মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :
কক্সবাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ পূণ: নির্মাণ কাজের পাইল ড্রপ করতে গিয়ে কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) ভবন ভয়াবহ ঝুঁকিতে রয়েছে। সিজেএম আদালতের বিচারপ্রার্থীদের ভীড় এড়াতে মামলার চার্জ (অভিযোগ) গঠন কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে সতর্কতামূলক “লাল নোটিশ” জারী করা হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা সদরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত কক্সবাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পুরাতন ভবনটি প্রায় ৪ বছর আগে ভেংগে ফেলা হয়েছে। ভেংগে ফেলার প্রায় সাড়ে ৩ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর পুরাতন মসজিদ ভবনের জমিতে নান্দনিক স্থাপত্য শৈলীতে একটি বহুমুখী মসজিদ কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। কক্সবাজার গণপূর্ত বিভাগ (PWD) এ নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করছে।
কক্সবাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ পূণ:নির্মাণ কাজে ৫০ ফুট লম্বা, ১৪ ইঞ্চি বাই ১৪ ইঞ্চি ব্যাসার্ধ সম্পন্ন ১৭৩ টি প্রিকাস্ট পাইল মাটিতে বোরিং করা হচ্ছে “ড্রপ হেমারিং” পদ্ধতিতে। ফাইল বোরিং এর কাজ শুরু হয়েছে গত ১২ মার্চ থেকে। প্রিকাস্ট পাইল বোরিং এর কাজ চলাবস্থায় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের চারপাশে থাকা ভবনগুলো ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠে। তারমধ্যে, কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভবন, কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ শপিং কমপ্লেক্স ভবন, জেলা জজের বাসভবন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের পূর্ব দক্ষিণ পাশ, কাস্টমস ও ভ্যাট অফিস ভবন, আইনজীবী সহকারী সমিতি ভবন রয়েছে। আবার এ ভবন গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ ঝুঁকিতে রয়েছে কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) ভবন।
পাইল বোরিং কাজ চলাবস্থায় সিজেএম ভবন প্রকম্পিত হয়ে ভবনে থাকা লোকজন চরম আতংকিত হয়ে পড়ে। এতে সিজেএম ভবনে স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছিল। তাই ফাইলিং কাজ শুরু হওয়ার পর গণপূর্ত বিভাগের প্রকৌশলী, কাজ বাস্তবায়নকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটি লোকজন চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল্লাহ আল মামুন এর সাথে সাক্ষাত করে কর্মদিবসে পিক আওয়ার সকাল ১১ টা থেকে বিকেল ৩ টা পর্যন্ত পাইল ড্রপ কাজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেন।
কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ নির্মাণ কাজে ড্রপ হেমারিং পদ্ধতিতে ফাইল বোরিং করায় প্রায় ৭১ বছর পূর্বে নির্মিত কক্সবাজার সিজিএম ভবনের বিভিন্ন জায়গায় মূল স্ট্রাকচারে ফাটল ধরেছে। প্লাসটার ঝড়ে পড়ছে। ভবনের বিভিন্ন জায়গা থেকে টুকরো টুকরো ভেংগে পড়ছে। ভবনটির ফেটে যাওয়া বড় অংশ যেকোন সময় ভেংগে গিয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটার আশংকাও রয়েছে।
ফলে বিচারক, বিচারপ্রার্থী, আইনজীবী, আইনজীবী সহকারী, ভবনে পেশাগত দায়িত্বে থাকা লোকজন সহ ভবনে আগত সর্বসাধারণের সতর্কতার জন্য কর্তৃপক্ষ লাল রংয়ের জরুরী বিজ্ঞপ্তি জারী করেছে।
নিন্মে জরুরী বিজ্ঞপ্তিটি তুলে ধরা হলো : “এতদ্বারা সকলের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, অত্র চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবনটি দীর্ঘদিনের পুরোনো, প্রায় ৭০/৮০ বছর পূর্বে নির্মিত। ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময়ে ভবনের ছাদ ভেঙ্গে পেলেস্তারা খসে পড়ার ঘটনা ঘটেছে এবং ভবনের প্রায় সকল পিলারে বড় বড় দৃশ্যমান ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে অত্র ভবনের পার্শ্বে নির্মাণাধীন কক্সবাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাইলিংয়ের কাজ চলাকালীন সময় অত্র ভবন ভূমিকম্পের মতো কেঁপে কেঁপে উঠছে এবং এতে ছাদের বিভিন্ন অংশ ভেঙ্গে পলেস্তারা খসে পড়ছে। এতে যেকোন মুহূর্তে বিচারপ্রার্থী জনগণ সহ যে কারো শরীরে পলেস্তারা পড়ে ভয়বহ দুর্ঘটনার সমুহ আশংকা রয়েছে। ইতিমধ্যে আমাদের অনুরোধে মসজিদ কর্তৃপক্ষ সকাল ১১ টা থেকে বিকেল ৩ টা পর্যন্ত পাইলিং বন্ধ রাখতে সম্মত হয়েছে। বর্ণিত বিষয় বিবেচনায় পবিত্র রমজান মাসে অত্র আদালতে চার্জ শুনানীর জন্য নির্ধারিত মামলা সমুহে চার্জ শুনানী সংক্রান্ত কার্যক্রম আপাতত বন্ধ থাকবে। অপরাপর মামলা সমুহে সাক্ষ্যগ্রহণ সহ অন্যান্য কার্যক্রম চলমান থাকবে। আদালত চলাকালীন সময়ে জনসমাগম কমানো এবং বিচারপ্রার্থী জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে এ বিজ্ঞপ্তি জারী করা হলো।”
দীর্ঘদিন ধরে নির্মাণকাজে জড়িত একজন অভিজ্ঞ প্রকৌশলী জানান, কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ এলাকাটি কক্সবাজার জেলা সদর। জেলা প্রাণকেন্দ্র। তাই কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ পূণ: নির্মাণ কাজে পাইল বোরিং ড্রপ হেমারিং পদ্ধতির পরিবর্তে ব্যয় একটু বেশি হলেও হাইড্রোলিক মেশিনের মাধ্যমে পাইল বোরিং করা প্রয়োজন ছিলো। তখন আশেপাশের স্থাপনা গুলো নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত থাকতো। কম্পনে মানুষ আতংকিত হতোনা।
অভিজ্ঞ উক্ত প্রকৌশলী বলেন, ড্রপ হেমারিং পদ্ধতিতে পাইল বোরিং পদ্ধতি অনেক পুরানো পদ্ধতি। বর্তমানে কোলাহলময় ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকার নির্মাণ কর্মে পাইল বোরিং কাজ ড্রপ হেমারিং পদ্ধতিতে সাধারণত হয়না। ড্রপ হেমারিং পদ্ধতিতে পাইল বোরিং করা হলে পাইল বোরিং গভীরতা ভেদে আশেপাশের ন্যুনতম ২০০ বর্গ মিটার পর্যন্ত এলাকা প্রকম্পিত হয়। ফলে পুরাতন ও হালকা স্ট্রাকচারে নির্মিত স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বর্ননা করেন। তিনি আরো বলেন, বেইজ টু বেইজ সয়েল টেস্ট করে মাটির ধরন বুঝে পাইল বোরিং করা যেতো। এতে কমন সাইজের পাইল বোরিং না করে যেখানে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু সাইজের পাইল বোরিং করলে ভাল হতো। তখন অর্থও সাশ্রয় হতো।
এ বিষয়ে কক্সবাজার গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ শাহজাহান এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কক্সবাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ পূণ:নির্মাণ কাজে পাইল বোরিং ড্রপ হেমারিং পদ্ধতির পরিবর্তে হাইড্রোলিক মেশিন মাধ্যমে পাইল বোরিং করা হলে নির্মাণ ব্যয় আরো ২৫ লক্ষ টাকা থেকে ৩০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যেতো। তিনি আরো জানান, প্রায় দেড় বছর আগে যখন টেস্ট বোরিং হিসাবে ৩ টি পাইল ড্রপ হেমারিং পদ্ধতিতে বোরিং করা হয়েছিল, তখন কোন সমস্যা হয়নি। মসজিদ পরিচালনা কমিটির লোকজন তখন বলেছিলেন, ড্রপ হেমারিং পদ্ধতিতে পাইল বোরিং করা হলে কোন সমস্যা হবেনা। মসজিদ পরিচালনা কমিটির সম্মতিতেই নির্মাণ কাজের প্রাক্কলনে ড্রপ হেমারিং পদ্ধতিতে পাইল বোরিং করার জন্য নির্মাণ কাজের প্রাক্কলন তৈরি করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রকল্প এলাকা ও আশেপাশের স্থাপনা গুলো এ পর্যন্ত ২ বার ভিজিট করেছি। এ পর্যন্ত বড় কোন সমস্যা হয়নি, ভবিষ্যতে হবে কিনা সেটা বলা যাচ্ছেনা। চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবনটি পুরাতন স্থাপনা হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আশেপাশের অন্যান্য স্থাপনা গুলোর মূল স্ট্রাকচারের কোন ক্ষতি হয়নি। ব্রিক ওয়ার্কের কিছু ক্ষতি হয়েছে। নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ শাহজাহান আরো বলেন, কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন ১৯৫২ সালে নির্মিত একটি ভবন। নির্মাণের ৫০ বছর পর ভবন আর ব্যবহার যোগ্য থাকেনা। তারপরও চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবনটি সরকারি কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।
“মসজিদ কমিটির সম্মতিতে ড্রপ হেমারিং পদ্ধতিতে পাইল বোরিং করার জন্য নির্মাণ কাজের প্রাক্কলন তৈরি করা হয়েছে” এ প্রসঙ্গে নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ শাহজাহান এর বক্তব্যের জবাবে মসজিদ পরিচালনা কমিটির কর্মকর্তারা জানান, এসব ট্যাকনিক্যাল বিষয়, এসবে আমাদের সম্মতি অসম্মতির কোন কিছুই নেই। এলাকার গুরুত্ব, জমির ধরন ও সয়েল টেস্ট বিবেচনায় যেটা প্রয়োজন, সেটা অন্তর্ভুক্ত করে গণপূর্ত বিভাগের প্রাক্কলন তৈরি করা উচিত ছিল। সেটা হলে আর বর্তমানের ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতোনা।
কক্সবাজার গণপূর্ত বিভাগের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী মোঃ আরিফুর রহমান জানান, কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ নির্মাণ কাজে প্রতিদিন ৭/৮ টি পাইল বোরিং করা হচ্ছে। মোট ১৭৩ টি প্রিকাস্ট পাইল এর মধ্যে ৩১ মার্চ পর্যন্ত ৮৮ টি পাইল ড্রপ হেমারিং পদ্ধতিতে বোরিং করা হয়েছে। অবশিষ্ট ৮৫ টি পাইল পরবর্তী ১৬/১৭ দিনের মধ্যে বোরিং সম্পন্ন করা হতে পারে বলে তিনি জানান। কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ভবনটি অতি পুরাতন ও ব্যবহার অযোগ্য। তাই কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে পাইল বোরিং এর কাজ চলাবস্থায় ভবনটি সার্বক্ষনিক দেখভাল করা হচ্ছে।
কক্সবাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট নেজামুল হক জানান, ঝুঁকিপূর্ণ জমিতে পাইল বোরিং প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। মসজিদের আশেপাশের স্থাপনা গুলোর ঝুঁকি অনেকটা কমে এসেছে। অবশিষ্ট পাইল গুলো বোরিং করতে খুব একটা সমস্যা হবেনা বলে তিনি গণপূর্ত বিভাগের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীর উদ্ধৃতি দিয়ে জানান।
কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (ভা:) মোহাম্মদ আশেক এলাহী শাহজাহান নুরী বলেন, কাজের চাপে বিজ্ঞ বিচারক সহ সকল পর্যায়ের স্টাফদের সকাল ৯ টা থেকে রাত প্রায় ৮ টা পর্যন্ত অফিসে থাকতে হয়। কক্সবাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের নির্মাণ কাজে পাইল বোরিং এর কাজ চলাবস্থায় পুরো সিজেএম ভবন ভূমিকম্পের মতো প্রকম্পিত থাকে। এ অবস্থায় আমরা সবসময় আতংকিত থাকি। তিনি আরো বলেন, এ বিষয়ে সতর্কতামূলক বিজ্ঞপ্তি জারী করা ছাড়াও জেলা ও দায়রা জজ মহোদয়কে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে।
এদিকে, কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে কর্মরত আতংকিত একজন স্টাফ বলেন, সিজেএম ভবনে কাজ করতে গিয়ে ভবন ভেঙ্গে কখন ভয়বহ দুর্ঘটনার শিকার হই, তা নিয়ে সবসময় উদ্বিগ্ন থাকি। উক্ত স্টাফ আরো বলেন, সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় পরিবার পরিজন থেকে “শেষ বিদায়” নিয়ে আসি। এসময় বাড়ির সদস্যরাও আমাদের নিয়ে চরম উৎকন্ঠায় থাকে।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।