-কবির হোসেন
বাঙালি, বাংলাভাষা ও ব-দ্বীপখ্যাত বাংলাদেশ একসূত্রে গাঁথা। এর যেকোন একটি শব্দ শুনলেই ইতিহাস আর ঐতিহ্যের কথা মনে পড়ে। পৃথিবীতে যত জাতী গোষ্ঠী আছে, সবাই কম বেশী তাদের পূর্বপুরুষের ইতিহাস টিকিয়ে রাখার চেষ্ঠা করে। তবে এই ক্ষেত্রে বাঙালিরা একটু এগিয়ে। উঠতে বসতে কিংবা ঘুমানো থেকে সর্বক্ষেত্রেই বাঙালিয়ানা না দেখাতে পারলে যেন কিছুই মন মত হলোনা একটা ভাব থাকে আমাদের মধ্যে।
মনুষ্যত্বের অভাব থাকলেও কোন কোন ক্ষেত্রে বাঙালির মত এতটা আবেগপ্রবণ জাতী বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই বলে প্রতীয়মান হয়। যেমন ধরুন ফাল্গুন মাসে জন্মাইছে বলে মেয়েটির নাম বাবা-মা রেখেই দিল ফাল্গুনী। কেউ তো জাতীর জনকের নামানুসারে সন্তানের নাম রেখে দেয় শেখ মুজিবর রহমান। আর ১৯৭১ সাল। আহা! সে-তো আমাদের আবেগের চূড়ান্ত জায়গা। আঙ্কেল, আপনার নাম বাঙ্গালী কেন? বাবা, আমার জন্ম যে, একাত্তরে।
মুঘল আমল থেকেই এই দেশ তথা ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গার নামকরণ তৎকালীন বিখ্যাত ও্ ক্ষমতাধর ব্যক্তির নামে নামকরণ করা হয়েছে। ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভের পর আমাদের এই বাংলাদেশ, তথা পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানের নামকরণ বিভিন্ন বনিয়াদি ব্যক্তির নামে নামকরণ করা হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান আমলের পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যক্তিদের সাথে জড়িত সমস্ত স্থান, রোড ও প্রতিষ্টানের নাম পরিবর্তন করা শুরু হয়। যা স্বাধীনতা অর্জনের এই ৫০ বছর পরেও চলমান রয়েছে। অচিরেই এই পরিবর্তনের কাজ সমাপ্ত হবে।
মুক্তিযুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলসমূহের বিশেষ সম্মানে অনেক স্থানের নামকরণ করা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামানুসারে। বিজয় কিংবা জয় এই শব্দটা বাঙালির মনে খুব ভালোভাবেই গেঁথে যায়। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত অনেক স্থান (হাট-বাজার ও মোড়) স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জয় বাংলা হাট, জয় বাংলা বাজার ও জয় বাংলা মোড় নামে লোকমুখে ছড়াতে ছড়াতে এক সময় নামগুলো স্বীকৃত লাভ করে।
এবার আসি বাঙালির অতি আবেগের জায়গায়। বাজারের নাম বাঙ্গালী বাজার। গুগল ম্যাপে স্থানটা নজড়ে আসতেই বুকের মাঝে কেমন যেন একটা ভালো লাগা কাজ করলো। দেশের প্রতি একটা ভালোবাসা দেখতে পেলাম। জয় বাংলা বাজার নামে কয়েকটা ঐতিহাসিক বাজার আছে বাংলাদেশে। এই স্থানটাও নিশ্চয়ই ঐতিহাসিক। কি তার ইতিহাস? এটা অনুসন্ধানে নেমে পড়লাম।
উত্তরবঙ্গের রাজধানী খ্যাত বগুড়া। বগুড়া জেলার দুপচাঁচিয়া উপজেলার একটি বাজারের নাম বাঙ্গালী বাজার। জেলার জিরোপয়েন্ট সাতমাথা হতে ২৭ কিলোমিটার দূরে দুপচাঁচিয়া উপজেলার চৌমুহনী বাজার। এই বাজারের বীরগ্রাম-চৌমুহনী রোডে ৫.২ কিলোমিটার উত্তরে এই বাজারের অবস্থান। মসৃণ পিচ বিছানো রাস্তা হওয়ায় যাত্রাপথটা বেশ আরামের। ঢাকাসহ দেশের যেকোন প্রান্ত থেকে খুব সহজেই আসতে পারবেন এখানে। যদি রিজার্ভ বা ব্যক্তিগত গাড়িতে না আসেন। তবে চলে আসুন চারমাথা বাস টার্মিনাল। সেখান থেকে নওগাঁ যাওয়ার মেইল বাসে উঠে পড়ুন। টিকিট নিবেন চৌমুহনী যাওয়ার। ত্রিশ টাকা জনপ্রতি টিকিট। লোকাল বাসেও একই ভাড়া পড়বে। আধা ঘন্টা লাগবে সর্বোচ্চ। চৌমুনী থেকে উত্তরের রাস্তায় ভ্যানগাড়ি কিংবা সিএনজি যোগে খুব সহজেই যেতে পারবেন এই বাজারে। জনপ্রতি বিশ টাকার বেশি ভাড়া নয়।
বাঙ্গালী বাজারে সৈয়দ মীর মহীউদ্দিন হযরত বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ) এর খানকা শরীফ অবস্থিত। বাজার সংলগ্ন একটি কবরস্থান ও বাজারের অদূরে ঝাঁজিড়া জামে মসজিদ। মূলত এই বাজারটি ঝাঁজিড়া গ্রামে অবস্থিত। বাঙ্গালী বাজারে ফার্মেসী, কয়েকটি চা স্টল ও মনোহারীর দোকান রয়েছে। এই বাজারের দুধ চা বিখ্যাত।
এই উপজেলার গুনাহার ইউনিয়নের গুনাহার জমিদার বাড়ী ওরফে সাহেব বাড়ী দেখা শেষ করে চলে এলাম বাঙ্গালী বাজার। বাঙ্গালী বাজার ও গুনাহার জমিদার বাড়ীর দূরত্ব খুব বেশী নয়। তাই কেউ ঘুরতে এলে এই বাজারের পাশাপাশি জমিদার বাড়ী থেকেও ঘুরে আসতে পারেন। কিংবা জমিদার বাড়ী দেখতে এলে এই বাজার থেকেও ঘুরে যেতে পারেন। আর বাঙ্গালী ভাইয়ের চায়ের দোকান থেকে এককাপ দুধ চা খেতে ভুলবেন না। বাঙ্গালী ভাই আবার কে? মজার বিষয়টা এখানে!
গুনাহার জমিদার বাড়ী ভ্রমণ শেষ করে চলে এলাম বাঙ্গালী বাজার। বাজারটা খুবই ছোট। কোথাও কোন নামফলক বা সাইনবোর্ড নেই। দু’একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম একাত্তর বা কোন ইতিহাস থেকে নামকরণ হয়নি এই বাজারের। কথাটা শুনে হতাশ হলাম। এই বাজারের এক চা বিক্রেতা বাঙ্গালী। তার নামানুসারেই বাঙ্গালীর বাজার, বাঙ্গালী বাজার (লোকমুখে বাংলা বাজার)। এবার একটু আশার আলো ফুটল। নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কিছু সামনে অপেক্ষা করছে। তড়িঘড়ি করে ছুটলাম বাঙ্গালী ভাইয়ের চায়ের দোকানে।
অমায়িক ব্যবহার এই বাঙ্গালী ভাইয়ের। মুখে হাসি লেগেই থাকে। পুরো নাম মোঃ নাজির। বয়স ৫০ বছরের কম বা একটু বেশী। ঠিক মনে করতে পারলেন না নিজের বয়স। ডাকনাম বাঙ্গালী। এই নামটা চা খেতে আসা মানুষের দেওয়া। ঘটনাটা বেশী দিন আগের নয়। দশ-বারো বছর আগের। তখন এখানে কোন বাজার ছিল না। জীবিকার তাগিদে রাস্তার পাশে মোঃ নাজির ওরফে বাঙ্গালী একটা চা স্টল খুলে বসেন। সেখানে টিভিতে সিনেমা চলে, খবর চলে। দেশ-বিদেশের খবর। পাশাপাশি গ্রামের সহজ সরল মানুষের আনাগোনা ও চা আড্ডা। দিনে দিনে মানুষের আনাগোনা বাড়ে। কোন এক সিনেমার মূল চরিত্র ছিল বাঙ্গালী (নায়ক)। সেদিন থেকে মোঃ নাজির এর নামই হয়ে যায় বাঙ্গালী। লোকে বলে চল্ যাই, বাঙ্গালীর দোকান থেকে চা খেয়ে আসি। কেউ বলে বাঙ্গালীর বাজারে যাই। আস্তে আস্তে দু’একজন পাশাপাশি দোকান খুলে বসে। মনোহারীর দোকান, ফার্মেসীর দোকান ও ছোট ছোট অন্যান্য দোকান। প্রতিষ্ঠা লাভ করে একটি বাজারের। ব্যবসায়িক সমিতি প্রতিষ্ঠাও হয়েছিল। কিন্তু সেটি বর্তমানে নেই। সমিতি নিয়ে আপত্তি ছিল মোঃ নাজির এর। তিনি চেয়েছিলেন অলাভজনক সমিতি। যেখানে সুদের কারবার নয়, বরং বছর শেষে যে লভ্যাংশ অর্জিত হবে তা দ্বারা পিকনিক কিংবা ভ্রমণ করবেন তারা। আনন্দ করবেন। হালাল ব্যবসা করে যেতে চান তিনি। বাজারের চায়ের দোকানগুলোতে চা এর পাশাপাশি হালকা নাস্তার পরাটা, রুটি ও পিয়াজু ইত্যাদি তৈরি হয়। এই বাজারে চা কাপে নয়, বরং কাচের গ্লাসে চা পরিবেশন করা হয়। যা আপনার কাছে নতুনত্ব মনে হবে।
দিনে দিনে বাজারের পরিধি বাড়ছে। এই বাজার সংলগ্ন মাজার ও কবরস্থান থাকায় সারাদিন লোকজনের আনাগোনা থাকে। রাত নয়টা-দশটা পর্যন্ত দোকান খোলা থাকে এই বাজারে। সময় করে একদিন আপনিও ঘুরে আসুন এই বাজার থেকে। অন্তত গ্রামীণ বাংলার এই বাঙ্গালী বাজার স্মৃতির পাতায় একটা আঁচর কাটবে। ভালো লাগবে নিঃসন্দেহে। দেশের প্রতি একটু মমত্ববোধ জাগবে।
লেখক পরিচিতিঃ কবি ও গল্পকার Kabirhossain02021998@gmail.com