এম.এ আজিজ রাসেল :
বিএনপি জামায়াতের ডাকা হরতাল—অবরোধে কক্সবাজারের জনজীবন ও যান চলাচল স্বাভাবিক থাকলেও প্রভাব পড়েছে পর্যটন শিল্পে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় পর্যটন মৌসুমের শুরুতেই পর্যটন খাতে মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। জেলার পাঁচ শতাধিক হোটেল—মোটেল গেস্ট হাউজে এখন কেবলই হাহাকার। বর্তমানে পর্যটক শূন্য কক্সবাজার।
নভেম্বর—ডিসেম্বর—জানুয়ারি থেকে শুরু করে ছয় মাস কক্সবাজারের মূল পর্যটন মৌসুম হিসেবে পরিচিত। নভেম্বর থেকে শীতের মৌসুম শুরু হলে সেন্টমার্টিনে জাহাজ চলাচল শুরু হয়। কক্সবাজারেও বাড়তে থাকে পর্যটক সমাগম।
বুধবার (০১ নভেম্বর) কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কলাতলী, সুগন্ধা ও লাবণী পয়েন্টে গিয়ে দেখা যায় গুটিকয়েক পর্যটক সমুদ্র স্নান করছে। এরমধ্যে বেশিরভাগই স্থানীয় দর্শনার্থী। সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে জাহিন ইসলাম নামের এক পর্যটক বলেন, ‘খুব ভালো লাগছে। চারিদিকে নিরবতা। আমার নিরবতাই ভালো লাগে। চারিদিকে অস্থিরতার এই সময়টাকে ঢাকা থেকে বের হয়ে ঘুরার জন্য বড় সুযোগ বলে আমি মনে করেছি।’
সুনামগঞ্জ থেকে ঘুরতে আসা আরেক পর্যটক সুমা আরওয়া বলেন, ‘আগে থেকে ছুটি ম্যানেজ করে পরিকল্পনা করা ছিলো বলেই কক্সবাজারে আসা। এখানে এসে দেখি সব ফাঁকা। এরকম সমুদ্র সৈকত কার না দেখতে ভালো লাগে বলেন।’
সৈকতের লাবণী পয়েন্টে গিয়ে কথা হয় পর্যটকদের নিরাপত্তায় কাজ করা সি সেইফ লাইফগার্ডের সুপারভাইজার সিনিয়র লাইফগার্ড সাইফুল্লাহ সিফাতের সাথে। তিনি বলেন, ‘গত সপ্তাহের তুলনায় পর্যটকের সংখ্যা খুবই কম। এ সময়টাতে অন্যান্য বছর আমাদের নিরাপত্তা দিতে বেগ পেতে হয়। কিন্তু এখন সৈকতের তিন পয়েন্টেই আমরা অনায়াসেই দায়িত্ব পালন করছি। কারণ পর্যটকের সংখ্যা নগণ্য বলা যায়। আর যারা এখন আছে তাদের বেশিরভাগই স্থানীয়।’
এদিকে পর্যটক না থাকায় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের হকার, বাদাম বিক্রেতা, কিটকট চেয়ার, শামুক—ঝিনুকের দোকান, বালিয়াড়ির অস্থায়ী দোকানপাট সবার অবস্থা খারাপ।
তপ্ত গরমে সৈকতের কলাতলী পয়েন্ট থেকে নেমে লাবণী পয়েন্টে এসে মাত্র দেড়শো টাকার পান—সিগারেট বিক্রি করেছেন হকার আব্দুল মোতালেব। তিনি বলেন, ‘এখন পর্যটক নেই বললেই চলে। পর্যটক আসলেই আমাদের বেচা বিক্রি বাড়ে।’
সমুদ্র সৈকতের বালিয়াড়ির আরেক ব্যবসায়ী হেফায়েত হোসেন তুহিন বলেন, ‘আমাদের যেখানে ঘন্টায় হাজার টাকার বিক্রি হতো সেখানে কয়েকশো টাকার বিক্রি হচ্ছে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে পরিবার চালাতেই কষ্ট হয়ে যাবে।’
হোটেল—মোটেল জোনে গিয়ে দেখা যায় কেবলই নিরবতা সবখানে। ভালো মানের হোটেল—মোটেলে হাতেগোনা কক্ষ বুকিং থাকলেও বেশিরভাগ হোটেলের বুকিং শূন্য। সেখানে কথা হয় হোটেল ওয়াইসিস ইন্টারন্যাশনালের ম্যানেজার মঈন উদ্দিনের সাথে। তিনি বলেন, ‘আমাদের হোটেলে ৯০ টি কক্ষের মধ্যে মাত্র ২ টি কক্ষ বুকিং আছে। গেলো এক সপ্তাহে ৮০ লক্ষ টাকার বুকিং ক্যান্সেল করেছে। একটি লাইফ ইন্সুইরেন্স কোম্পানী ৮০ টি কক্ষ বুকিং দিয়েছিলো তারাও ক্যান্সেল করেছে। আমাদের পথে বসার মতো অবস্থা। আমাদের এই পর্যটন মৌসুমে রাজনৈতিক রেসারেসির মধ্যে আমরা পর্যটন সেবিরা পড়ে গেলাম।’
হোটেল দি গ্র্যান্ড সেন্ডির চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান বলেন, ‘আমার হোটেলে ৪২ টি ফ্ল্যাট আছে। তারমধ্যে মাত্র কয়েকটি ফ্ল্যাট বুকিং আছে। অন্যন্য সময়ে তো পুরোপুরি হোটেল বুকিং থাকে। এখন একেবারেই পর্যটক নেই।’
কক্সবাজার হোটেল—মোটেল গেস্ট হাউজ মালিক সমিতির তথ্যমতে হরতাল—অবরোধের কারণে কক্সবাজারের বেশিরভাগ হোটেল—মোটেল গেস্ট হাউজে শূন্য বুকিং।
কক্সবাজার হোটেল—মোটেল গেস্ট হাউজ মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম সিকদার বলেন, ‘পর্যটন মৌসুমে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে কেবলই হাহাকার। হোটেল—মোটেল জোনে হাজার হাজার কর্মকর্তা কর্মচারীর এরকম পরিস্থিতি বিরাজমান থাকলে বেতনও তোলা যাবে না। বেশিরভাগ হোটেল—মোটেল এখন সব কক্ষ খালি পড়ে আছে। পর্যটকদের দিকে তাকিয়ে আছি আমরা।’
তিনি জানান, ‘বর্তমান সরকার বিরোধী দল থাকাকালীনও হরতাল অবরোধ এসব ছিলো কিন্তু পর্যটন শিল্প এর বাইরে ছিলো। আমরা সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে বলবো দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখার জন্য পর্যটনকে হরতাল—অবরোধ মুক্ত রাখা হোক।’
রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম ডালিম বলেন, ‘কক্সবাজারের রেস্তোরাঁর সাথে সংশ্লিষ্টরা এখন বসে বসে মাছি মারার অবস্থা।পর্যটন মৌসুমের এই শুভ সময়ে আমাদের দুঃসময় নেমে এসেছে। রেস্তোরাঁ খুলে বসে আছি কিন্তু পর্যটক নেই।’
ট্যুর অপারেটরস্ এসোসিয়েশন অব কক্সবাজার (টুয়াক) সভাপতি ও সি—ক্রোজ অপারেটর ওনার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (স্কোয়াব) সভাপতি তোফায়েল আহমেদ জানান, ‘সেন্টমার্টিনে তিনটি জাহাজ নিয়মিত চলাচল করতো কিন্তু হরতাল—অবরোধের কারণে এখন একটি জাহাজ যাচ্ছে সেখানেও তেলের টাকাও উঠছে না। সেন্টমার্টিন, কক্সবাজারের হোটেল—মোটেল ব্যবসায়ীদের অবস্থাও খুবই খারাপ।’
কক্সবাজার প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট সাংবাদিক মুজিবুল ইসলাম বলেন, কক্সবাজারের শতকরা ৭০/৮০ ভাগ মানুষ পর্যটনের উপর নির্ভরশীল। এই সরকার বিরোধী দলে থাকাকালীন যেমন সকলের সিদ্ধান্তে কক্সবাজারকে রাজনৈতিক অস্থিরতার বাইরে রেখেছিলো তেমনই বর্তমান বিরোধী দলগুলোকেও এটি করা উচিত। যেহেতু কক্সবাজার পর্যটন রাজধানী তাই কক্সবাজারকে রাজনৈতিক কর্মসূচির বাইরে রাখার আহ্বান জানাবো। যদি এটি না করা হয় তাহলে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে মন্দাভাবের পাশাপাশি নেতিবাচক প্রভাবও পড়বে।’