জালাল আহমদ,নিজস্ব প্রতিবেদক:
কক্সবাজার জেলার পেকুয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা শাফায়েত আজিজ রাজু তৃতীয়বারের মতো ‘চেয়ারম্যান’ পদে বিজয়ী হয়ে হ্যাট্রিক করেছেন। স্বচ্ছ ইমেজ, পিতার আদর্শিক উত্তরাধিকার, তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা এবং অসাধারণ মিশুক প্রকৃতির কারণেই জনতার হৃদয় জয় করে ‘ছাত্রনেতা থেকে জননেতা’ তে পরিণত হয়েছেন তিনি।
গতকাল ২১ মে কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী মো. শাফায়েত আজিজ। তিনি ২২ হাজার ৯৬১ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী পেকুয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী আনারস প্রতীকের প্রার্থী রুমানা আকতার পেয়েছেন ১৮ হাজার ১৮৭ ভোট। অন্য দুই প্রার্থী মোটরসাইকেল প্রতীকের প্রার্থী, উপজেলা আওয়ামী সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম ৬ হাজার ৬৭৩ এবং দোয়াত কলম প্রতীকের প্রার্থী মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম সজীব ৬ হাজার ১৬৯ ভোট পেয়েছেন। আশরাফুল ইসলাম সজীব জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক শিক্ষা ও মানবসম্পদবিষয়ক সম্পাদক। তাঁর পিতা মোঃ নুরুল ইসলাম মগনামা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি ছিলেন।
পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২০ হাজার ৭৯ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন তালা প্রতীকের মাহবুবুল করিম। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান টিউবওয়েল প্রতীকের আজিজুল হক পেয়েছেন ১৫ হাজার ৫২ ভোট। নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৩৬ হাজার ৮৩২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন কলসি প্রতীকের প্রার্থী ইয়াসমিন সোলতানা। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হাঁস প্রতীকের আজমীর নূরে জান্নাত পেয়েছেন ৮ হাজার ৮০ ভোট। বর্তমান নারী ভাইস চেয়ারম্যান উম্মে কুলসুম চতুর্থ হয়েছেন। ফুটবল প্রতীকে তিনি পেয়েছেন ৩ হাজার ৭৫৯ ভোট।
বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের ‘ভালোবাসা’ নিয়ে ভোটের মাঠে রাজুর হ্যাট্রিক বিজয়:
এবারের পেকুয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে সাবেক দুই বারের উপজেলা চেয়ারম্যান শাফায়েত আজিজ রাজুর প্রতীক ছিল ‘ঘোড়া’। বিএনপির সাধারণ নেতাকর্মীরা ‘ঘোড়া’ প্রতীক নিয়ে ‘ঘোড়ার’ গতিতে ছুটে যান সাধারণ মানুষের কাছে । আগে থেকেই রাজুর পরিচিতি ছিল জনগণের মধ্যে। কারণ তিনি বিএনপির সাবেক এমপি এবং কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান মরহুম মাহমুদুল করিম চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ সন্তান। তাঁর বাবা মাহমুদুল করিম চৌধুরী ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে চকরিয়া এবং কুতুবদিয়া আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
মগনামা ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয় হন রাজু । তিনি ২০০৩ সালে পেকুয়া উপজেলা ছাত্রদলের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। ছিলেন জেলা ছাত্রদলের সহ-সভাপতি পদেও। সেই সময় পেকুয়া উপজেলা বিএনপি, ছাত্রদল ও যুবদলে নিজস্ব বলয় তৈরি করতে সক্ষম হন তিনি।
সেই ২০০৬ সালের অক্টোবরে উপজেলা যুবদলের সম্মেলন শেষে তাকে সভাপতি পদের বিপরীতে সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনীত করলে তার সমর্থকরা প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। সেই থেকেই রাজনৈতিক মনোমালিন্য শুরু।
তখন উপজেলা ছাত্রদলের ‘সভাপতি’ পদ নিয়ে ছাত্রদল নেতা মনোহর আলম বাদশাহ এবং ইউসুফ রুবেলের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে তৎকালীন জেলা বিএনপির সভাপতি এবং যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমেদ রাজুকে উপজেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদকের পাশাপাশি উপজেলা ছাত্রদলের সভাপতি হিসেবে পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন। ২০০৭ সালে ১১ জানুয়ারি সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের দায়িত্ব গ্রহণের পর পেকুয়ার অধিকাংশ বিএনপির নেতাকর্মীরা ‘ঢাকা’ দেন।
নেতারা পলাতক থাকলেও ২০০৮ সালের উপজেলা নির্বাচনকে সামনে রেখে পেকুয়ার রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেন শাফায়াত আজিজ রাজু। ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হিসেবে পেকুয়ার পাড়া -মহল্লায় গণ জোয়ার তৈরি করেছিলেন তিনি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী সাবেক যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমেদ এর সহধর্মিণী হাসিনা আহমেদ বিজয়ী হওয়ার পর ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠাতব্য পেকুয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচন কে সামনে রেখে শাফায়াত আজিজ রাজুকে উপজেলা বিএনপির একক প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেন উপজেলা বিএনপি। ফলে ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারি পেকুয়া উপজেলা পরিষদের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে বিজয়ী হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন রাজু। সরকার বিরোধী আন্দোলনেও অগ্রভাগে ছিলেন তিনি ।
২০১৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বিএনপির প্রার্থী হিসেবে দ্বিতীয় বার উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তখন তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী ওয়াহিদুর রহমান ওয়ারেছীর দ্বিগুণ ভোট পেয়েছিলেন। ২০১৫ সালের ১০ মার্চ বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব এবং ২০ দলীয় জোটের মুখপাত্র সালাহউদ্দিন আহমেদকে ‘গুম’ করা হলে রাজু পেকুয়ায় তাঁর সন্ধানের দাবিতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। দুইবারের উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি পেকুয়ার মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে কোন অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগ ছিল না।
বিএনপি দলীয় এবং জোট গত ভাবে নির্বাচন বর্জন করায় ২০১৯ সালের পেকুয়া পরিষদের তৃতীয় নির্বাচনের তিনি অংশগ্রহণ করেননি। বিভিন্ন সময় রাজুকে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে মূল্যায়ন না করায় তিনি দল থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। ফলে দলে সক্রিয় ছিলেন না।
২০১৯ সালের অক্টোবরে ‘পাঠাও চালক’ হিসেবে দেশব্যাপী পরিচিত হন তিনি। দুই বারের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান রাজু চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ থেকে বিকম পাস করলেও রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার কারণে ব্যবসায় জড়িত ছিলেন না। অবশেষে
২০১৯ সালে চট্টগ্রাম শহরের চকবাজারে ব্যবসা বাণিজ্যে সক্রিয় হন। তবে দলের সাধারণ কর্মী এবং সমর্থকদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। এবারের নির্বাচনে তাঁর কলেজের বন্ধুরাও ছুটে এসেছেন রাজুর নির্বাচনী প্রচারণায়।
বিএনপি দলীয়ভাবে এবং জোট গতভাবে উপজেলা নির্বাচন বর্জন করলেও এবারের নির্বাচনে শাফায়েত আজিজ রাজু প্রার্থী হচ্ছেন জেনে তাকে ‘ঠেকাতে’ উপজেলা বিএনপির সভাপতি এবং সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাহাদুর শাহ গত ২২ এপ্রিল একটি কমিউনিটি সেন্টারে রীতিমতো মিটিং ডেকে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা দেন।চেয়ারম্যান পদে পেকুয়া উপজেলা যুবদলের সভাপতি কামরান জাদিদ মুকুট, ভাইস চেয়ারম্যান পদে পেকুয়া উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি আহসান উল্লাহ এবং নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মো. আবছারের স্ত্রী রাজিয়া বেগমকে বিএনপির একক প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের এলাকায় দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্যের এমন ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন প্রার্থীরা।
পেকুয়া উপজেলা বিএনপির সদস্য রাজু দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করায় দল থেকে বহিষ্কারও হয়েছেন। কিন্তু দলের নেতারা তাকে বহিষ্কার করলেও দলের কর্মীরা তাকে ‘আগলে’ রেখেছেন নির্বাচনের মাঠে। দলের সাধারণ কর্মী এবং সমর্থকরা নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করেই শাফায়াত আজিজ রাজুর জন্য পাড়া- মহল্লায় গিয়ে ভোট প্রার্থনা করছেন।
বিভিন্ন সময়ে রাজপথে থাকা উপজেলার ত্যাগী ও পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা শাফায়াত আজিজ রাজুর পক্ষে মাঠে নেমেছেন।
ভোটের দিন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রতিটি কেন্দ্রে তাদের প্রার্থীর ‘ব্যাচ’ পরিধান করে শক্ত অবস্থান নিলেও অল্প কয়েকটি কেন্দ্রে রাজুর সমর্থকদের দেখা মেলে। কোন কোন কেন্দ্রে রাজুর এজেন্ট ই দেখা যায় নি। অথচ অধিকাংশ কেন্দ্রে ই তিনি প্রথম না হয় দ্বিতীয় হয়েছেন।
অনেকেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের ব্যাচ পরিধান করে রাজুর ‘ঘোড়া’ প্রতীকে ভোট দিয়েছেন।
নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে পেকুয়া উপজেলার শিল খালী ইউনিয়নের জারুলবনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র,পূর্ব মগনামা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র , মগনামা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র এবং মটকা ভাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ কয়েকটি কেন্দ্রে রাজুর ‘ঘোড়া’ প্রতীকের সমর্থকদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালিয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এতেও তিনি মাঠ ছেড়ে যান নি। হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে ‘আহত’ নেতাকর্মীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন তিনি।
সন্ধ্যায় কেন্দ্র ঘোষিত ফলাফলে রাজু এগিয়ে থাকার খবর শুনে পেকুয়ার মুক্তিকামী মানুষ উপজেলা চত্বরে ভিড় করেছেন। সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে স্বস্তির নিশ্বাস লক্ষ করা গেছে। কারণ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অত্যাচার, নির্যাতন ও দুর্নীতির কারণে পেকুয়ার মানুষ ছিল অতিষ্ঠ।
বিজয়ী হওয়ার পর রাজুর ভাষণ ছিল অত্যন্ত সহনশীল। তিনি বলেন,”এই বিজয় পেকুয়া উপজেলার তৌহিদী জনতার বিজয়। এই বিজয় পেকুয়ার শান্তিকামী মানুষের বিজয়”।
তিনি তার কর্মী এবং সমর্থকদের বিজয় মিছিল না করার নির্দেশ দেন ।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।