মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগে চুড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়া রিভিশন মামলায় হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ কক্সবাজারের বিদায়ী সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল-কে পূণরায় একই বিষয়ে হাইকোর্টে তলব করার ব্যাপারটি বিভ্রান্তিকর।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের জেলা নাজির বেদারুল আলম জানান, গত ২৫ ফেব্রুয়ারী টেকনাফের সেন্টমার্টিনে জমির বিরোধ নিয়ে সংগঠিত এক ঘটনায় বিরোধীয় জমির কেয়ারটেকার ও সেন্টমার্টিনের সাবেক মেম্বার শামসুল ইসলাম বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় ১০ জনকে আসামী করে একটি মামলা দায়ের করেন। যার টেকনাফ থানা মামলা নম্বর : ৪৫, তারিখ : ২৬/০২/২০২৩ ইংরেজি এবং জিআর মামলা নম্বর : ১১৭/২০২৩ ইংরেজি (টেকনাফ)।
ওই মামলার ১ ও ২ নম্বর আসামি যথাক্রমে মৃত মৌলভী এজাহার মিয়ার পুত্র মোঃ আবদুর রহমান ও জামাল হোসাইনের পুত্র মৌলভী রফিক আহমদ গত ৬ মার্চ হাইকোর্ট থেকে ৬ সপ্তাহের আগাম জামিন নেন। এরপর ৬ সপ্তাহের আগাম জামিনের মেয়াদ শেষে হাইকোর্টের আদেশ মতে তারা ১৬ এপ্রিল কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলের আদালতে আত্মসমর্পণ করে পূণরায় জামিনের আবেদন করেন। ওই সময় জেলা ও দায়রা জজ তাদের জামিন আবেদনটি শুনানির জন্য ২৫ এপ্রিল পরবর্তী দিন ধার্য করেন।
নির্ধারিত তারিখে জামিন আবেদনটি শুনানী শেষে মামলার গুণাগুণ বিবেচনায় সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল আসামিদের জামিন মঞ্জুর করেন। এসময় আদালতে অন্যান্যদের সাথে বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট কফিল উদ্দিন চৌধুরী ও রাষ্ট্র পক্ষে পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম ফরিদ শুনানীতে যথারীতি অংশ নেন।
পরে কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রদত্ত জামিন আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে আসামীদ্বয়ের জামিন বাতিলের আবেদন জানিয়ে বিরোধপূর্ণ জমির মালিক ও টেকনাফ থানার ১১৭ নম্বর জিআর মামলার সাক্ষী অ্যাডভোকেট নূরুল আমিন হাইকোর্টে বাদী হয়ে গত ৪ জুন একটি রিভিশন মামলা দায়ের করেন। যার নম্বর : ২১৮৪/২০২৩ ইংরেজি। ওই রিভিশন মামলাটি শুনানি শেষে গত ৭ জুন উল্লেখিত দুই জন আসামির জামিন বাতিল করে কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজের কাছে ব্যাখ্যা তলব করেন বিচারপতি মো. বদরুজ্জামান ও বিচারপতি এস. এম মাসুদ হোসেন দোলনের বেঞ্চ। পরে ৯ জুলাই ব্যাখ্যা দেন, কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল। ব্যাখাতে আসামীদের জামিন প্রদানে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি বলে তিনি উল্লেখ করেন।
পরে হাইকোর্টের উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগে আসামীদের পক্ষে ফৌজদারী আপীল করা হয়। যার নম্বর : ১৬৬১/২০২৩ ইংরেজি।
আসামি মোঃ আবদুর রহমান ও মৌলভী রফিক আহমদ এর পক্ষে আপীল বিভাগে ফৌজদারী আপীল দায়েরকারী সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার এ.এম মাহবুব উদ্দিন জানান, প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী'র নেতৃত্বে গঠিত ৪ সদস্যের আপীল বিভাগ গত ২৪ জুলাই দীর্ঘ শুনানী শেষে হাইকোর্টের ২১৮৪/২০২৩ নম্বর রিভিশন মামলা থেকে উদ্ভুত হওয়া ১৬৬১/২০২৩ নম্বর ফৌজদারী আপীলটির রুল চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি করে আদেশ প্রদান করেন।
আপীল বিভাগের আদেশে আসামি মোঃ আবদুর রহমান ও মৌলভী রফিক আহমদ-কে জামিন দেওয়া হয় এবং কক্সবাজারের চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সন্তুষ্টিক্রমে তাদের জামিননামা সম্পাদন করতে বলা হয়।
প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী'র নেতৃত্বে চূড়ান্তভাবে রুল নিষ্পত্তি করে আদেশ প্রদানকারী ৪ সদস্যের আপীল বিভাগের অন্যান্য সদস্যরা হলেন-বিচারপতি এম.এনায়েতুর রহিম, বিচারপতি মো: আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসাইন।
আপীল বিভাগের আদেশ অনুযায়ী আসামি মোঃ আবদুর রহমান ও মৌলভী রফিক আহমদ গত ৮ আগস্ট কক্সবাজারের চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জামিননামা সম্পাদন করে যথারীতি কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেছেন বলে জানিয়েছেন, একই আদালতের ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশেক ইলাহী শাহজাহান নুরী।
সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ কর্তৃক রুল চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি করে আদেশ দেওয়ার পর আবারো কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলকে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে আগামী ১৬ আগস্ট হাইকোর্টের বিচারপতি মো. বদরুজ্জামান ও বিচারপতি এস. এম মাসুদ হোসেন দোলনের বেঞ্চে হাজির হতে বলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন-হাইকোর্টে রিভিশন আবেদনকারী অ্যাডভোকেট নুরুল আমিন এর আইনজীবী সারওয়ার আহমেদ।
দেশের সর্বোচ্চ আদালত বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ কর্তৃক চূড়ান্তভাবে রুল নিষ্পত্তি করে আদেশ দেওয়ার পর আবারো কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজকে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে তলব করার বিষয়টি বিভ্রান্তিকর ও বোধগম্য নয় বলে জানান, আপীল বিভাগে আসামীদের আইনজীবী ব্যারিস্টার এ.এম মাহবুব উদ্দিন। তিনি আরো বলেন, মহামান্য আপীল বিভাগ যেখানে হাইকোর্টের রুল চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি করে আদেশ দেন, সে বিষয়ে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের সন্তুষ্টির কিছুই নেই, এনিয়ে হাইকোর্ট বেঞ্চের আর কিছুই করার থাকেনা। কারণ হাইকোর্ট বিভাগের উর্ধতন আদালত হচ্ছে আপীল বিভাগ। আর আপীল বিভাগের অধস্তন আদালত হচ্ছে হাইকোর্ট। কিন্তু এক্ষেত্রে হাইকোর্টের কাছে আপীল বিভাগের আদেশকে হয়তোবা গোপন করে বা আপীল বিভাগের দেওয়া প্রকৃত আদেশটি যথাযথ উপস্থাপন না করে বা অন্য কোন কৌশল অবলম্বন করায় কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজকে পূণরায় এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে হাজির হতে আদেশ দেওয়া হয়েছে। যা স্বাভাবিক নিয়ম ও ন্যায়সংগত মনে হচ্ছেনা। তবে এ বিষয়ে হাইকোর্টে রিভিশন আবেদনকারী অ্যাডভোকেট নুরুল আমিন এর আইনজীবী সারওয়ার আহমেদ এবং রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী কে এম মাসুদ রুমী ভালো জানবেন বলে তিনি জানান। তবে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারওয়ার আহমেদ এর মিডিয়াতে দেওয়া বক্তব্যে জনমনে নেতিবাচক বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে হাইকোর্টে রিভিশন আবেদনকারী অ্যাডভোকেট নুরুল আমিন এর আইনজীবী সারওয়ার আহমেদ এর সাথে যোগাযোগের জন্য অনেক চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে, টেকনাফ থানায় শামসুল ইসলাম এর করা ১১৭/২০২৩ নম্বর জিআর মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) এসআই মোনেম শাহরিয়ার চৌধুরী গত ২৮ এপ্রিল আদালতে মামলাটির চার্জশীট দাখিল করেছেন বলে জানিয়েছেন-কক্সবাজার আদালতের কোর্ট পরিদর্শক। তিনি আরো জানান, চার্জশীটে মামলাটি পেনাল কোডের ১৪৩/৩২৩/৫০৬ ধারায় প্রাথমিকভাবে অভিযোগ আনা হয়েছে।
এবিষয়ে ফৌজদারী আইন বিশেষজ্ঞ একজন আইনজীবী বলেন, ১৮৬০ সালের পেনাল কোডের উল্লেখিত ধারার মামলা গ্রাম আদালতেই বিচার্য। সুতরাং একজন সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ এ মামলার উল্লেখিত ধারার ২ জন আসামীর জামিন আবেদন শুনানীক্রমে মঞ্জুর করাটাই ছিলো যুক্তিযুক্ত ও ন্যায়সংগত। উক্ত প্রবীণ আইনজীবীর মতে, আসামীদ্বয়ের জামিন প্রদানে বিজ্ঞ বিচারক আইনের কোন ব্যত্যয় ঘটাননি।
অপরদিকে, কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এস.এম আববাস উদ্দিন জানিয়েছেন, কক্সবাজারের বিদায়ী সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল এর সরকারি চাকুরীর বয়সসীমা পূর্ণ হতে যাওয়ায় সম্প্রতি উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁর করা আবেদনের অভিপ্রায় অনুযায়ী তাঁর চাকুরীর মাত্র ২ কার্যদিবস বাকী থাকতে তাঁকে কক্সবাজার থেকে বদলী করে তাঁর চাকুরী আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত করা হয়েছে। আইন ও বিচার বিভাগের সংযুক্ত কর্মকর্তা হিসাবে যাতে তিনি পিআরএল সহ অবসর উত্তর অন্যান্য সকল সরকারি সুযোগ সুবিধা ঢাকা থেকেই ভোগ করতে পারেন।
গত বুধবার ৯ জুলাই আইন ও বিচার বিভাগের বিচার শাখা-৩ এর উপসচিব (প্রশাসন-১) মোহাম্মদ ওসমান হায়দার স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে তাঁকে বদলী করা হয়। বিসিএস (জুডিসিয়াল) ১০ম ব্যাচের সদস্য মোহাম্মদ ইসমাইল আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের বিভাগের সংযুক্ত কর্মকর্তা হিসাবে আগামী ১৪ আগস্ট নিয়মিত অবসর উত্তর (পিআরএল) ছুটিতে যাবেন বলে প্রশাসনিক কর্মকর্তা এস.এম আববাস উদ্দিন জানিয়েছেন।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরো জানান, কিছু কিছু গণমাধ্যমে কক্সবাজারের বিদায়ী সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল-কে তথাকথিত "ওএসডি" করা হয়েছে মর্মে যে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে, তা সঠিক নয়। এ তথ্য সম্পূর্ণ ভুল।
প্রশাসনিক কর্মকর্তা এস.এম আববাস উদ্দিন এর দেওয়া তথ্য মতে, জ্যেষ্ঠ বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল কক্সবাজারের ১৭ তম জেলা ও দায়রা জজ হিসাবে ৩ বছর ৬ মাস ৮ দিন দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ২০২০ সালের ২ ফেব্রুয়ারী দায়িত্ব নিয়ে গত বৃহস্পতিবার ১০ আগস্ট কক্সবাজারে শেষ কর্মদিবস অতিবাহিত করেছেন। এর আগে তিনি বান্দরবান জেলার জেলা ও দায়রা জজ সহ দেশের বিভিন্ন বিচারালয়ে সুদীর্ঘ ৩৩ বছর বিচারকের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
চট্টগ্রামের ভূজপুর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী, বুনিয়াদি পরিবারের সন্তান মোহাম্মদ ইসমাইল চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে এইসএসসি সম্পন্ন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১০ম ব্যাচে এলএলবি অনার্স সহ এমএলএম সম্পন্ন করেন কৃতিত্বের সাথে। তিনি ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল থেকে অ্যাডভোকেটশীপ সনদ লাভ করেন।
কক্সবাজারে দায়িত্ব পালনকালে মাদক নিয়ে সরাসরি ধৃত হওয়া আসামীদের জামিন দিতে আইন অনুসরণ করে তিনি জামানত প্রথা চালু করেন। ফলে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে গত কয়েক বছরে আসামীদের জামিনের জামানত খাতে প্রায় ১৯ কোটি টাকা জমা করা হয়েছে। যা মডেল হিসাবে অন্যান্য জেলার আদালত সমুহেও অনুসরণ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।