অধ্যাপক রায়হান উদ্দিন :
বাংলাদেশের আরেকটি অসাম্প্রদায়িক উৎসব হলো একুশে ফেব্রুয়ারী , শহীদ দিবস। ছাত্রছাত্রিরাই মুলত এই উৎসবে মেতে উঠে বেশী। এই উৎসবের ছোয়া লাগে সারা দেশে।আমাদের এদিককার ছাত্ররা এখন বড় আকারে কোনও সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজন করে কি? রাজনীতিই এখন একমাত্র সংস্কৃতি।
বাংলাদেশের একুশে ফেব্রুয়ারী দিবসে আমি দেখেছি আপামর জনসাধারন মিছিল করে শহীদ বেদীতে আসে ফুল দিতে। বাংলাভাষার অধিকার রক্ষায় দাবিতে বাহান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারীতে চারজন তরতাজা তরুণ প্রাণ দিয়েছিল ঢাকায়। সেই অনুসারে এটি শোক দিবস হিসেবে পালিত হওয়ার কথা। কিন্তু এখন দেখা যায় সেটি জয় দিবস কিংবা ভবিষ্যত শপথ নেবার দিন । তবুও আজকে যাদের বয়স একুশ কুড়ি তারাতো সেই বাহান্ন সাল দেখেননি।এমন কি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিও তাদের নেই, তবুও একুশে ফেব্রুয়ারী উৎসবের শোকের প্রাণাবেগ দেখে অভিভুত না হয়ে পারিনা।তখনকার দিনে উচ্চশিক্ষিত মুখ্য মন্ত্রী ফজলুল হক সাহেবও মাঝে মাঝে বাংলা বাক্য উচ্চারন করতেন। পাকিস্তান সৃস্টির পর বাহান্ন সালের অনেক আগে কায়েদে আজম জিন্না এক জনসভায় আব্বাসউদ্দিনের গান সম্পর্কে আপত্তি তুলেছিলেন। কিন্তু তখন সাধারন মুসলমান শ্রোতারা জিন্নার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তোলেছিল।শেষ পর্যন্ত আব্বাসউদ্দিনের গান দিয়েই জনসভা শুরু হয়েছিল। তাই বলে বাংলাদেশে কি ইঙ্গ বঙ্গ সমাজ নেই? জিনস ও গেঞ্জি পরা সব সময় ইংরেজী বলা ছেলে মেয়েদের দল, বিদেশী মেগাজিন পড়া ব্রাউন সাহেবরা একুশে ফেব্রুয়ারীর তোয়াক্কা করেন না।বাংলা একুশে ফেব্রুয়ারী কবে, সে ধাঁধার উত্তর আমাদের অনেক ছেলেমেয়েরা দিতে পারবে না।কিন্তু বাংলা শিল্পসংস্কৃতির সাথে তাদের সম্পর্ক একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। তাই অনেককে বলতে শুনি পহেলা ফেব্রুয়ারী আসলে বাঙালি হয়ে যাই, আবার ২৮ শে ফেব্রুয়ারী আসলে বাংলা ভুলে যাই।তবুও তো এই একটা মাস তারা বাঙালি সাজতে লজ্জা পায়না।
একুশে ফেব্রুয়ারীতে কবিতা নিয়ে অনেক অনুষ্টান দীর্ঘদিন ধরে হচ্ছে এবং কবিতাকে ভালোবেসে বহু মানুষ রাজধানীতে নয়,মফস্বলে দুরগ্রামে অঞ্চলেও শুধু কবিতাকে ভালোবেসে তাঁদের জীবনের অনেকটা সময় ব্যয় করছেন।অনেকটা সময় ধরে কবিতার সঙ্গে কাটাচ্ছেন।এটা জানলে বা বুঝলে ভালোলাগে,যেহেতু আমি কবিতা লিখি,যেহেতু আমি গান লিখি,গান গাই, গানের সুর করি সেজন্য বাংলা সঙ্কৃতির যে কোন বিষয় যখন দেখি যেখানে অনেক মানুষ ইনভল্ব হচ্ছেন,অনেক মানুষ জড়িয়ে থাকছেন তখন একটা কোথাও ভিতরে ভিতরে আনন্দ হয়। তবুও বিভিন্ন কবিতার অনুষ্ঠানে আসতে পেরে মনে মনে ভালো লাগে যে সত্যি ছেলেমেয়েরা তাদের পারফরমেন্স পেশাদার যারা শিল্পী তাদের মতোই নিখুত হচ্ছিল। এটা সহজে হয়না । যারা এর পেছনে কাজ করছে তাঁদের কৃতিত্ব অবশ্য রয়েছে।আর ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যখন কবিতা বলছে তখন তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে ওদের বলবার মধ্যে যে আনন্দ সেটার দিকে তাকিয়ে অনেকগুলো কথা মাথায় এসেছে সেইগুলোই বলবো কিন্তু তার আগে দুয়েকটি কথা ।ভালো লাগছে যে এতো মানুষ দীর্ঘক্ষন ধরে বসে থাকেন বাংলাভাষায় যে কাজ হচ্ছে তা শোনার জন্য।আপনারা অনেকেই জানেন গুরুত্বের বিচারে বা প্রয়োজনীয়তার বিচারে সারা পৃথীবির ৪১৭টি ভাষার মধ্যে রাস্ট্রসংঘ বাংলাভাষাকে তৃতীয় স্থানে রেখেছে। আপনারা এটাও জানেন যে এই মুহুর্তে সারা বিশ্বে প্রায় ৩৬ কোটি লোক বাংলাভাষায় কথা বলেন, বাংলা পড়েন,বাংলা জানেন। আপনারা এটাও জানেন যে বাংলা এমন একটা ভাষা, অন্যভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে যে গুলো ব্যাবসায়ীক কারণে বানিজ্যিক কারনে ব্যবহার হয় যেমন ইংরেজী,জার্মানী বা ফ্রেঞ্চ কিন্তু সাহিত্য কাব্যের বিচারে অন্যভাষার মানুষ সবচেয়ে যে ভাষাটি বেশী শিখতে চায় সেখানেও বাংলাভাষার স্থান ২য়।আমার এই কথা গুলো বলার অর্থ বাংলাভাষা নিয়ে যারা চর্চা করছেন, বা দীর্ঘদিন ধরে করছেন, তাদের প্রতি সাধুবাদ জানানো এবং এসব জানিয়ে দেওয়া,বিশেষ করে এখানে অনেক অভিভাবক আছেন তাঁদের কাছে।যে এতো আনন্দ এবং এতো ভাল লাগার মধ্যে কিছু খারাপ লাগা আপনাদের সাথে শেয়ার করবো।আসলে বাংলা বাঙ্গালী এসব বললে কোথাও একটা এমন প্রেক্ষাপট তৈরী হয়,এমন একটা চালচিত্র তৈরী হয় ,যেটা বোধহয় পৃথীবির অন্যভাষার মানুষ নিশ্চই তাদের সংস্কৃতি নিয়ে তাদের গর্ব আছে তাদের সংস্কৃতি নিয়ে তাদের অহংকার আছে,কিন্তু কোথাও যেন আমার মনে হয় বাংলা ভাষা ছাড়া বোধহয় সম্ভব নয়। একটা ভাষা যে ভাষায় কথা বলতেন স্বামী বিবেকানন্দ। একটা ভাষায় যে ভাষায় কথা বলতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,কাজী নজরুল ইসলাম।একটা ভাষা যে ভাষায় দুটো দেশের জাতীয় সঙ্গীত রচিত হয়েছে।একটা ভাষা যা এখনো পৃথীবির ৩৭ কোটি মানুষ উচ্চারন করে।একটা ভাষা গোটা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনকে মন্ত্র দিয়েছিলেন যিনি।সেই সাহিত্য সম্রাট বঙ্কীমচন্দ্রের “ বন্দে মাতরম”। সেই সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা ছিল বাংলা। প্রথম থেকে তিনি বাংলা জানতেন না এবং বেশী বয়সে এসে তিনি বাংলা শিখেছেন।এবং নতুন ভাষার আবিস্কার করেছেন, নতুন ছন্দের আবিস্কার করেছেন।সেই মাইকেল মধুসুধন দত্তের ভাষা বাংলা। যে বীর সন্যাসী অজও কস্ট স্বীকার করে এই বাংলার মাটি থেকে দুরুহ এক দীর্ঘ যাত্রা শেষে পৗছেছিলেন চিকাগোয় এবং বিশ্ব ধর্মমহাসম্মেলনে তোলে ধরেছিলেন ভারতবর্ষের উজ্জল রুপে তাঁরো মাতৃভাষা বাংলা।স্বামী বিবেকানন্দের মাতৃভাষা বাংলা।সমস্ত পৃথিবীতে যে সাহিত্যকে চিরায়ত ধরা হয় বাংলা থেকে দু একটি উদাহরন দিতে গেলে কথা অমৃতের না আসে।সেই শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের ভাষা বাংলা।এগুলো আমাদের গর্ব এগুলো আমাদের অহংকার।বাংলাভাষায় যারাগান গেয়েছেন,বাংলাভাষায় যারা নাটক করেছেন,বাংলা সাহিত্যে যারা চর্চা করেছেন,বাংলার কবিতাকে যারা সমৃদ্দ করেছেন,তাঁদের কথা ভাবলে গর্বে অহংকারে, আনন্দে আমাদের বুক ফুলে উঠে। কিন্তু যখন সামনের দিকে তাকাই যখন আমার পরবর্তী সময়টার দিকে তাকাই তখন দু:খহয়। আমি দুয়েকটি ছোট অভিজ্ঞতা আপনাদের সাথে ভাগ করে নেবো তাইলে বুঝতে পারবেন কোথায় এসে দাড়াচ্ছি।এই যে আজকে নানা কবিতার প্রতিযোগীতায় বিভিন্ন ছেলেমেয়ে জড়ো হয়েছেন,এতোগুলি ছেলে এক জাগায় জড়ো হয়ে কবিতা বলছেন,আজ থেকে কুড়ি বছর বাদে এটা সম্ভব হবেনা। কারন এখন যারা ছাত্র এখন যারা পড়ছেন তারাতো অরণ্যদেব নয়, তারাতো অতদিন বেঁচে থাকবেন না।এদের স্থলে কাউকে না কাউকে দায়িত্ব নিতে হবে। কিন্তু যিনি দায়িত্ব নেবেন তিনিতো এখন ক্লাস ফাইব সিক্রা এ পড়েন।তার কাছ থেকেতো বাংলাটাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।এই গোটা দেশ যারা পরিচালনা করেন তারা এমন একটা ব্যবস্থা তৈরী করেছেন যে লেখাপড়ার নাম করে শুধু চাকর হওয়া যায়।