সিবিএন ডেস্ক:
‘অ জেডা ফইরার বাপ/একদিন বুঝিবা জেডা একদিন বুঝিবা। ক্ষেতর উদ্দি কোণা কুইন্যা আর কতদিন হাডিবা — জনপ্রিয় এমন অসংখ্য চাটগাঁইয়া গানের স্রষ্টা সৈয়দ মহিউদ্দীন। যিনি চট্টগ্রামের অনেক গুণী শিল্পীরও ওস্তাদ। যাঁকে বলা হয় জীবনমুখী আঞ্চলিক গানের জনক। চট্টগ্রামের সঙ্গীত জগতের কিংবদন্তী সেই সৈয়দ মহিউদ্দীন (মহি ভাণ্ডারী) এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তিন দফা স্ট্রোক করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের ৫৫ নম্বরের বিছানায় শয্যাশায়ী ছিলেন। দেহে প্রাণ থাকলেও গেলো এক সপ্তাহ ধরে কেবলই অপলক দৃষ্টিতে ‘নির্বাক’ তাকিয়ে আছেন। মঙ্গলবার বিকেলে স্বজনরা তাঁকে নগরের শুলকবহর মির্জাপুলের বাসায় নিয়ে গেছেন। তবে তাঁর অবস্থা তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি।
গত ১৩ মার্চ স্ট্রোক করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন এই গুণীজন। এর মধ্যে গত মাসেও (ফেব্রুয়ারি) একবার স্ট্রোক করে দীর্ঘ একমাসের মতো চিকিৎসাধীন ছিলেন হাসপাতালে। আজীবন সঙ্গীত সাধনায় মগ্ন এই শিল্পী দীর্ঘ বছর ধরে গুরুতর অসুস্থ। ২০১৫ সালের ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের ডিসি হিলে এক অনুষ্ঠানে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেদিন তিনি ক্রেস্ট ও সনদ নিয়ে মঞ্চ ত্যাগ করার সময় পা পিছলে পড়ে বাম হাত ও বাম পা ভেঙে ফেলেন। তারপর থেকেই রোগভোগের দিন শুরু চিরকুমার এই শিল্পীর।
‘মেজ্জান দিয়ে মেজ্জান দিয়্যে ইতারত” আসকার ডি’র পুব পারত আঁ র ভাংগা চুরা ঘর, মন হাচারা মাঝি তোর সাম্পানত, পিরিত মানে ফুডুর ফাডুর, পাতা বালি, সাম্মান মাঝি সাম্মান বার, গিরাইল্ল্যা কচুর লতিসহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের জনক তিনি। আধুনিক গানের ডামাডোলে যখন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান আকর্ষণ হারাতে বসেছিল তখনই হাতেগোনা যে ক’জন গীতিকার-সুরকার চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানকে আবারও প্রাণ দিয়েছেন সৈয়দ মহিউদ্দীন তাঁদের একজন।
এছাড়া হাজারেরও বেশি গানের স্রষ্টা সৈয়দ মহিউদ্দীনের কথা ও সুরে শেফালী-শ্যামের বহু গান আজো দাগ কাটে শ্রোতাদের হৃদয়ে, হয়েছে কালজয়ী। কিন্তু সৈয়দ মহিউদ্দীন আজও পাননি কোনো রাষ্ট্রীয় পদক, এ নিয়ে আক্ষেপও নেই তাঁর। তবে তাঁর শিষ্যদের কেউ কেউ পেয়েছেন পদক। মরণোত্তর সম্মাননা না দিয়ে জীবনের শেষ প্রান্তেও যেন গুণী এই মানুষের মূল্যায়ন করা হয় সেই দাবি তাঁর ভক্তদের।
লোকসংগীত গবেষক ও সাংবাদিক নাসির উদ্দিন হায়দার বলেন, ‘প্রায় ৪৫ বছর ধরে সৈয়দ মহিউদ্দীন একনাগাড়ে গান লিখেছেন, সুর করেছেন। উনার অসংখ্য গান এখনো চট্টগ্রামের মানুষের মুখে মুখে। চাটগাঁইয়া গানে এ মানুষটার অনেক অবদান। শেষ জীবনে এসে তিনি নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছেন। বিয়েশাদি করেননি, সংগীত ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় সঙ্গী। এমন গুণী একজন সঙ্গীতজ্ঞ দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ, বিছানায় পড়ে আছেন।’
সৈয়দ মহিউদ্দীনের মতো গুণী লোকের মূল্যায়ন না হওয়া দুর্ভাগ্যের উল্লেখ করে সাংবাদিক নাসির উদ্দিন হায়দার বলেন, ‘এটা আমাদের দুর্ভাগ্য সৈয়দ মহিউদ্দীনের মতো গুণী সঙ্গীতজ্ঞের যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। হয়েছেও বা কার? শুধু চট্টগ্রাম না, সারা বাংলাদেশেই একই অবস্থা যে গুণী মানুজন যারা আছেন তাঁদের মূল্যায়ন মৃত্যুর আগে তেমন একটা হয় না। সরকারিভাবে যেমন হয় না, বেসরকারিভাবেও হয় না।’
তিনি বলেন, ‘সৈয়দ মহিউদ্দীন, সনজিত আচার্য, কল্যাণী ঘোষ, সিরাজুল ইসলাম আজাদ— এই চারজন বর্তমানে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের চারটা পিলার। এই চারজন চলে গেলে আসলে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের তেমন কিছু থাকবে না। এই মানুষগুলোর গানকে সংরক্ষণ করা, প্রচার করা, এই মানুষগুলোর প্রতিভাকে স্বীকৃতি দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব ‘
রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অকাজে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে জানিয়ে নাসির হায়দার বলেন, ‘অথচ আমাদের শিল্পীরা যখন হাসপাতালের বেডে পড়ে থাকেন কেউ খবরও রাখেন না। আমাদের একজন জেলা প্রশাসক আছেন, সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখা আছে, শিল্পকলা একাডেমি আছে, বাংলা একাডেমি আছে এসব প্রতিষ্ঠানগুলো সৈয়দ মহিউদ্দীনের মতো আমাদের গুণী শিল্পীদের পাশে দাঁড়াতো পারতো। আমরা আশা করবো তাঁরা দাঁড়াবেন। নয়তো এই গুণী শিল্পীরা অবহেলায় হারিয়ে যাবেন।’
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি শেফালী ঘোষ ও শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের সংগীত গুরু সৈয়দ মহিউদ্দীন। হাজারেরও বেশি গানের স্রষ্টা সৈয়দ মহিউদ্দীনের কথা ও সুরে শেফালী-শ্যামের বহু গান আজো দাগ কাটে শ্রোতাদের হৃদয়ে, হয়েছে কালজয়ী।
‘সৈয়দ মহিউদ্দীন, সনজিত আচার্য, কল্যাণী ঘোষ, সিরাজুল ইসলাম আজাদ— এই চারজন বর্তমানে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের চারটা পিলার। এই চারজন চলে গেলে আসলে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের তেমন কিছু থাকবে না। এই মানুষগুলোর গানকে সংরক্ষণ করা, প্রচার করা, এই মানুষগুলোর প্রতিভাকে স্বীকৃতি দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব ‘
জানা যায়, সৈয়দ মহিউদ্দীনের পৈত্রিক বাড়ি ফটিকছড়ি উপজেলার নাজিরহাট পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের সুয়াবিলে। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকেই ছবি আঁকায় তাঁর বেশ আগ্রহ ছিল। ইচ্ছা ছিল ছবি আঁকার। কিন্তু শেষমেষ সেটি হয়ে উঠেনি। পরবর্তীতে গান লেখার প্রতি তিনি ঝুঁকে পড়েন। বলা চলে, জীবন শুরু করেছেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে। গীতিকার এবং সুরকার হিসেবে রয়েছে দেশজোড়া খ্যাতি। এমনকি সঙ্গীতে পান্ডিত্য আছে, এমন গুনীজনরাও সৈয়দ মহিউদ্দীনকে গুরু বলেই সম্বোধন করেন।
এদিকে, সৈয়দ মহিউদ্দীনের অসুস্থতার পর থেকে সার্বক্ষণিক পাশে আছেন তাঁরই ছাত্র কণ্ঠশিল্পী আলাউদ্দিন তাহের। সৈয়দ মহিউদ্দীনের শারীরিক অবস্থা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘উনার শারীরিক অবস্থা খুব একটা ভালো না। ২০১৫ সালের দুর্ঘটনার পর আরও কয়েকদফা বড় দুঘর্টনার শিকার হয়েছেন তিনি। এর মধ্যে এবারসহ তিনবার স্ট্রোক করায় উনি কথাবার্তা বলতে পারছেন না, তবে আমাদের চিনতে পারছেন। যদি কথা বলতে পারতেন তাহলে আমাদের ভালো লাগতো। এখন এভাবেই দিন কাটছে এই গুণী মানুষের।’
তিনি আরও বলেন, ‘এবার অসুস্থ হওয়ার আগে তিনি বলে গেছেন যে তাঁর শেষ ঠিকানা অর্থাৎ কবর হবে মিরসরাইয়ের বিশ্ব দরবার শরীফে। উনি জীবনের সকল স্বাদ আহ্লাদকে বিলিয়ে দিয়েছেন সঙ্গীতের মাঝে। তাঁর গানের সাথে পরিচিত নয়, দেশে এমন সংগীত বোদ্ধা এবং শ্রোতা নেই বললেই চলে। এখন একটাই চাওয়া উনি দ্রুত সুস্থ হয়ে যাক।’
আলাউদ্দিন তাহের জানান, সৈয়দ মহিউদ্দীনের শারীরিক অবস্থার তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। তবু স্বজনরা তাঁকে বাসায় নিয়ে গেছেন। তিনি অনেকটা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন।
অন্যদিকে, আজীবন সঙ্গীত সাধনায় মগ্ন এই সাধক বিয়েও করেননি। তবে আত্মীয় স্বজন বলতে তেমন কেউ নেই এবং কোনো এক অভিমানে টানা ৫৫ বছর ঘরবাড়ি ছাড়ার বিষয়টি মানতে নারাজ সৈয়দ মহিউদ্দীনের মেজো বোনের ছেলে মো. হামিদ চৌধুরী।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘কয়েক জায়গায় এটাও দেখলাম যে পরিবারের সঙ্গে উনার ৫৫ বছর কোনো যোগাযোগ নেই। এই তথ্যটা সঠিক নয়। এটা ঠিক যে মামা বাড়িতে যেতেন না। কিন্তু পরিবারের সকলের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ থাকতো। উনার নিজের ঘরবাড়ি আছে, আমরা আত্মীয় স্বজনরা আছি। উনি সবসময় একা থাকতে পছন্দ করেন তাই বাড়িতে যেতে চাইতেন না। যারা মামার জন্য কষ্ট করেছেন তারা যাতে উনার জন্য দোয়া করেন।’
মো. হামিদ চৌধুরী আরও বলেন, ‘আমার মামারা চার ভাইবোন। মামা (সৈয়দ মহিউদ্দীন) সবার ছোট। মামাকে সবাই মাইজ্জা ডাকেন। ডাক্তার জানালেন তিনবার স্ট্রোক করার কারণে কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেছে, দুই হাতও নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা চাই মামা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুক। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখলাম মামার চিকিৎসার জন্য সাহায্য চাওয়া হচ্ছে। এটা ঠিক না। আমাদের অনুরোধ কেউ যাতে উনার জন্য ভিক্ষার মতো করে সাহায্য না চায়। উনার মতো গুণীজনকে যারা ভিক্ষাবৃত্তির নামে ছোট করছেন তাদের প্রতি ধিক্কার জানাই। সাহায্য যদি করতেই হয় তাহলে রাষ্ট্র করবে। তিনি রাষ্ট্রের সম্পদ। রাষ্ট্রকেই তাঁর চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে হবে।’
সৈয়দ মহিউদ্দীনের উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের প্রাধান্য সবচেয়ে বেশি। ‘অ জ্যাডা ফইরার বাপ, মেজ্জান দিয়ে মেজ্জান দিয়্যে, আসকার ডি’র পুব পারত আঁ র ভাংগা চুরা ঘর, মন হাচারা মাঝি, পিরিত মানে ফুডুর ফাডুর, পাতা বালি, সাম্মান মাঝি সাম্মান বার, গিরাইল্ল্যা কচুর লতিসহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের জনক সৈয়দ মহিউদ্দীন।
অসংখ্য জনপ্রিয় মাইজভাণ্ডারী, আঞ্চলিক, আধুনিক ও দেশাত্মবোধক গানের গীতিকার, সুরকার এবং দেশের অনেক লিজেন্ড শিল্পীর গুরু সৈয়দ মহিউদ্দীন। হাসপাতালের বিছানায় 'নির্বাক' এই গুণী গানের জনক হয়তো বলছেন, 'আমি বাঁচতে চাই, সুস্থ হয়ে আবার ফিরতে চাই গানের জগতে।' -সিভয়েস২৪