নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের পর থেকেই শুরু হয় প্রতিরোধ আন্দোলন। এরপর ধীরে ধীরে তা প্রবল সশস্ত্র বিদ্রোহে রূপ নেয়। এতে দেশটির বেশ কয়েকটি সশস্ত্র জাতিগত মিলিশিয়া বাহিনী অংশ নেয়। সম্মিলিত আক্রমণে রাখাইনে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছে সামরিক জান্তার ব্যাটালিয়ন।
এদিকে গত বুধবার মিয়ানমারের সামরিক শাসনের সঙ্গে যুক্ত সংস্থা ও ব্যক্তিদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মিয়ানমারের জান্তার বিরুদ্ধে সরাসরি দৃঢ় অবস্থান নিলেও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে স্বীকৃতি বা তাদের জোরালো সমর্থন দিচ্ছে না ওয়াংশিটন। তবে দফায় দফায় নিষেধাজ্ঞা দিয়ে জান্তাকে নিদারুণ বেকায়দায় ফেলেছে।
জাতিসংঘ বলছে, অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারে ২৩ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এ সংঘাতে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৫০ হাজার মানুষ।
বিদ্রোহীদের জোট থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স গত বছরের ২৭ অক্টোবর ‘অপারেশন ১০২৭’ শুরু করার পর থেকে অন্তত ২০টি শহর দখল করেছে। রাখাইন, চিন এবং উত্তর শান রাজ্যে ৪০০টিরও বেশি জান্তা ঘাঁটি এবং ফাঁড়ি দখল করেছে তারা। এছাড়াও চীনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথও দখল করেছে জোটটি।
আরকান আর্মি ছাড়াও বিদ্রোহীদের জোট থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সে রয়েছে মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) ও তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ)। এদের মধ্যে সক্রিয় রয়েছে আরকান আর্মি (এএ)। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থা ইউএস ইনস্টিটিউট অব পিস তাদের এক রিপোর্টে বলছে, ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স এবং আরও দু’টি সশস্ত্র গোষ্ঠী মিলে ‘ব্রিগেড ৬১১’ নামে একটি বাহিনী গঠন করেছে।
গত মঙ্গলবার রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর আরও একটি সামরিক ব্যাটালিয়ন ঘাঁটি দখল করেছে সশস্ত্র জাতিগত গোষ্ঠী এএ। আরকান আর্মির পক্ষ থেকে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ঐতিহাসিক ম্রাউক-ইউ টাউনশিপে বেশ কয়েকদিনের লড়াইয়ের পর গত মঙ্গলবার রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে ৫৪০ লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন (এলআইবি) সদর দপ্তর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হয়। পরে টাউনশিপের এলআইবি’র ৩৭৭ ও ৭৭৮ নম্বর সামরিক ঘাঁটি এবং অন্যান্য জান্তা ফাঁড়িগুলোকে দখলে অভিযান শুরু করা হয়।
সেনাবাহিনীর সদস্যরা রাখাইনের প্রাচীন রাজধানী শহরের ম্রাউক-ইউ প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর, ঐতিহাসিক মঠ এবং অন্যান্য ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে গোলাবর্ষণ করছে বলে দাবি করে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি।
মিয়ানমারের কাচিন রাজ্য ও উচ্চ সাগাইং অঞ্চলে শাসকদের হামলা করতে পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) ও শক্তিশালী কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মির (কেআইএ) সঙ্গেও জোট করে তারা।
জোট এক বিবৃতিতে জানায়, বুধবার রাখাইনের উপকূলীয় শহর রামরিতে সংঘর্ষে সৈন্যরা অস্ত্র ও গোলাবারুদ বাজেয়াপ্ত করেছে। দ্বীপের শহরজুড়ে সৈন্যদের মৃতদেহ পাওয়া যায়। বিমান ও গানবোটে করে সেখানে গুলি চালায় জান্তা সরকার।
এর আগে গত জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে জান্তা সরকারের সঙ্গে চীনের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হয় থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স। এরপর আক্রমণ বন্ধ করে দেয় সশস্ত্র জোটটি।
আরাকান আর্মি (এএ) রাখাইন (আরাকান) রাজ্যভিত্তিক একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী। ২০০৯ সালের ১০ এপ্রিল এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এএ হল ইউনাইটেড লীগ অফ আরাকানের (ইউএলএ) সামরিক শাখা। তবে রাজনৈতিক শাখা হিসেবে ইউনাইটেড লীগ অফ আরাকান (ইউএলএ) কাজ করে থাকে। প্রতিষ্ঠাকালে গোষ্ঠীর অস্থায়ী সদর দপ্তর ছিল কাচিন রাজ্যের লাইজায়।
আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি তুলে প্রায় এক যুগ আগে এর সাংগঠনিক উদ্যোগ শুরু হয়। রাখাইন নৃগোষ্ঠীর (আরাকানি) বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের এই সংগঠন নিজেদের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে সামনে আনতে চায়। এটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন কমান্ডার ইন চিফ মেজর জেনারেল তোয়ান মারত নাইং এবং ভাইস ডেপুটি কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নিয়ো টোয়ান আং। বেশিরভাগ এএ সৈন্য কেআইএ মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নেন। ২০১৪ সাল থেকে এএ রাখাইন রাজ্যে নিজস্ব প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করে।
মিয়ানমার পিস মনিটরের মতে, ২০১৪ সালে এএ’র ১ হাজার ৫০০ এরও বেশি সৈন্য ছিল। এক বছর পর বেসামরিক শাখায় ২ হাজার ৫০০ সৈন্য ও ১০ হাজার কর্মী রয়েছে বলে তথ্য দেয় ইরাবতি। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে গোষ্ঠীটির প্রধান দাবি করেন, ৩০ হাজারেরও বেশি সৈন্য আরাকান আর্মিতে রয়েছে।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।