আনোয়ার হোছাইন, ঈদগাঁও:
কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার উপকূলীয় এলাকা পোকখালী ইউনিয়নের পশ্চিম গোমাতলী হান্নান মিয়ার ঘোনা সংলগ্ন উপকূলীয় বন বিভাগের আওতাধীন প্রায় ২শ একর উপকূল রক্ষা বন “ম্যানগ্রোভ” নিধন করে উক্ত বন এলাকা দখলপূর্বক অবৈধ চিংড়ি ঘের তৈরির মহোৎসব চলছে। মাসাধিককাল ধরে পরিবেশ বিধ্বংসী একাজ চলতে থাকলেও মাথা ব্যাথা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের।
বরং উপকূলীয় বন বিভাগের রহস্যজনক ভূমিকা জনমনে ব্যাপক প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে।
হুমকি ধমকি ও মামলা হামলার ভয়ে স্থানীয়রা বিভিন্ন দপ্তরে মৌখিক জানালেও সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ এখনো পর্যন্ত কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছে, অস্ত্রের মহড়ায় প্রকাশ্যে মাসব্যাপী সরকারি সম্পদ ধ্বংসলীলায় দখলবাজচক্র মেতেছে। কেউ তাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস করে না। কাউকে কিছু জানালে এলাকা ছাড়া করা কিংবা মামলা হামলার ভয়ভীতিও প্রদর্শন করে।
এমন কি কতিপয় সাংবাদিককে প্রকাশ্যে মাটিতে পুঁতে ফেলার প্রকাশ্যে হুমকি দেন নেতো দখলবাজচক্র।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের মহেশখালী গোরাকঘাটা রেঞ্জের অধীন চৌফলদন্ডী বিট অফিসের আওতাধীন পোকখালী ৬নং সুইস গেইটস্থ হান্নান মিয়ার ঘোনা নামক ঘেরের পশ্চিমে প্রায় ২শ একর জায়গার উপর থাকা ম্যানগ্রোভ বন এলাকা দখল করে বাঁধ দিয়ে চতুর্দিকে ঘেরাও করে রেখেছে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। এ দখলযজ্ঞে কেটে ফেলা হচ্ছে হাজারো বাইন, কেওড়াসহ হরেক প্রজাতির ববায়নের গাছ। পরিবেশ প্রতিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি আবাসস্থল হারাচ্ছে ম্যানগ্রোভ অরণ্যে আশ্রয় নেয়া নানান প্রজাতির প্রাণী।
সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শনে দেখা যায়, হান্নান মিয়ার ঘোনার পশ্চিমে উপকূলীয় দূর্গম নদী পথ পাড়ি দিয়ে মহেশখালী চ্যানেলের একটু পূর্বে শতশত শ্রমিক দিয়ে উপকূলীয় বন উজাড় করে মাটি কেটে দখলকৃত জায়গার চারপাশে বাঁধ তৈরী করছে দখলবাজ চক্রটি। ওই এলাকায় দেশী বিদেশি অস্ত্র হাতে পাহারায় রয়েছে বিভিন্ন এলাকা থেকে ভাড়ায় আনা অর্ধশতাধিক দাগী অপরাধী। গণমাধ্যম, বন বিভাগ, পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতাকর্মীসহ অন্যন্যা সংস্থার লোকজন ঘটনাস্থলে গেলে অস্ত্রধারীরা ভয়ভীতি প্রদর্শন করে বলেও জানান কয়েকজন সাংবাদিক। ঘটনাস্থল সাগরের পাশাপাশি হওয়ায় দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে যাওয়া যেহেতু দুরুহ ও দুর্গম। তাই দুর্ঘটনা ও জীবনহানির আশংকায় সহজে কেউ যেতে চায় না। সেটিকে পুঁজি করে স্কেভেটরসহ শতশত শ্রমিক দিয়ে দখলযজ্ঞ চলাচ্ছে।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, গোমাতলী এবং চরপাড়ার প্রায় ২শ পরিবার থেকে ১ জন করে ২শ জনকে সদস্য করে গোষ্ঠী ভিত্তিক পৃথক একটি সমিতি গঠন করে।এসব সংগঠনের প্রতিটি সদস্য থেকে তোলা হয়েছে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা। এ টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে সরকারি কোটি টাকার উপকূলীয় জমি দখল ও বন এলাকা ধ্বংসে।
স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সংবাদ পেয়ে চৌফলদন্ডী বিট কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শন যান। পরবর্তী দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও এখনো পর্যন্ত রহস্যজনক কারণে কোন ব্যবস্থা নিতে চোখে পড়েনি। বরং দখলবাজরা আরো দাপটের সাথে দখল কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
এলাকায় চাউর হয়েছে, বিট কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের লাখো টাকায় ম্যানেজ করে এসব উপকূলীয় বনজসম্পদ দখল প্রতিযোগিতা চালাচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালী গোষ্ঠী।
বিষয়টি ব্যাপক জানাজানি এবং গণমাধ্যম কর্মীদের নজরে আসলে জনরোষে পড়ার শঙ্কায় বিট কর্মকর্তা ১ লাখ টাকা ফেরতও প্রদান করেন বলে জনমুখে প্রচার পাচ্ছে।
এদিকে কক্সবাজারের স্থানীয় পত্রিকা দৈনিক হিমছড়ির স্টাফ রিপোর্টার এইচএন আলমকে সামনে পেলে দখলবাজ চক্রের প্রধান হোতা জনৈক আশরাফ দখলকৃত এলাকায় কোন সাংবাদিক পেলে কাঁদা মাটিতে পুঁতে ফেলার প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছে অভিযুক্তরা।
ঘটনার বিষয়ে উপকূলীয় বন বিভাগের গোরকঘাটা রেঞ্জ কর্মকর্তা মোঃ আইয়ুব আলী জানান, সংবাদ পেয়ে স্থানীয় বিট কর্মকর্তাকে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছিল। সত্যতা পেয়ে দখলকৃত এলাকায় দেয়া কয়েকটি বাঁধ কেটে দেয়া হয়েছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে ।
চৌফলদন্ডী বিট কর্মকর্তা সাইফুল ইসলামের সাথে কথা হলে অর্থ লেনদেনের বিষয়টি সত্য নয় দাবি করেন।
তিনি বলেন, যে পরিমাণ জায়গা বলা হচ্ছে আসলে ততটুকু নয়। সংবাদ পাওয়া মাত্রই ঘটনাস্থলে পৌঁছি। সেখানে প্যারাবন নিধন করে ঘের তৈরির মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি।
তিনি আরও বলেন, স্থানীয় কিছু জেলে সাগরে মাছ শিকার করতে ১৬০ ফিট মতো চর দখল করেছিল। সেটি কেটে দেয়া হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা দায়ের করা হবে।
বিট কর্মকর্তার কথার সাথে ওই স্থানের অবস্থার কোন মিল পাওয়া যায় নি।পুরোপুরি বিপরীতমুখি বক্তব্যে প্রমাণ হয় তিনি রক্ষক হয়েও ভক্ষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এমনকি তিনি দখলবাজদের বাঁচাতে নিরিহ জেলেদের উপর দোষ চাপাচ্ছেন।
স্থানীয়রা জানান, চৌফলদন্ডী বিট কর্মকর্তার সাইফুল ইসলামের রহস্যজনক ভূমিকার কারণে দখলবাজরা দিনদিন বেপরোয়া গতিতে অস্ত্রের মহড়ায় সরকারের কোটি টাকার উপকূলীয় বনভূমি দখলে নিচ্ছে। তারা উপকূলীয় বন সম্পদ দখলকারী এবং অসাধু বন কর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উর্ধ্বতন কর্মকতাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
এদিকে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও স্থানীয় সংবাদকর্মীদের মাধ্যমে এ সংবাদ জানতে পেরে বৃহস্পতিবার সকালে ঈদগাঁও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুবল চাকমা সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে ইউএনও সুবল চাকমার মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সংযোগ পাওয়া যায় নি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কক্সবাজারের উপপরিচালক নুরুল আমিন জানান, তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। পরিবেশ ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে ঈদগাঁও উপজেলার সচেতন জনগণ ক্ষোভের সাথে জানান, সম্প্রতি ঈদগাঁও উপজেলা জুড়ে পাহাড়,বাজার ও নদী উপকূলীয় সরকারি সম্পদ নিজের দাবি করে চিহ্নিত দখলবাজচক্র প্রকাশ্যে দখল কার্যক্রম ও স্থাপনা নির্মাণ কাজ চালিয়ে গেলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে রহস্যজনক কারণে কোন ব্যবস্থা নিতে চোখে পড়েনি। বিশেষ করে অতি সম্প্রতি ঈদগাঁও বাজারের শত বছরের মাছের শেড’র জায়গা এতযুগ পর নিজের দাবি করে একটি পক্ষ দখলপূর্বক বহুতল ভবন নির্মাণ কাজ দিনরাত অব্যাহত রাখলেও এখনো পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। যার কারণে উপজেলাজুড়ে মুল্যবান সরকারি সম্পদ দখলের মহড়া দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপকূলীয় বন উজাড় করে জায়গা দখল পূর্বক ঘের নির্মাণও এর ধারাবাহিকতা মাত্র। তাই উপজেলার সচেতন জনগণ এসব দখলদারদের হাত থেকে সরকারি সম্পদ ও পরিবেশ রক্ষায় জেলা প্রশাসনের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।