মনিকা বেগ
অনেক বছর পশ্চিমা বিশ্বে থাকার সুবাদে জানি, ওখানে একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর বৃদ্ধাশ্রমে বা অ্যাসিস্টেড লিভিং ফ্যাসিলিটিতে যাওয়া খুব সাধারণ একটি ব্যাপার, বিশেষ করে কেউ যখন তাঁর নিজের কাজগুলো আর নিজে করতে পারেন না।
তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বৃদ্ধাশ্রমে তাঁরা নিজের ইচ্ছাতেই যান। তার কারণ বিবিধ। অনেকে এতটাই স্বাধীনচেতা যে বৃদ্ধ বয়সেও ছেলে-মেয়ে বা পরিবারের অন্য কারও ওপর নির্ভরশীল হতে চান না। কেউ কেউ হয়তো বিয়েই করেননি বা সন্তান নেননি বা সঙ্গী বেঁচে নেই, তাই একাকিত্বে ভোগেন। কারও কারও ছেলেমেয়েরা হয়তো তাঁদের জীবন-জীবিকা নিয়ে এত ব্যস্ত, বৃদ্ধ মা-বাবাকে চাইলেও কাছে রাখার উপায় নেই। তা ছাড়া উন্নত দেশগুলোতে, বাসায় একজন দক্ষ সেবা প্রদানকারী রাখা প্রচণ্ড ব্যয়সাধ্য ব্যাপার। বেশির ভাগ মানুষের পক্ষেই সেই ব্যয় বহন করা সম্ভব নয়।
কিন্তু বৃদ্ধাশ্রমে থাকলে, একদিকে যেমন তাঁদের থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা করতে হয় না, অন্যদিকে তেমনই তাঁরা পেয়ে যান অনেক সমবয়সী বা কাছাকাছি বয়সের মানুষদের, যাঁদের সঙ্গে তাঁদের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। অবসরে গল্পগুজব, সুখ-দুঃখের আলাপ করে সময় কাটে। আবার নিয়মিতভাবে বয়স এবং স্বাস্থ্য উপযোগী বিভিন্ন রকম ব্যায়াম, খেলাধুলা, ভ্রমণ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকেন তাঁরা। নির্দিষ্ট সময়ে, বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবেরা আসেন দেখা করতে। সঙ্গে নিয়ে আসেন তাঁদের পছন্দের খাবার বা অন্য কোনো উপহার। সব মিলিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে তাঁরা আনন্দেই থাকেন।
ভিয়েনাতে আমাদের বাড়ির কাছেই একটি বৃদ্ধাশ্রম আছে। আসা-যাওয়ার পথে মাঝেমধ্যেই সুযোগ হয় সেখানকার প্রবীণ বাসিন্দাদের দৈনন্দিন কার্যক্রম দেখার। এত ভালো লাগে দেখে যে, আমি নিজেও বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাব বলে ঠিক করেছি, যদি তত দিন বেঁচে থাকি।
তবে আমাদের দেশের কথা আলাদা। আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রমকে এখনো নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। কোনো মা-বাবা তাঁদের নিজের ইচ্ছায় বৃদ্ধাশ্রমে গেছেন, এমনটি শুনিনি। তার যথেষ্ট কারণও আছে।
আমাদের দেশের সামাজিক ও পারিবারিক প্রেক্ষাপটে, যেখানে সামাজিক ও পারিবারিক নেটওয়ার্কগুলো উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব বহন করে, সেখানে প্রবীণদের কাছে বৃদ্ধাশ্রম মানেই একটি জেলখানা। তাঁরা মনে করেন, বৃদ্ধাশ্রমে গেলে তাঁদের বাকি জীবন প্রিয়জন এবং চিরপরিচিত সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকী বা পরিত্যক্ত অবস্থায় কাটবে।
দশের লাঠি
যুগ যুগ ধরে আমাদের একান্নবর্তী পরিবারগুলোতে মা-বাবা, বড় দাদা-বড় দাদি, দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, অবিবাহিত ফুফু, বিধবা ফুফু, চাচাতো-ফুপাতো ভাইবোন, তাঁদের ছেলেমেয়েরা একই ছাদের নিচে বসবাস করে আসছিলেন। তার ফলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, ভালোবাসা ও ঐক্যের বোধ সৃষ্টি হতো। শুধু তা-ই নয়, এ ধরনের পরিবার কাঠামোতে, পরিবারের অপেক্ষাকৃত নবীন সদস্যরা যৌথভাবে পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের যত্ন নিতেন। কারও একার ওপর তাঁদের দেখাশোনা করার চাপ পড়ত না। যে কারণে, পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে তাদের আলাদা করার ধারণা শুধু অকল্পনীয়ই ছিল না, ‘মহাপাপ’ হিসেবে গণ্য হতো।
কিন্তু সেই পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। শহরাঞ্চলে তো নয়ই, গ্রামাঞ্চলেও তেমন একান্নবর্তী পরিবার এখন খুব একটা দেখা যায় না। এখনকার পরিবারগুলো অধিকাংশই মা-বাবা এবং সন্তানদের নিয়ে একক পরিবার। অথবা খুব বেশি হলে মা-বাবা, সন্তান এবং দাদা-দাদিকে নিয়ে বর্ধিত একক পরিবার, যেখানে যৌথ পরিবারের মতো প্রবীণদের সেবা-যত্ন করার দায়িত্ব ভাগাভাগি করার মতো কেউ থাকে না।
আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, আগেকার একান্নবর্তী পরিবারে তো প্রশ্নই আসে না, এখনকার বর্ধিত একক পরিবারেও নানা-নানির সাধারণত জায়গা হয় না। যদি আর কোনো উপায় না থাকার কারণে তাঁরা জায়গা পানও, দাদা-দাদির মতো আদর সম্মান পান না, যদি না মা নিজে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হন এবং পরিবারে তার নিজের অধিকার আদায় করে নিতে জানেন।
মূল্যবোধের ঢেঁকি
আমাদের সংস্কৃতিতে এখনো একক বা একক বর্ধিত পরিবারে, বৃদ্ধ মা-বাবার যত্ন নেওয়া, তাঁদের শারীরিক, মানসিক এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান করা প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের জন্য একটি নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করা হয়। যে কারণে কোনো সন্তান যদি মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠান, সেটিকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং পারিবারিক ভাবে সন্তানের দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এমন সন্তানদেরও দেখেছি, যাঁরা নিজেদের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও উপযুক্ত চিকিৎসা এবং যত্নের অভাবে অন্ধ হয়ে যাওয়া অসহায় বিধবা মাকে নিজেদের কাছে তো রাখেনই না, সামাজিক ও পারিবারিক কলঙ্কের ভয়ে তাঁকে বৃদ্ধাশ্রমেও দেন না।
চোখের আড়াল মানেই মনের আড়াল
আমাদের দেশের সামাজিক ও পারিবারিক প্রেক্ষাপটে, যেখানে সামাজিক ও পারিবারিক নেটওয়ার্কগুলো উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব বহন করে, সেখানে প্রবীণদের কাছে বৃদ্ধাশ্রম মানেই একটি জেলখানা। তাঁরা মনে করেন, বৃদ্ধাশ্রমে গেলে তাঁদের বাকি জীবন প্রিয়জন এবং চিরপরিচিত সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকী বা পরিত্যক্ত অবস্থায় কাটবে। ভয় পাওয়ার অবশ্য যথেষ্ট কারণও আছে। প্রায়ই পত্রপত্রিকায় দেখা যায়, কীভাবে সচ্ছল বা ধনী পরিবারের সন্তানেরাও মা-বাবার সম্পত্তি নিজেদের নামে লিখিয়ে নিয়ে, বেড়ানোর নাম করে তাঁদের বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে। তারপর সেই মা-বাবার আর খোঁজখবর তো নেনই না, মৃত্যুর সংবাদ পেলেও শেষ দেখাটা পর্যন্ত দেখতে আসার প্রয়োজন মনে করেন না।
সচেতনতা ও আস্থার অভাব
সঠিক ও পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্তের অভাবে, বৃদ্ধাশ্রম এবং সেখানকার সুযোগ-সুবিধা, অসুবিধা ইত্যাদি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা খুবই সীমিত এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনুমাননির্ভর। হাতে গোনা কিছু ছাড়া, অধিকাংশ বৃদ্ধাশ্রমেই সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাশিত মানের নয়। আমার জানা মতে, দেশের প্রায় সব কটি বৃদ্ধাশ্রমেই থাকার জন্য একটি মাসিক ফি দিতে হয়। যত বেশি ফি, সেবার গুণগত মান তত উন্নত। যে কারণে স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোর প্রবীণদের জন্য নিম্নমানের বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
অনুপযুক্ত অবকাঠামো, নার্স এবং পরিচর্যাকারীসহ প্রশিক্ষিত কর্মীদের ঘাটতি, নিম্ন মানের খাদ্য, অপর্যাপ্ত শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, বিনোদনমূলক এবং সামাজিক কার্যক্রমের অভাব, এমনকি প্রবীণদের প্রতি দুর্ব্যবহার, অবহেলা এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কিছু কিছু ঘটনা মাঝেমধ্যেই বৃদ্ধাশ্রমগুলোর উঁচু দেয়ালের ফাঁকফোকর গলিয়ে জনসমক্ষে বেরিয়ে আসে। তাতে বৃদ্ধাশ্রম সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের মনে যে নেতিবাচক ধারণা আছে, সেটি আরও পাকাপোক্ত হয়।
প্রবীণ আনন্দাশ্রম
দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা ও পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তন হওয়ার এবং গড় আয়ু বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমাজের প্রবীণ সদস্যদের জন্য মানসম্পন্ন যত্ন এবং সহায়তা প্রদানকারী বৃদ্ধাশ্রম বা অ্যাসিস্টেড লিভিং ফ্যাসিলিটির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার দিন শেষ।
তবে শুধু প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেই হবে না। এর জন্য দরকার, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, সুস্পষ্ট নিয়ন্ত্রণ কাঠামো এবং নির্দেশিকা, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বৃদ্ধাশ্রম স্থাপন এবং সেগুলোর কঠোর তদারকি, পর্যবেক্ষণ এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে দক্ষ জনবল।
একই সঙ্গে বৃদ্ধ বয়সের যত্ন, বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন আনতে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে।
তবেই বৃদ্ধাশ্রমগুলো পরিণত হবে প্রবীণদের আনন্দাশ্রমে।
এখানে উল্লেখ্য যে বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্বের, বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, প্রবীণদের সেবা প্রদানে দক্ষ কর্মীদের প্রচুর চাহিদা আছে। ভারত, ফিলিপাইন এবং পূর্ব ইউরোপ সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। আমরাও কিন্তু সেই সুযোগ নিতে পারি।
মনিকা বেগ সাবেক প্রধান ও বৈশ্বিক সমন্বয়ক, এইডস সেকশন, জাতিসংঘ সদর দপ্তর, ভিয়েনা, অস্ট্রিয়া