-বদরুল ইসলাম বাদল
কলা মানুষের শরীরের স্বাস্থ্য সম্মত অতি পরিচিত এক ফল।কলা গাছ হাতির প্রিয় খাবার। আবার কলা গাছের বাকল থেকে সুতা তৈরি হচ্ছে । এখন সে কলা গাছ আবার প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করছে ইউপি নির্বাচনে নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থীরা।দেখা যাচ্ছে রাস্তায় হাট-বাজার কিংবা বিভিন্ন জনপদে কলা গাছ রোপণ এবং কর্মী সমর্থকদের সাথে নিয়ে নৌকা বঞ্চিত প্রার্থীদের কলা গাছ মিশিল।তাতে হতবাক সচেতন মহল।বিস্মিত দলের নীতিনির্ধারকেরা। নৌকা প্রত্যাশীদের যেন মনোনয়ন পেতেই হবে। তাতে প্রত্যাশা পুরণ না হওয়ায় কলা গাছ নিয়ে বিচিত্র আন্দোলন নিয়ে এখন নৌকা বঞ্চিত প্রার্থীরা।কিন্তু এই অতিপরিচিত কলাগাছ কখন থেকে কক্সবাজার জেলায় নির্বাচনের প্রতীকী প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে একটু পেছন ফিরে থাকানো দরকার।
কক্সবাজার সদর আসনের বিএনপি দলীয় মাননীয় মরহুম সংসদ সদস্য তিনি কক্সবাজার সদর আসনের দুইবার সংসদ সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০১ এর জাতীয় নির্বাচনে এডভোকেট খালেকুজ্জামান তাঁর নির্বাচনী জনসভায় আকস্মিক মৃত্যুতে শূন্য আসনে উপনির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তখন বেগম খালেদা জিয়া অর্থাৎ বিএনপি রাষ্ট্র ক্ষমতায়। কক্সবাজার এক আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য সাবেক যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সালাউদ্দিন আহমেদ বিগত চার দলিয় জোট সরকারের যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী।
সালাউদ্দিন উক্ত উপনির্বাচনে লুৎফর রহমান কাজল কে বিএনপির মনোনয়ন পাইয়ে দেন। কাজলের এই মনোনয়ন কে কক্সবাজার সদরের খালেকুজ্জামান ভক্তরা মেনে নিতে পারেননি। তাদের দাবি ছিল খালেকুজ্জানের ছোট ভাই সাবেক সংসদ সদস্য সহিদুজ্জামান কে বিএনপির মনোনয়ন দিতে হবে, কাজল কে নয়।
তখন খালেকুজ্জামানের ভক্তরা প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন উপকারী উদ্ভিদ কলাগাছ কে। তারা রাতারাতি কক্সবাজার প্রধান সড়কের দুইপাশে হাজার হাজার কলাগাছ কেটে রোপে দেয়।
সেই অদ্ভুত অশুভ পরিবেশ বিরোধী নির্বাচনী মনোনয়নের প্রতিবাদী হাতিয়ার হিসেবে কক্সবাজারে ব্যবহার হয়ে আসছে।
চলমান ইউপি নির্বাচনে নৌকা প্রত্যাশী প্রার্থীদের অবস্থা দেখে বহুল প্রচারিত একটি গল্গ নিয়ে সাধারণ মানুষ আলোচনা সমালোচনা নিয়ে চরমে। মোটামুটি গল্পটি হল- এক পিতা তার দুই জন ছেলে রেখে মৃত্যু বরণ করেন। তার রেখে যাওয়া সম্পত্তি ভাগ হচ্ছে দুই ভাগে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল একটি তাল গাছ নিয়ে। তাল গাছটি আছে টিক সীমানায়। গাছটির ভাগ কেউ ছেড়ে দিতে চায় না।বৈঠকের সন্মানিত বিচারকগণ দু’ভাই কে আলাদা আলাদা ভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেন। একটি সমাধানের জন্য। কিন্তু উভয়েই বিচারকদের বিনয়ের সাথে বলে “সব কিছু ঠিক আছে। যা বলেন সব ঠিক আছে। বিচার যা করেন অসুবিধা নাই। কিন্তু তাল গাছটি আমার ভাগে চাই “। তাতে বিচারক গণ বিষম সমস্যায় পড়ে ।ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অবস্থা ও ঐ তাল গাছ নিয়ে বিচারের মত অবস্থা।
দেশে ইউপি নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে যে, দলের মনোনয়ন পাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতায় নেমেছে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রত্যাশীরা। প্রত্যাশা করা মানে যেন তাদের একক দাবীতে দিতেই হবে । দলীয় প্রতীক নৌকা মানেই যেন সুনিশ্চিত বিজয়। তাই উপজেলা জেলা এবং কেন্দ্র পর্যন্ত প্রার্থীদের দৌড়-ঝাপ। আওয়ামী লীগ পুরানো এবং বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দল। একটানা এক যুগের অধিক ক্ষমতায় থাকার কারণে একটি ইউনিয়নে অধিক নেতার সৃষ্টি হয়েছে বিধায় অনেকে চেয়ারম্যান হতে চায়। কিন্তু বিধি মতে দলের নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করার সুযোগ থাকে একজনের। আর মনোনয়ন পেয়ে থাকে শেষ পর্যন্ত একজনই। তাই তালিকা থেকে বাদ পড়াদের অসন্তোষ প্রকাশে বিভিন্ন ধরনের স্ট্যাটাস এবং রাস্তায় কলা গাছ রোপন করে প্রতিবাদ করছে।
কিন্তু প্রতিবাদটি কিসের? কার বিরুদ্ধে? দলের প্রধানের বিরুদ্ধে? মনোনয়ন বোর্ডের বিরুদ্ধে? নৌকার বিরুদ্ধে? নাকি দলের বিরুদ্ধে? নির্দিষ্ট একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দলের মনোনয়ন বোর্ড প্রার্থী নির্বাচন করে এবং চুড়ান্ত করার ক্ষমতা রাখে। দলের হাই কমান্ড সবদিক বিবেচনা করে একজনকে মনোনয়ন দিয়ে থাকে এবং সে মনোনীত প্রার্থী নিয়ে কোন অভিযোগ থাকলে দলীয় মনোনয়ন বোর্ডে আপীল করার সুযোগ রয়েছে । অনেক জায়গায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে প্রার্থী পরিবর্তন ও করা হয়েছে। তার পরও গাছ কর্তন করে কলা গাছ মিছিল বন্ধ করা যাচ্ছে না।আওয়ামীলীগের এই মনোয়ন বঞ্চিত প্রার্থীরা পক্ষান্তরে মুজিবাদর্শ কে অপমান করে বিএনপির পদাঙ্ক অনুসরণ করছেন না!!
নৌকা বঞ্চিতদের শত শত কলা গাছ কর্তন করাকে পরিবেশবাদীরা ভাল চোখে দেখছে না। বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সমস্যা ও এর বিরুপ প্রভাব দ্রুত প্রকট আকার ধারণ করছে। তাতে মানব জাতি শঙ্কিত।বিশ্ব অপরাপর নেতাদের পাশাপাশি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে। যার ফলে তিনি এই ভূমিকার ফলে জাতিসংঘ কর্তৃক “চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থ” সন্মানে ভূষিত হন।পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার জন্য যার যতটুকু জায়গা আছে মুজিব বর্য উপলক্ষে তিনি প্রত্যেককে তিনটি করে গাছ লাগানোর আহ্বান করেন। কিন্তু ইউপি নির্বাচন নিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা বঞ্চিত হয়ে গাছ কাটছে।আর পরিবেশের ক্ষতি করছে।তাই প্রশ্ন উঠছে এরা প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে আসলে দেশ এবং জনগণের প্রত্যাশার পূর্নতা আসবে কিনা।
বহির্বিশ্বে সাম্প্রতিক সময়ে কয়েক টি দেশে প্রতিবাদের কতগুলো চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। যেমন —
(ক) ফিলিস্তিনি ফটোগ্রাফার সাংবাদিক মোয়াত কে ইসরাইলী পুলিশ গুলি করে অন্ধ করে দেয়ার প্রতিবাদে ক্রুদ্ধ সাংবাদিকরা নিজেদের এক চোখে বেন্ডেজ লাগিয়ে টেলিভিশনে সংবাদ পাঠ করে।”সত্যের চোখ অন্ধ হতে পারে না “শ্লোগানে তার সহকর্মী সংবাদ কর্মীরা নির্মমতার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে এমনকি ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীরা ও চোখে হাত দিয়ে ছবি তুলে সামাজিক বিভিন্ন মাধ্যমে পোস্ট করছে।
(খ) দক্ষিণ কোরিয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিরোধী দলীয় নেতারা মাথা ন্যাড়া করে প্রতিবাদ জানায়।
(গ) মিয়ানমারে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে তিন আংগুলের স্যালুটকে বেচে নিয়েছেন প্রতিবাদী জনতা। তিন আংগুলের এই স্যালুটের অর্থ শাসক গোষ্ঠীকে মানি না।সম্প্রতি থাইল্যান্ডে ও বিক্ষোভকারীরা এই রকম স্যালুট ব্যবহার করে। যুগে যুগে দেশে দেশে অন্যায় অবিচার এবং অসাংবিধানিক বৈষম্যমূলক আচরনের বিরূদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছে মানুষ। দাবী আদায়ের লক্ষ্যে অনেক আন্দোলনের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ের কলা গাছ আন্দোলন টি ব্যতিক্রম।
ইউপি নির্বাচনে যেন কোন প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকে সেদিকে শুরু থেকে গুরুত্ব দিচ্ছেন দলের নীতি নির্ধারনী কেন্দ্রীয় কমিটি।তৃণমূলের নেতাকর্মী সমর্থকদের মাঝে ক্ষোভ -অসন্তোষ যাই থাকুন না কেন নৌকার বিজয়ে একসাথে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন দলের হাই কমান্ড।দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ” ইউপি নির্বাচনে যে সব অভিযোগ সেগুলো যাচাই করা হচ্ছে। সত্যতা প্রমাণ হলে প্রয়োজনে সংশোধন করা হবে। দলের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, নেতৃত্বের জন্য ল্যাং মারামারি এসব বন্ধ করতে হবে। চা দোকানে বসে দলের এক নেতা আরেক নেতার বিরুদ্ধে বিষোদগার করে। এটা রাজনীতি না”।
তবুও অনেক জায়গায় নৌকা চেয়ে মনোনয়ন বঞ্চিত অনেকে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে ভোটে লড়ছে । আবার অনেক প্রার্থী দেখা যাচ্ছে নৌকা প্রতিকে একাধিক বার নির্বাচন করার পর ও পুনরায় মনোনয়ন না পেয়ে নৌকা বিরোধী দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে লড়ছে। এনিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে একজন হতাশা ব্যক্ত করে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, “,আজব কাহিনি কলা গাছ কে যারা সময়ে ঘৃণা করেছে, তাদেরই হাতেই এখন কলা গাছ “। সারা দেশের মত কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে নৌকা বিদ্রোহীদের দল থেকে অনেককে বহিষ্কার করেছে জেলা আওয়ামী লীগ এবং চলমান ইউপি নির্বাচনে বিদ্রোহীরা মনোনয়ন প্রত্যাহার না করলে দল থেকে বহিষ্কার করার নোটিশ জারি করে।।
বাঙালী জাতি অন্যায় অবিচার অসত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হিসেবে ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী। নিজেদের অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ জাতি সব সময় ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু আজকের দিনে কলা গাছ আন্দোলন কে অধিকাংশ মানুষ তামাশার দৃষ্টিতে দেখছেন। রাজনীতি নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতা জি এম কাদের সাহেবের একটি মন্তব্য উল্লেখ যোগ্য বলে হয়।তাহার মতে,এখন আওয়ামী লীগে কোন রাজনীতির চর্চা নাই, বিএনপি নেতৃত্ব নিয়ে সংকটে। তাই জাতীয় পার্টিকে ক্ষমতার দিকে নিয়ে যাবার জন্য দলের নেতা কর্মীদের সংগঠিত হবার আহ্বান জানান তিনি । আওয়ামী লীগে এখন দেখা যায় শুধু নিজেদের মধ্যে কোলাহল, অন্তর্দলীয় কোন্দল আর ভুল-বোঝাবুঝি ।কারণ ব্যাক্তির চেয়ে দল বড়,দলের চেয়ে দেশ। রাজনীতির এই শিক্ষার চর্চা থাকলে অন্তত পক্ষে মনোনয়ন বঞ্চিতরা দলের হাইকমান্ডকে বৃদ্ধাগুলি দেখানো সম্ভব হতো না।রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু মুজিবের পুরো জীবনটাই ত্যাগের ইতিহাস। আওয়ামী রাজনীতির গৌরবের ধারাবাহিকতা হল ক্ষমতার মোহ নয়, জনগণের পাশে থেকে অধিকার আদায় নিয়ে লড়াই করার ইতিহাস, সেবা নিয়ে মানুষের পাশে থাকার ইতিহাস।আর চেয়ারম্যান মেম্বার না হলে কি সাধারণ মানুষের সেবা করা যায় না?নিজের যোগ্যতা প্রমানের জন্য চেয়ারম্যান মেম্বার হওয়া কি অত্যান্ত জরুরি? ইতিহাস সাক্ষী যে, যুগে যুগে ক্ষমতার বাইরে থেকে অনেকের সেবা করার ইতিহাসের তালিকা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের চেয়ে অনেক লম্বা।আর জনগণ তাদেরই মহান, ত্যাগী এবং সত্যিকারের সেবক হিসেবে শ্রদ্ধা করে,ভালবাসে। মনে রাখে শ্রদ্ধা ভরে আজীবন।
আওয়ামী রাজনীতিতে এখন সুখের দিনের চর্চা চলছে। দু’চার দিন মিছিলে গিয়ে শ্লোগানের সাথে থাকাকে রাজনীতি বলা যায় না।সুনির্দিষ্ট আদর্শের ভিত্তিতে জনগনের ব্যাপক সম্পৃক্ততার মাধ্যমে সমাজ বদলের যাত্রা পথটা অনেক বন্ধুর এবং দুর্গম।চলার পথে একবার পা পিছলে গেলে উঠে আসা মুস্কিল, তাই সকলের উচিত হাই কমান্ডের নির্দেশনা মেনে চলা।ভুল-ভ্রান্তির উর্ধ্বে কেউ নয়।বৃহত্তর স্বার্থে নিজের চাওয়া পাওয়া কে দলের প্রতি ভালবাসার কারণে মেনে নেয়া আদর্শিক নেতাকর্মীদের সুস্থ ধারার রাজনীতির পরিচায়ক। কারণ সবাই বেলা শেষে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মানে একনিষ্ঠ কর্মী। বঙ্গবন্ধু প্রেমী।
স্বাধীনতার পরাজিত সাম্প্রদায়িক অপশক্তি এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী যড়যন্ত্র থেকে বাংলাদেশ এখনো নিরাপদ নয়।উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত কে শক্তিশালী করতে ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ ছাড়া কোন বিকল্প নাই। তাই ত্যাগী মানষিকতা নিয়ে সবাইকে এক কাতারে দাড়ানো সময়ের দাবী।
জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক : কলামিস্ট, সাবেক ছাত্র নেতা।