বদরুল ইসলাম বাদল
১০ ডিসেম্বর, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। মানব জাতির সন্মান ও মর্যাদা রক্ষার্থে যেবিষয় গুলো গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো পাওয়া এবং ভোগ করবার অধিকারই সাধারণত মানবাধিকার।যে অধিকার গুলো মানুষের ব্যক্তিবিকাশের সমাজস্বীকৃত উপাদান হিসেবে গণ্য, যাপ্রতিটি মানুষের জন্মগতভাবে পাবার অধিকারী,সহজাত, সর্বজনীন।তবে খেয়ালখুশী মতো যথেচ্ছাচার করা কোন সভ্য সমাজের অধিকার বলে গণ্য হবে না।মানবাধিকার কর্মী এডভোকেট সুলতানা কামালের ভাষায়,"একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তাঁর জীবনটা তিনি সন্মান ও মর্যাদার সঙ্গে কোন রকম হেনস্থা বা হয়রানির শিকার না হয়ে কোন রকম মোটামুটি শান্তিতে যাপন করতে পারে"।মানবাধিকারের বিশ্লেষণে তিনি বলেন ,"মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের পার্থক্যের জায়গা কম।মানবাধিকারের সূত্রগুলো মৌলিক অধিকারের ভিত্তি করেই হয়।জন্মগত ভাবে মানুষ কিছু অধিকার দাবি করতে পারে। তার চলাচলের অধিকার, জীবনের অধিকার থাকবে, বিশ্বাসের অধিকার থাকবে, বাকস্বাধীনতা থাকবে"। তাই ধরে নেয় যায় যে, এসবের উপর আঘাত আসলেই মানবাধিকারের উপর বিঘ্নতার সৃষ্টি হয়। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। যা পরবর্তীতে ১৯৫০ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে " মানবাধিকার দিবস"হিসেবে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। আমাদের দেশেও সরকারি, বেসরকারি সহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন সমূহ দিবসটি পালন করে থাকে।
মানবাধিকার কথাটির পরিচিতি দিনদিন ব্যাপকতা লাভ করছে।কারণ বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে অহরহ মানবাধিকার বিঘ্নিত হচ্ছে।আবার এসময়ে ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন এবং রাষ্ট্রীয়জীবনে মানবাধিকার চর্চা এবং রক্ষার তৎপরতাও বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে ।বিশ্বের মধ্যে ব্যাপক মানুষ অধিকারহীন, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, জাতিগত সংঘাত, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামায় মানবেতর জীবনযাপন করছে।বিশ্ব পুঁজিবাদ বিকাশের সাথে সাথে ধনী-গরিবের বৈষম্যতাও প্রবল বৃদ্ধি পাচ্ছে।অধিকার বঞ্চিত মানুষের মানবতার চিৎকার পৃথিবীর কোণায় কোণায়।কথা হলো,কারা অধিকার চিনিয়ে নিচ্ছে?কেন নিচ্ছে, ব্যবস্থাপনার কোন দূর্বলতায়?তাই ভাবনার দরকার হয়ে পড়েছে,যে সংবিধিবদ্ধ আইনের ফাঁকফোকরে যে বিশেষ শ্রেণিটি ধনসম্পদ কব্জায় নেয় সেগুলোকে চিহ্নিত করা।বলা যায়, তাঁরাও অবশ্যই মানুষ।আবার অধিকার আন্দোলনের সোচ্চার পক্ষটিও মানুষ। মানুষই মানুষের অধিকার নিয়ে খেলা করছে।অধিকারের জন্য লড়াইয়ে আছে পক্ষটিও মানবিক মানুষ।বিশিষ্টজনের মতামতে , "মানবাধিকার সমুন্নত না হলে গনতন্ত্র কোনদিনই প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। আজকের দিনে দেখা যায়, আমরা যতটা রাজনৈতিক সচেতন দাবি করি, ততটা মানবিক হতে পারি নাই। মানবিক হয়ে উঠি নাই।কারণ আমাদের রাষ্ট্রের কাঠামোগত ব্যবস্থাপনায় মানবতার পাঠ অপ্রতুল । লক্ষণীয় যে,আজকাল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় সভাসমিতিতে মানবাধিকার নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শুধু বিশ্বের বড়ো ঘটনা গুলোই হাইলাইট করে। বারবার একই বিষয় নিয়ে কথা হয়, বক্তৃতা হচ্ছে।কিন্তু আমাদের পাশে চোখের সামনেই অনেক অনেক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, ব্যক্তি পর্যায়ে, প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে। তাদের দেখতে চেষ্টা করি না।তেমনি দুইটি বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করছি। বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতি নিয়ে একজন রেমিট্যান্স যোদ্ধার অবদান আজকের দিনে কেউ অস্বীকার করতে পারে না।কিন্তু আমরা কতটুকু জানি যে তাঁরা তাদের কর্মস্থলে কতটা অমানুষিক নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে। নারীদের উপর পশুজাত আচরণ করে মালিক।প্রবাসী শ্রমিকরা তাদের কর্মস্থলে চিকিৎসা সেবা থেকে দূরে থাকে। ।মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদিআরবে
দক্ষ অদক্ষ শিক্ষিত অশিক্ষিত মিলিয়ে অনেক প্রবাসী কাজ করে।কিন্তু সেসব দেশে সহজে সরকারি হাসপাতালে বিনামুল্যে চিকিৎসা পাওয়া যায় না।সরকারি ভাবে চিকিৎসা নিতে হলেও টাকা লাগে।সবারই জানা বেসরকারি ভাবে চিকিৎসা কতটা ব্যয় বহুল।।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সকলের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করবার প্রতিশ্রুতি রাখলেও অন্ধকারে আছে মধ্যপ্রাচ্যের এসব দেশগুলোতে।ফলে প্রবাসীদের জরুরী কোন চিকিৎসা নিতে হলে বড়ো অংকের টাকা খরচ হয়ে যায়। তাই আজকের দিনে বিষয়টি নিয়ে "আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা" গুলোর ভাবা উচিত বলে মনে করি।একজন মধ্যপ্রাচ্য ফেরত রেমিট্যান্স যোদ্ধা,তিনি শিক্ষিত যুবক,মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। নিজের সেরাটা দিয়ে কাজ করে অনেক টাকা আয় করেন। বিদেশফেরত হয়ে ভবিষ্যত জীবনের কথা ভেবে একজন স্বনামধন্য উচ্চ শিক্ষিত আত্মীয়ের মাধ্যমে দেশে একটি প্লট এবং ব্যবসায় টাকা ইনভেস্ট করে।কিন্তু শিক্ষিত মানুষটি প্রতারণার মাধ্যমে সব টাকা খেয়ে ফেলে। আরও নানান মিথ্যা কাহিনি সাজায়।কথাটার অবতার কারণ হল যে,সে ধাক্কাটি রেমিট্যান্স যোদ্ধাটা সইতে না পেরে মানষিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।অসুস্থ হয়ে যায়,বিদেশে চিকিৎসা সেবা নিতে গিয়ে পরবর্তী ইনকামের সব ব্যয় হয়ে যায়।
যে শ্রমিক এবং বিদেশিদের শ্রম সাধনায় মধ্যপ্রাচের দেশগুলোর বর্তমান অবস্থা, কতটা অমানবিক হলে সেই শ্রমিকরা চিকিৎসা সেবা পায়না,ভাবনার বিষয় কিনা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনদের প্রতি দাবী রইলো । অন্যদিকে দেশে প্রবাসীদের সাথে প্রতারণা করতে যেন একটি শ্রেণি উত্ পেতে রয়। মিঠা কথা আর প্রলোভনে টাকা হাত করতে পারলেই কেল্লাফতে। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে প্রবাসীরা প্রশাসনের দারস্থ হয় না ।তাই এই অমানবিক কার্যক্রম প্রতিরোধে মানবাধিকার সংগঠন সমূহ ভূমিকা পালন করতে পারে মনে করে ভুক্তভোগী পরিবার।
দেশের সম্বৃদ্ধির আরএক অন্যতম কারিগর বাংলাদেশের কৃষক।।যারা আঠারো কোটি মানুষের মুখের খাবার উত্পাদন করে।এই কৃষকই হচ্ছে দেশের অর্থনীতির অক্সিজেন। কিন্তু সেই কৃষক সম্প্রদায়ই কৃত্রিম অক্সিজেনের উপর বেঁচে আছে।
নুন আন্তে পান্তা ফুরানোর দশা তাদের।বাম্পার ফসল ফলন হলেও তাঁরা তাদের পণ্যের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়। পাইকার,মধ্যস্বত্বভোগী,মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের ফাঁদে উত্পাদিত ফসলের দাম পায় না।
কৃষি বিপণনে বিনিয়োগ করে মধসত্বভোগীরা উত্পাদক এবং ক্রেতাদের জিম্মি করে বড়ো মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে।সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা পাইকারি বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখে।তাই তাদের মুখে হাসি নাই।, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ যোগাড় করতে পারে না। ফলে বন্চিত হচ্ছে শিক্ষা থেকে, চিকিৎসা সেবা থেকে।বিশেষজ্ঞদের অভিমত প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠীকে জিম্মি দশা থেকে মুক্ত করতে মানবদরদী সংগঠন সমূহ কাজ করতে পারে। কথিত আছে যে, মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার জমা থাকলেও মানুষের চাহিদার শেষ হয় না। আরোও চাই, আরোও আরোও।স্কুল জীবনের একটি ভাবসম্প্রসারণে পড়েছিলাম যে,
"এ জগতে হায়,সে বেশি চায়,আছে যার ভুরি ভুরি।
রাজার হস্ত করে সমস্ত, কাঙ্গালের ধন চুরি"।
মানুষের এসকল লোভাতুর মনোভাব চরিতার্থ করতেই অন্যজনের অধিকারের উপর আঘাত আসে। মানবাধিকার বিপর্যয় বাড়তেই থাকে। সৃষ্টির সেরা মানুষের হাতে সংগঠিত হয় থাকে মানবিকতার চরম ধর্ষন কিংবা লঙ্ঘন এবং অপরাধ। মানুষকে তাই জঘন্য জীব হিসেবে তুলনা করে অনেক পর্যবেক্ষণে। পত্রিকান্তরে জানা যায় যে,দক্ষিণ আফ্রিকার দেশ জাম্বিয়ার লুসাকা চিড়িয়াখানায় বহু জীবজন্তুর ঘর আছে। প্রত্যেক ঘরের উপরে লেখা জীবদের নাম ।একটি ঘরের উপর লেখা," বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জীব"।জীবটিকে সে ঘরে ঢোকেই দেখতে হয়।ঘরে ঢুকে দেখা যাবে কোন জীব নাই।ঘরে ঢুকতেই সামনে পড়বে একটি আয়না।সেখানেই দেখা যাবে "বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জীবটি"।আসলেই তাই নয় কি?
জাতিসংঘের ঘোষণা মতে, "মানবাধিকার সেসব অধিকারকে বুঝায় যা মানুষের প্রকৃতির সাথে জড়িত এবং এটা ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না"। মানবাধিকার দিবসে এই অধিকার সম্পর্কে জানতে জ্ঞান অর্জন এবং অনুশীলন সকল নাগরিকদের দায়িত্ব। তাই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান এইড ইন্টারন্যাশনালের প্রতিষ্টাতা মহাসচিব সহেলী পারভীন দাবী করে বলেন,"মানবাধিকার নীতিমালা ও কার্যক্রম পাঠ্যসূচির অন্তর্ভূক্তিকরণ সময়ের দাবী "।
------------------
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সমাজকর্মী।