আবদুর রহমান খান :
ভারতের উত্তর-পুর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মেঘালয়ের রাজধানী শিলং-এ জ্বালনী তেলের সংকটের মাঝে লরী ড্রাইভারদের ধর্মঘটে রাজ্য জুড়ে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। গারো জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত রাজ্যটিতে পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিন এবং রান্নার গ্যাসের জন্য পাম্প ষ্টেশনে দীর্ঘ লাইন ।
মঙ্গলবার সকালে কাঠ চোরাচালানীদের সাথে বনরক্ষী এবং পুলিশের সাথে গোলাগুলির ঘটনার পর রাজ্যজুড়ে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে বলে জানিয়েছে আসামের দৈনিক সেন্টিনেল পত্রিকা ।
আসামের পশ্চিম পশিম সীমান্ত জেলার পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্ট ইমদাদ আলি সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে জানিয়েছিলেন যে আসামের অন্তর্ভুক্ত বনাঞ্চল থেকে কাঠ পাচারের করা হচ্ছে এই সন্দেহে একটি ট্রাককে বনরক্ষীরা আটক করে। ধরা হয় চালক ও খালাসীকে। তারপরে বিপুল সংখ্যায় মেঘালয় বাসিন্দারা এসে আসাম পুলিশের কাছ থেকে আটককৃতদের ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য হামলা চালায়, তখনই গুলি চালায় পুলিশ। আর মেঘালয় বলছে, তাদের রাজ্যের অন্তত পাঁচ কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে এসে ওয়েস্ট জয়ন্তিয়া হিলস জেলার মুখরায় গুলি চালিয়েছে আসাম পুলিশ। একসময়ে মেঘালয় ছিল আসামেরই অংশ, আর শিলং শহর ছিল অবিভক্ত আসামের রাজধানী। বুধবার সেই শিলং শহরেই আসামের বিরুদ্ধে কালো পতাকা দেখানো হয়েছে। গোটা ঘটনাটিকে অনভিপ্রেত বলে দাবি করেছেন মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী। একটি বিচারবিভাগীয় তদন্তেরও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে, আসামের মুখ্যমন্ত্রীও বিচারবিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
টাইমস অফ ইন্ডিয়া আজ খবর দিয়েছে, মঙ্গলবারে আন্তঃরাজ্য সীমান্তে আসাম পুলিশের গুলিতে মেঘালয়ের পাঁচজন গ্রামবাসী নিহত হবার পর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিক্ষুব্ধ জনতা ট্রাফিক পুলিশের একটি বুথে এবং বাড়ি-ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। হাঙ্গামা কবলিত এলাকায় কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশের একটি গাড়ী এবং পুলিশ সদস্যের লক্ষ্য করে পাথর এবং পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করা হয়। পুলিশের এস পি বিবেক সেয়াম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এ ঘটনায় অন্তত চারজন পুলিশ এবং দু’জন নাগরিক আহত হয়েছেন।
এদিকে, দাংগা হাঙ্গামার খবর এবং গুজব ছাড়ানো ঠেকাতে রাজ্যের ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
মেঘালয়ে আইন-শৃংখলার অবনতির মধ্যে গত কয়েকদিনে তেলবাহী ট্যাঙ্ক-লরিতে আক্রমনে আতংকিত চালকগন তাদের নিরাপত্তার দাবীতে মঙ্গলবার থেকে রাজ্যে তেল পরিবহনের কাজ বন্ধ রেখেছে। আসাম পেট্রোলিয়াম মজদুর ইউনিয়ন জানিয়েছে, ভারতের তেল কোম্পানী-হিন্দুস্তান পেট্রোলিয়াম করপোরেশন লিমিটেড, ভারত পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন লিমিটেড এবং ইন্ডিয়ান ওয়েল কর্পোরেশন লিমিটেড বর্তমান নিরাপত্তাহীন অবস্থায় পাহাড়ি রাজ্যটিতে জ্বালনী তেল সরবরাহ বন্ধ রাখা হবে। ফলে জন দুর্ভোগ আরো বেড়েছে।
এর আগে আন্তঃরাজ্য বিরোধের জের ধরে মঙ্গলবার শিলং-এ আসামের নাম্বার প্লেটধারী একটি গাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
ইতোমধ্যে মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী সি এম কনরাড –এর নেতৃতে রাজ্য মন্ত্রী সভার একটি প্রতিনিধি দল নয়াদিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ-এর সাথে দেখা করে জানিয়েছেন, দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা আন্তঃরাজ্য় বিরোধের ফলে সৃষ্ট অসন্তোষ এখন রক্তাক্ত সংঘাতে রূপ নিয়েছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রকে হস্তক্ষেপ করতে হবে এবং বিরোধের সমাধান করতে হবে।
তবে আসামের রাজ্যবাসীদের ধারনা হেমন্ত বিশ্বাস হচ্ছেন রাজ্যের সবচেয়ে খারাপ মুখ্যামন্ত্রী। রাজ্যের সাধারন মানুষের উন্নতি এবং অর্থনৈতিক আগ্রগতির চেয়ে তিনি বেশী ব্যস্ত আসামে হিন্দুত্ববাদ কায়েমের চেষ্টায়।
উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালে আসাম ভাগ হয়ে মেঘালয় রাজ্য তৈরি হয়। তখন থেকেই মেঘালয়ের সঙ্গে আসামের সীমানা নিয়ে বিতর্ক আছে। মঙ্গলবার যে অঞ্চলে ঘটনাটি ঘটেছে আসাম সেটি তাদের জায়গা বলে দাবি করে। মেঘালয়ের দাবি ওই অঞ্চল তাদের।
এনিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মধ্যস্থতায় দুই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে একটি চুক্তি সই হয় কিছুদিন আগে। ছয়টি বিতর্কিত অঞ্চল নিয়ে একটি সমাধানসূত্রে পৌঁছায় দুই রাজ্য। কিন্তু এখনো একাধিক বিতর্কিত এলাকা আছে।
আসাম আর মেঘালয়ের মধ্যে প্রায় ৮০০ কিলোমিটার সীমান্ত আছে আর এই সীমান্ত অঞ্চলের ১২টি জায়গা নিয়ে গত ৪০ বছর ধরে বিবাদ চলছে দুই রাজ্যের মধ্যে। কখনো কখনো সেই বিবাদ হয়ে ওঠে সহিংস। শুধু মেঘালয় নয়, আসামের সঙ্গে মিজোরামেরও সীমানা বিতর্ক আছে। যার জেরে বছরখানেক আগে দুই রাজ্যের পুলিশের মধ্যে গুলির লড়াই হয়েছিল
আসামের বার্তালিপি পত্রিকার কার্যনির্বাহী সম্পাদক প্রণবানন্দ দাস জানিয়েছেন, মূলত বনজ সম্পদের ওপর অধিকার নিয়েই দু‘রাজ্যের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোর মধ্যে সংঘাত বাধে, আর তার পরে সেখানে পুলিশ প্রশাসনও হস্তক্ষেপ করে। যার ফলে শেষমেশ প্রাণ যায় বা আহত হন স্থানীয় মানুষরাই।
ভারতের রাইটস অ্যান্ড রিস্কস অ্যানালিসিস গ্রুপ ২০২১ সালে এক প্রতিবেদনে আনিয়েছে, আন্তঃরাজ্য বিরোধের জেরে গত ৪২ বছরে দেশটিতে প্রাণ হারিয়েছেন ১৫০-এর বেশি মানুষ; আহত হয়েছেন সাড়ে ৩০০-এর বেশি । আর ভিটে হারা হয়েছেন ৬৫ হাজার মানুষ।