি অনেকের কাছে স্বজন হারানোর দিন। বেদনার দিন। অনেকের স্মৃতিচারণে ভেসে উঠে ভয়ংকর সেই ঘুর্নিঝড়ের দৃশ্যপট। ১৯৭০ সালের এই দিনে (১২ই নভেম্বর) প্রলয়ংকারী ঘূর্নিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস দেশের উপকূল বিরান ভূমিতে পরিণত করে। শক্তিশালী এই ঘুর্নিঝড়ের নাম ছিল 'ভোলা সাইক্লোন'। সেদিন পৃথিবী একবার মৃত্যুর মিছিল দেখছিল। এই দিনে প্রাণ হারিয়েছে লাখ লাখ মানুষ। ঘরবাড়ি হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাসকারী লোকের সংখ্যাও কম নয়। এই ঘুর্নিঝড়টি স্মরণকালের সব থেকে ভয়ংকর প্রাণঘাতি ঝড়। সরকারি হিসেবে ৫ লাখ মৃত্যুবরণ করেছে বলা হলেও বেসরকারিভাবে হিসাবে তা ১০ লক্ষেরও অধিক।
এখনও উপকুলের মানুষরা প্রতিনিয়ত নানান প্রতিকুল পরিবেশের সাথে লড়াই করছে। লড়াই করতে করতে অনেকে আবার বেশ ক্লান্ত ও। তবে মনোবল শক্ত থাকার কারণেই উপকূলবাসীকে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখায় নানান সংগ্রামের গল্পের ভীড়ে। বাংলাদেশের মোট ৬৪ জেলার ১৯টি জেলায় উপকূলবর্তী। দেশের মোট জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশ অর্থাত ৬ কোটি মানুষ নানান দুর্যোগের মধ্য দিয়ে বসবাস করে আসছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে প্রতিনিয়ত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে উপকূলের বসবাসকারী সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা । বাড়ছে নানান ঝুঁকিও। দেশীয় অর্থনীতিতে উপকূলীয় অঞ্চলগুলো অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। মাছ, কৃষি, বন, লবণ ইত্যাদি থেকে অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখছে উপকূলবাসী।
উপকূলের মানুষ নিত্যদিনের সংগ্রামের গল্প রচনা করে। মৌলিক চাহিদা মেটাতে জীবনযুদ্ধে নেমে পড়ে উপকূলবাসী। সন্তানদের মানসম্মত পাঠদানের ইচ্ছে থাকলেও অনেক অভিভাবকেরই তা সম্ভম হয়ে উঠে না। মানসম্মত চিকিৎসা সেবা থেকেও তারা বঞ্চিত। এরকম অসংখ্য সমস্যার মধ্যেই বসবাস উপকূলবাসীর।
উপকূলবাসী যেকোনো দুর্যোগে খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমাদের সামান্যতম সহযোগিতা তাদের জন্য যথেষ্ট নয়। ত্রাণের চেয়ে উপকূলবাসীর জীবনমান রক্ষায় দরকার স্থায়ী সমাধান। দেশের অধিকাংশ উপকূলে এখনও পর্যন্ত ঠেকসই বেড়িবাঁধ নেই। আগেরকার সময়ের বেড়িবাঁধ গুলোও তেমনটা মজবুত নয়। জলাবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলের অনেক নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। সামান্যতম বৃষ্টিও এসকলের উপকুলবাসীর চোখে জল এনে দেয়। আমরা টকশো কিংবা গল্প আড্ডায় উপকূলের মানুষদের নিয়ে ঝড় তুলি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কয়জনই বা উপকূলবাসীর খবন নিয়েছি সে প্রশ্নও মনে জাগায়।
বাংলাদেশে এখনও উপকূলের মানুষদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে সঠিক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এতো বছর পরেও ১২ নভেম্বর উপকূল দিবস হিসেবে স্বীকৃতি মিলেনি। দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমানও মন্ত্রীসভায় উত্থাপন করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। কথা রাখেন নি তিনিও।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দিন দিন বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এসকল জনগোষ্ঠী অন্যত্র বসবাস শুরু করতে গিয়ে পড়ছেন নানান সমস্যায়। স্বাভাবিক জীবনধারা থেকে ব্যাহত হচ্ছেন অধিকাংশ পরিবার।
আমরা আরেকটি ১৯৭০ সাল দেখতে চাইনা। উপকুলবাসীর বাঁচার অধিকার রয়েছে। উপকূলীয় দিবসের স্বীকৃতি ও এসকল অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর জন্য স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করা জরুরি। উপকূলবাসী আমাদের দেশেরই সম্পদ। তাদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সকল নাগরিকের দায়িত্ব। আমরা সেই সুনাগরিক হিসেবে উপকূলবাসীর অধিকার নিয়ে কথা বলি। তাদের নানান সমস্যা উত্তরণের উপায় খুঁজে বের করি এবং তাদের নিরাপদ জীবনযাপনে সহায়তা করি।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশের অধিকাংশ উপকূলীয় অঞ্চল ডুবে যাওয়ার আশংকা করা হচ্ছে । কাজেই উপকূলবাসীর জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে দেরি না করে এখনই সময় কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করার। পাশাপাশি উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষদের দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করতে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করাটাও জরুরি বলে মনে করছি।