বিশেষ প্রতিবেদক
আধুনিক নেশা ইয়াবা কারবারে জড়িত হলেও আগের সব তালিকায় বাদ পড়াদের সম্পৃক্ত করে নতুন খসড়া তালিকা করেছে সরকারের বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা। আগে করা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য এজেন্সির মাদক তালিকায় নাম আসা ব্যক্তিদের এ তালিকায় সম্পৃক্ত করা হয়নি। নতুন তালিকায় ইয়াবা কারবারে 'টাকার কুমির' হওয়া ৩৭৫ জন স্থান পেয়েছে।
সরকারের বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে প্রস্তুত হওয়া ইয়াবা পাচারকারী ৩৭৫ জনের মাঝে মাদকের পাইকারি ব্যবসায়ী হিসেবে স্থান পেয়েছেন ৯৮ জন। খুচরা ব্যবসায়ী হিসেবে ১২১ জন এবং সরবরাহকারি হিসেবে নাম এসেছে ১৫৬ জনের।
তালিকায় বড় পাচারকারী হিসেবে এক নাম্বারে নাম রয়েছে, কক্সবাজারের দক্ষিণ রুমালিয়াছড়ার শফিক আহমদের ছেলে মো. নুরুল আলম নুরুর নাম। নুরুর বাড়ি কক্সবাজার পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ রুমালিয়ারছড়াস্থ শহর পুলিশ ফাঁড়ির লাগোয়া। তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছে, নুরুর একাধিক ট্রলার আছে, যার মাধ্যমে তিনি মিয়ানমার থেকে ইয়াবা বড়ি নিয়ে আসেন। তার ইয়াবা বিক্রির প্রধান ক্ষেত্র কুমিল্লা। এরপর সেখান থেকে এই মাদক দেশের অন্যান্য অঞ্চলে চলে যায়। আর কুমিল্লা থেকে তিনি ফেনসিডিল নিয়ে কক্সবাজারে বিক্রি করেন। তার নামে ঢাকার যাত্রাবাড়ি থানার (মামলা নং-১৩৫ (৩)১৮, জি আর ২৪/১৮) মামলাসহ একাধিক মামলা চলমান আছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, দরিদ্র পরিবারের সন্তান হিসেবে অন্যের কাছে কাজ করে সংসার চলতো তার। কিন্তু এক দশকে তার অর্থ সম্পদের পরিবর্তন হয়েছে 'আলাদীনের চেরাগ' পাওয়ার মতো। অল্পদিনে রাতারাতি কোটিপতি বনে যান তিনি। বর্তমানে তার রয়েছে বহুতল ভবন, একাধিক ফিশিং ট্রলার, নামে-বেনামে বিপুল সম্পদ। এলাকাবাসীকে ধোঁকা দিতে তার স্ত্রী রুমিকে এনজিওর চাকরি করান। কিন্তু প্রচার আছে এসবের আড়ালে স্বামীর ইয়াবা ব্যবসার লেনদেনসহ সকল কিছুর সহযোগী শিক্ষিত তরুণী স্ত্রীই। বছর দুয়েক আগে বাঁকখালী নদী থেকে যে বিশাল ইয়াবার চালান উদ্ধার হয়, সেই চালান নুরুর ফিশিং ট্রলারেই নিয়ে আসা বলে প্রচার রয়েছে। ইতো মধ্যে ইয়াবা নিয়ে নুরু বেশ কয়েকবার কুমিল্লা ও ফেনী এলাকায় আটক হয়েছিলেন। কিন্তু কোন এক রহস্যজনক কারণে তিনি ছাড়া পেয়ে যান, যা তার আশপাশের লোকজনকে খুবই হতবাক করে।
সূত্র আরো জানায়, প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে তরতরিয়ে টাকার পাহাড় গড়েছে নুরু। বিনিময়ে অনেকেই পেয়েছেন 'নজরানা'। অল্প সময়ে এত টাকা এবং প্রশাসন থেকে বাঁচানোর ছায়ার কারণে বেপরোয়া ভাবেই এলাকায় চলাচল নুরুর। আশপাশের লোকজনকে তিনি মানুষ হিসেবেই গণ্য করেন না। প্রশাসনের নতুন এ ইয়াবা তালিকা নিয়ে এত চাঞ্চল্য ও মাতামাতি হলেও বহালতবিয়তেই নির্বিঘ্নে দিন কাটছে নুরু ও তার পরিবারের।
এসব বিষয় নিয়ে বক্তব্য জানতে মো. নুরুল আলম নুরুর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তার বাড়ি গেলে নুরু ঘরে নেই বলে জানান পরিবারের সদস্যরা। মুঠোফোন নাম্বার দেয়ার অনুরোধ করা হলে তিনিই কল করবেন বলে সাংবাদিকদের নাম্বারটা রেখে আর ফোন দেন না তিনি। এ কারণে তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
এদিকে, সরকারের বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা মিলে কক্সবাজারের নতুন ইয়াবা পাচারকারীদের প্রাথমিক তালিকায় স্থান পাওয়া ৩৭৫ জন ইয়াবা কারবারির মধ্যে অনেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে, অনেকে বিএনপির ও এবং অনেকে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আর কক্সবাজার পৌরসভার যে চার কাউন্সিলরের নাম এসেছে তাদের মধ্যে দুজন আওয়ামী লীগের, দুজন বিএনপির রাজনীতি করেন।
প্রাথমিক এ তালিকা প্রস্তুতকারী গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টরা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আগে যারা ইয়াবা পাচারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ ক্রসফায়ারে মারা গেছেন। অনেকে ইয়াবা ব্যবসা থেকে সরে এসেছেন। আর যারা আগের তালিকায় রয়েছেন তাদের, এ তালিকায় নতুন করে সম্পৃক্ত করা হয়নি। কারণ আগের তালিকাগুলোও বহাল রয়েছে।
প্রশাসনের সূত্র মতে, কক্সবাজারের সীমান্তঘেঁষা মিয়ানমার অংশে ৩৯টি ইয়াবা কারখানা রয়েছে। সেখান থেকে ইয়াবা বড়ি বাংলাদেশে ঢুকে মাত্র ২০ থেকে ৩০ টাকা প্রতি পিসে। সেই ইয়াবা ঢাকাসহ দেশের অন্য এলাকায় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্তও বিক্রি হয়ে থাকে। পুরোনোরা টাকা বানিয়ে বিভিন্ন ভাবে ব্যবসাকে ঢাল বানিয়ে চললেও নতুন করে অনেকে এই ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছেন। এবারের তালিকায় সেসব নতুন কারবারিদের নাম এসেছে।
গক ১৫ জানুয়ারি কক্সবাজারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ২৬তম বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপি বলেছেন, বিভিন্ন সেক্টর থেকে আমরা অনেক তথ্য পাই। তা যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নেয়া হয়। কক্সবাজারের মাদক কারবারিদের নিয়ে যে তালিকা এখন পাওয়া গেছে তা যাচাই-বাছাই চলছে। তালিকায় কারও নাম এলো বলে তিনি দোষী হয়ে যাননি। তালিকার সব বিষয় তদন্ত করে সরকার হার্ডলাইনে যাবে।