দুলাল আচার্য

আজ বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ৯৪তম জন্মদিন। পিতা শেখ জহুরুল হক চাকরিসূত্রে যশোর থাকায় দাদা শেখ কাশেমের ছোট সংসারে মা ও বড় বোনের স্নেহছায়ায় তাঁর বেড়ে ওঠা। মাত্র তিন বছর বয়সে তিনি বাবা এবং পাঁচ বছর বয়সে মাকে হারান। দাদা শেখ কাশেম শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কৈশোর বয়সেই বেগম ফজিলাতুন নেছার বিয়ে দেন। তখন থেকে শাশুড়ি (বঙ্গবন্ধুর মা) সায়েরা খাতুন ফজিলাতুন নেছাকে নিজের সন্তানদের সঙ্গে মাতৃস্নেহে লালনপালন করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন নেছা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নেপথ্যচারিণী ও প্রেরণাদায়িনী মহীয়সী। আওয়ামী লীগসহ এদেশের সাধারণ মানুষের কাছে বঙ্গমাতা হিসেবেই তিনি সমধিক পরিচিত। বেগম মুজিব মনেপ্রাণে একজন আদর্শ বাঙালি নারী ছিলেন। স্বামীর রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। এককথায়, তিনি অনুপ্রেরণা, শক্তি, সাহস, মনোবল ও প্রেরণা জুগিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

মহীয়সী এই নারী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে দেশ ও জাতির সেবা করে গেছেন। শান্ত স্বভাবের শেখ ফজিলাতুন নেছা স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও এবং খুব অল্প বয়স থেকে রাজনীতির সঙ্গে স্বামীর গভীর সাহচর্য দেখতে দেখতে এক রাজনৈতিক সচেতন নারীর চিরায়ত রূপ ধরা পড়ে তাঁর চরিত্রে। ছাত্ররাজনীতি করতে গিয়ে যখনই বঙ্গবন্ধুর অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হতো, তখনই পিতার সম্পত্তি থেকে অর্জিত অর্থ বিনা দ্বিধায় জোগান দিতেন। একদিকে সন্তানদের সামলে রাখা, অন্যদিকে কারাগারে গিয়ে স্বামীর মনোবল দৃঢ় করা কিংবা আইনজীবীর কাছে মামলার খোঁজখবর সবকিছু করতেন এক হাতে। এত বড় নেতার স্ত্রী হয়েও ছিলেন খুবই সাধারণ একজন মানুষ।

তিনি একজন মহীয়সী নারী বলেই নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, পরিবারের স্বার্থের কথা না ভেবে মানুষের মুক্তির কথা ভেবেছিলেন। নিজের সন্তানদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। দেশের কল্যাণে সর্বোচ্চ সংগ্রাম করতে দেশবাসীকে শিখিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলে তাঁর আইনজীবী নিয়োগ, মামলা চালানোর খরচ, কোর্টে যাওয়া এমন খারাপ পরিস্থিতিতেও তিনি নিজে রান্না করে কারাগারে নিয়ে যেতেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাতের সময় তাকে বাইরের সবকিছু বিস্তারিত জানিয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের কাছে পৌঁছে দিয়ে তা কার্যকর করতেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে বাড়িতে দলের সভা পরিচালনা, দলের খরচ যোগানো, দলের নেতাকর্মীদের রান্না করে খাওয়ানোসহ সকল কাজ বঙ্গমাতা পরম মমতার সাথে পালন করতেন। উল্লেখ্য, মামলার খরচ ও সংগঠনের খরচ যোগাতে নিজের গহনা, ঘরের ফ্রিজও বিক্রয় করেছিলেন তিনি। আমরা জাতির পিতার পাশাপাশি একজন মাকেও পেয়েছি। যিনি শেখ মুজিবের যোগ্য সহধর্মিণী হওয়ার পাশাপাশি তিনি একজন রতœগর্ভা মা। যিনি সকল ঝড়-ঝাঁপটা, আন্দোলন সংগ্রামের মাঝেও সন্তানদের সুশিক্ষা দিতে ভুলে যাননি।

বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও অনেকবার শেখ ফজিলাতুন নেছার কথা উল্লেখ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিভিন্ন সময়ে দেওয়া বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর পেছনে অনুপ্রেরণাদায়ী হিসেবে শেখ ফজিলাতুন নেছার কথা তুলে ধরেছেন।

শেখ ফজিলাতুন নেছা (ডাকনাম রেণু) জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩০ সালের এই দিন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স ৯৩ পূর্ণ হতো। তাঁর পিতা শেখ জহুরুল হক ও মা হোসনে আরা বেগম। তাঁর পিতা শেখ জহুরুল হক ছিলেন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর চাচা। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যখন রেণুর বিয়ে হয়, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র তিন বছর। বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বিয়ের ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন এভাবেÑ‘একটা ঘটনা লেখা দরকার, নিশ্চয়ই অনেকে আশ্চর্য হবেন। আমার যখন বিবাহ হয়, তখন আমার বয়স বারো-তেরো বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাওয়ার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন যে, আমার সাথে তার এক নাতনির বিবাহ দিতে হবে। কারণ তিনি তাঁর সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাবেন।’… রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরুব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হলো। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধ হয় তিন বছর হবে। রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স, তখন তার মা হোসনে আরা বেগম মারা যান। একমাত্র রইল তার দাদা। রেণুর সাত বছর বয়সে দাদাও মারা যান। তারপর সে আমার মায়ের কাছে চলে আসে। রেণুদের ঘর আমার ঘর পাশাপাশি ছিল, মধ্যে মাত্র দুই হাত ব্যবধান।’

কারাগারের রোজনামচায় স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন নেছাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন বঙ্গবন্ধু। পরিবারের বিরহে কাতর হয়ে তিনি লিখেছেনÑ ‘৮ ফেব্রুয়ারি ২ বৎসরের ছেলেটা এসে বলে, ‘আব্বা বালি চলো। কী উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম, ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।’ ও কি বুঝতে চায়! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখে নাই। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।’

বঙ্গবন্ধু আরো লিখেছেনÑ‘জেল গেটে যখন উপস্থিত হলাম ছোট ছেলেটা আজ আর বাইরে এসে দাঁড়াইয়া নাই দেখে একটু আশ্চর্যই হলাম। আমি যখন রুমের ভেতর গিয়ে ওকে কোলে নিলাম, আমার গলা ধরে ‘আব্বা আব্বা’ করে কয়েকবার ডাক দিয়ে ওর মার কোলে যেয়ে আব্বা-আব্বা করে ডাকতে শুরু করল। ওর মাকে আব্বা বলে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপার কি? ওর মা বলল, বাড়িতে আব্বা আব্বা করে কাঁদে, তাই ওকে বলেছি আমাকে আব্বা বলে ডাকতে। রাসেল আব্বা আব্বা ডাকতে লাগল। যেই আমি জবাব দেই সেই ওর মার গলা ধরে বলে, তুমি আমার আব্বা। আমার ওপর অভিমান করেছে বলে মনে হয়। এখন আর বিদায়ের সময় আমাকে নিয়ে যেতে চায় না।’

পরিবারের অর্থকষ্টের কথাও বঙ্গবন্ধুর লেখায় উঠে এসেছে। স্ত্রী ফজিলাতুন নেছার আত্মত্যাগের কথা বলতেও বঙ্গবন্ধু ভোলেননি। তিনি লিখেছেনÑ‘কোম্পানি আজও আমার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা দেয় নাই, তাই একটু অসুবিধা হতে চলেছে বলে রেণু বলল। ডিসেম্বর মাসে আছি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি, চার মাস হয়ে গেল, আজও টাকা দিল না! আমি বললাম, জেল থেকে টেলিগ্রাম করব। প্রথম যদি না দেয়, তবে অন্য পন্থা অবলম্বন করব। আমার টাকা তাদের দিতেই হবে। কোনোমতে চালাইয়া নিয়ে যাও, বাড়ির থেকে চাউল আসবে, নিজের বাড়ি, ব্যাংকেও কিছু টাকা আছে, বছর খানেক ভালভাবেই চলবে, তারপর দেখা যাবে। …‘যদি বেশি অসুবিধা হয়, নিজের বাড়ি ভাড়া দিয়ে ছোট বাড়ি একটা ভাড়া করে নিব’, রেণু বলল। রেণু বলল, ‘চিন্তা তোমার করতে হবে না।’ সত্যই আমি কোনদিন চিন্তা বাইরেও করতাম না, সংসারের ধার আমি খুব কমই ধারি।’

বঙ্গবন্ধু তাঁর কারাগারের রোজনামচা বইয়ের অগণিত স্থানে সহধর্মিণীর প্রতি গভীর ভালোবাসা, আস্থা, বিশ্বাস ও পরম নির্ভরতার কথা তুলে ধরেছেন। তিনি এক জায়গায় দুঃখ করে লিখেছেন : ‘নিষ্ঠুর কর্মচারীরা বোঝে না যে স্ত্রীর সাথে দেখা হলে আর কিছু না হউক একটা চুমু দিতে অনেকেরই ইচ্ছা হয়, কিন্তু পায় কী? আমরা তো পশ্চিমা সভ্যতায় মানুষ হই নাই। তারা তো চুমুটাকে দোষণীয় মনে করে না। স্ত্রীর সাথে স্বামীর অনেক কথা থাকে কিন্তু বলার উপায় নাই।’

বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা স্বামীকে জেলে রেখে বছরের পর বছর সন্তানদের নিয়ে অবর্ণনীয় কষ্ট করেছেন কিন্তু তবুও দেশের জনগণের মুক্তি, দেশের স্বাধীনতা ও একটি সুন্দর ভবিষৎতের জন্য সংগ্রাম করেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেছেন, তিনি যেন পরিবারের কথা চিন্তা না করে গোটা জাতির মুক্তির এবং স্বাধীনতার কথা চিন্তা করেন।

মায়ের মানবিকতা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর এক বক্তব্যে বলেছেন- ‘বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন, লড়াই, সংগ্রামে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে কিন্তু কখনো মাকে ভেঙ্গে পড়তে দেখিনি। যতো কষ্টই হোক আমার বাবাকে কখনোই বলেননি যে তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও বা সংসার করো বা খরচ দাও। আব্বা যে পদেক্ষেপ নিতেন সেটাকেই সমর্থন করতেন তিনি।’

আসলে ফজিলাতুন নেছা মুজিব কেবল বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী ছিলেন না। ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জীবনের এক নি:স্বার্থ সহচর। যিনি সবসময় জাতির পিতাকে লড়াইয়ের জন্য সাহস জুগিয়েছেন, জীবনের সকল যুদ্ধে ছিলেন তাঁর সহযোদ্ধা। প্রায় ৪ দশকের দাম্পত্য জীবনে বেগম মুজিব ভালোবেসে তাঁর স্বামীর সংগ্রামমুখর, ঝুঁকিপূর্ণ জীবনে সঙ্গী ছিলেন। শুধু পারিবারিক জীবন নয়; বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনে ঝুঁকি ও সংকটকালীন মুহূর্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বেগম মুজিব নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছেন। বেগম মুজিবের রাজনৈতিক পরামর্শ বঙ্গবন্ধু গ্রহণ করেছেন এমন দৃষ্টান্ত অনেক। আসলে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ যেমন একই সূত্রে গাঁথা, তেমনি বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গমাতা- দুটি দেহ যেন একই আত্মা।

১৯৭৫ সালের কলঙ্কিত ১৫ আগস্ট রাতে পরিবারের অন্য সদস্যের সঙ্গে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছাও ঘাতকের গুলিতে নিহত হন। ইতিহাসের এই নিষ্ঠুরতম হত্যাকা-ের সময়ও বঙ্গবন্ধুর আজীবনের সুখ-দুঃখের সাথী মরণকালেও সঙ্গী হয়ে রইলেন। বঙ্গবন্ধুর জীবনে বঙ্গমাতা যেমন আলোকবর্তিতা, তেমনি আমাদের স্বাধীনতা ও দেশের মানুষের জন্য তাঁর অবদান বাঙালির ইতিহাসে অনন্য অবিস্মরণীয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার নাম অমর হয়ে থাকবে। আমরা মনে করি, বেগম ফজিলাতুন নেছার জীবনকর্ম বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় অম্লান রাখতে তাঁর জীবনের নানা আলোকিত দিক আলোর পাদপীঠে নিয়ে আসা দরকার। তাঁকে ইতিহাসের স্বমহিমায় উদ্ভাসিত করার দায়িত্বটি রাষ্ট্রের। তাঁর জন্মদিনে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক : সহকারী সম্পাদক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)