রেজাউল করিম চৌধুরী:
রোহিঙ্গা রেসপন্সের একটি প্ল্যাটফর্ম তার পর্যালোচনায় প্রকৃত তথ্য তুলে ধরতে গিয়ে কিছু প্রশ্নবিদ্ধ উদাহরণ তৈরি করেছেন। রিভিউ কনসালটেন্ট তার উপস্থাপনায় জেনেশুনেই তিনটি শব্দ ব্যবহার করেছেন, অর্থাৎ- স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও পক্ষপাতশূন্য। যাইহোক, আমরা জানি যে তিনি আন্তর্জাতিক সংগঠন যারা ঐ প্ল্যাটফর্মের হোস্ট তাকে এই পর্যালোচনার জন্য নিয়োগ করেছে এবং তার ToR কখনই ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়নি। যদি তিনি দাতা সংস্থা’র দ্বারা নিযুক্ত হতেন তবে হয়তো তিনি এই তিনটি পরিভাষা আরও ভালভাবে দাবি করতে পারতেন।
স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠা একটি ফোরামের সাথে ঐ প্ল্যাটফর্মের ফলাফলগুলো তুলনা করার যথেষ্ট সুযোগ ছিলো। তুলনা করলে, যে কেউ দেখতে পারতেন, স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা ফোরামের ওয়েবসাইটটি, স্থানীয় উপকূলীয় একটি এনজিও দ্বারা পরিচালিত, যারা কোনও দাতা সংস্থার তহবিল নেয়নি, এতেই ঐ ফোরামটির ওয়েবসাইটটি জ্ঞানভিত্তিক উপকরণে সমৃদ্ধ। অন্যদিকে, উল্লিখিত প্ল্যাটফর্মের ওয়েবসাইটে দাতাসংস্থাগুলোর মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ থাকলেও সেখানে জ্ঞানভিত্তিক উপকরণের পর্যাপ্ত ঘাটতি রয়েছে। প্ল্যাটফর্মটি দাতা সংস্থার অর্থে তৈরি পুলফান্ডের প্রলোভন দেখিয়ে স্থানীয় এনজিও এবং তাদের নেতৃবৃন্দের মধ্যে একটি পারষ্পরিক সন্দেহপূর্ণ সম্পর্ক তৈরিতে বেশ সফল হয়েছেন, যা মাথা হেঁট হওয়ার মতো ঘটনা ও পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এভাবে এটি মূলত ঔপনিবেশিক চর্চার পথকে প্রশস্থ করছে, অর্থাৎ, একটি জাতীয়ভাবে জন্ম নেওয়া আন্তর্জাতিক এনজিওর একচেটিয়াকরণ স্থাপন করেছে, এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার দেশীয় নেতাদের আধিপত্য বিস্তারে সহযোগিতা করেছে।
"স্থানীয়" সংজ্ঞায়িত করার সময় তারা "এনজিও নেতাদের জন্মস্থান এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধতার ঘটনা প্রবাহ" এড়িয়ে গিয়ে "আঞ্চলিকতার পন্থা"-কে গ্রহণ করেছেন। এনজিওর আকার এবং কর্মক্ষেত্র যাই হোক না কেন, অধিকার-ভিত্তিক সমাবেশীকরণ হলো মূল বিষয় এবং এটিই হল জন্মস্থানের প্রতি দায়বদ্ধতা, অর্থাৎ মানবাধিকার সম্পর্কিত স্থানীয় দাবিগুলোর সংগঠিত করা এবং তা তুলে ধরা। এই বিষয়গুলোকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র "আঞ্চলিকতার পন্থা" ভবিষ্যতে ক্ষতিকর প্রবণতার জন্মদিতে পারে। যেমন এটা ভবিষ্যতে এমন একটি দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যেতে পারে, উদাহরনস্বরুপ, যাই হোক না কেন সকল সহায়তার সম্পদ স্থানীয়দের মাধ্যমে যেতে হবে।
রিভিউ কনসালটেন্ট তার একটি স্লাইডে উল্লেখ করেছেন, স্থানীয়করণের বিষয়ে স্থানীয় এনজিওগুলির ভ্রান্ত ধারণাসমূহ চিহ্নিত করতে পারায় প্ল্যাটফর্মটি জাতিসংঘ কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা এই যে, রোহিঙ্গা রেসপন্সের এই স্থানীয়করণ রোড ম্যাপ তৈরি করেছে জাতিসংঘের এজেন্সিগুলোর নেতৃত্বে SEG (স্ট্র্যাটেজিক এক্সিকিউটিভ গ্রুপ)। এবং UNDP ও IFRC-এর নেতৃত্বে, যাদের নিযুক্ত লোকালাইজেশন টাস্ক ফোর্স (LTF)। তাহলে, রিভিউ কনসালটেন্টের এই বিপরীতমূখী মন্তব্যের অর্থ কী?
আমার দৃষ্টিতে, মিলিয়ন-মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা সত্ত্বেও প্ল্যাটফর্ম এবং SEG/UN এজেন্সিগুলো স্থানীয়করণকে এখন একটি বিস্মৃত ইস্যুতে পরিণত করেছে। এজেন্সিগুলি খুব কমই স্থানীয়করণের বিষয়ে তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলোকে সম্মান করছেন। এমনকি স্থানীয়করণের নামে তথাকথিত পুলফান্ড পরিচালনা করছেন যে দেশীয় আইএনজিও, তারাও স্থাণীয়করণের ইস্যুগুলোকে সম্মান করছেন না । যেমন উদাহরনস্বরুপ তারা গ্র্যান্ড ব্যার্গেন এবং চার্টার ফর চেঞ্জ-এর প্রতিশ্রুতিতে এখনও স্বাক্ষর করেননি। অথচ এই দুটি সনদই অন্তর্জাতিকভাবে ও সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃত স্থানীয়করণের প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে পরিগণিত।
অন্য একটি স্লাইডে, রিভিউ কনসালটেন্ট উল্লেখ করেছেন যে, প্ল্যাটফর্মটি অ্যাডভোকেসি’র ইস্যুগুলোকে বৈশ্বিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। যতদূর জানা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, দেশীয় আইএনজিও’র কর্মীরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে রোহিঙ্গা রেসপন্সের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেদের উপস্থাপনা করছেন। অপরদিকে, স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠা ফোরামটি রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের অধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একাধিক ইভেন্ট-এর আয়োজন করেছে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইভেন্টে স্থানীয় এনজিও’র ও কক্সবাজারের নেতাদের অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
প্ল্যাটফর্মের সদস্যদের রোহিঙ্গা সহায়তায় স্বচ্ছতা’র দাবি তুলে ধরার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে, যাতে ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমিয়ে শরণার্থীদের জন্য আরো বেশি পরিষেবা বাড়ানো যায়। বিশেষ করে, তাদের আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে রাজনৈতিক প্রচারণা চালানোর প্রচুর সুযোগ রয়েছে, যেখানে তাদের রয়েছে ১০০টির বেশি আইএনজিও’র সদস্যপদ। যারা তাদের আন্তর্জাতিক মূল-ভিত্তির কারনে, বিশ্বের বিভিন্ন রাজধানীতে মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন এবং রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের উপর গণহত্যার বিচারের বিষয়ে মিয়ানমারের জান্তার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে প্রচারণা ও আন্দোলন চালাতে পারেন। এই বিষয়ে প্ল্যাটফর্মের আগ্রহ খুবই কম।
গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় ইস্যুগুলোতে প্ল্যাটফর্মের অধিপরামর্শ করার আগ্রহ খুবই কম, যেমন- চৌদ্দ হাজার হোস্ট কমিউনিটি’র মানুষ কীভাবে ক্যাম্পের মধ্যে বসবাস করছে? টেকনাফে চার হাজার জেলে কীভাবে বেঁচে আছে? ক্যাম্পে ধীরে ধীরে প্লাস্টিকের বিকল্প কীভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে? মনে হয় প্ল্যাটফর্মের অন্য উদ্দেশ্য থাকতে পারে, অথবা তাদের অ্যাডভোকেসি করার সক্ষমতা সীমিত, যদিও সুইডেন, সুইজারল্যান্ড এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের উপর বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করছেন। দাতাদের অবশ্যই তদন্ত করে বিনিয়োগের ন্যায্যতা প্রমাণ করা উচিত।
রেজাউল করিম চৌধুরী, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪