নিজস্ব প্রতিবেদক
চট্টগ্রাম নগরীর পাথরঘাটা এলাকার সেন্ট স্কলাস্টিকাস গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৪৭ জন শিক্ষক কর্তৃক অপর দুই শিক্ষক সুরোজিত পাল ও রাকিব উদ্দিন এর বিরুদ্ধে ৫ম শ্রেণির এক ছাত্রীর সাথে নৈতিক ও চারিত্রিক স্খলনজনিত ব্যত্যয় ঘটেছে বলে অভিযোগের সত্যতা পায়নি তদন্ত কমিটি।, দশ দিনের টানা তদন্তে সাক্ষ্যগ্রহণ এবং প্রমাণের ভিত্তিতে তদন্ত প্রতিবেদনে এমনই তথ্য উঠে এসেছে।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক সেন্ট স্কলাস্টিকাস গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রতিষ্ঠান প্রতিনিধি সিস্টার বৃন্তা রেমা, সদস্য ব্রাদার ফ্লেভিয়ান কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রধান সমন্বয়কারী ব্রাদার রক্তিম চিরান ও সদস্য আইসিটি বিষয়ক সহায়তা প্রদানকারী প্রভাষক ওমর ফারুক সিদ্দিক বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তদন্ত কমিটির প্রধান বৃন্তা রেমা বলেন, 'সেন্ট স্কলাস্টিকাস গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষের নির্দেশনা পাওয়ার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আমরা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। প্রাথমিক তদন্তে দুই শিক্ষক এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত বলে সত্যতা পাওয়া যায়নি। প্রতিবেদনে আমরা জড়িত ব্যক্তিদের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণসহ ৬টি সুপারিশ করেছি।'
সেন্ট স্কলাস্টিকাস গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শিল্পী সেলিন কস্তা বলেন, ‘তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেয়েছি। ডিসিপ্লিনারি কমিটির সভায় বিষয়টি উত্থাপন করা হবে। এরপর জরুরি বোর্ড গঠন করে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
প্রতিবেদন ও তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, অভিযুক্ত শিক্ষক সুরোজিত পাল ও রকিব উদ্দিনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ মিথ্যে। ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে যে কথোপকথনের কপি উপস্থাপন করা হয়েছে এতেও তাঁরা জড়িত নন। বরং ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চার শিক্ষার্থী (যাদের আদ্যক্ষর আ, মু, আ, গো) এসব বিতর্কিত কাণ্ডে জড়িত বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এছাড়াও, এ ঘটনার সাথে অত্র প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বেবি চন্দ, শার্লিন সুবেরিও ইউজিন, মার্গ্রেট মনিকা জিন্স, নীল রাসেল সোহার, স্বরূপ দাশ, রুমা ভট্টাচার্য, রুমি চৌধুরি, সাথি গোমেজ, কামনাশীষ ভট্টাচার্যও জড়িত বলে তদন্তে নাম এসেছে।
ঘটনার রহস্যভেদে জানা গেছে, অভিযুক্ত দুই শিক্ষকদের মানহানি ও তাঁদের চাকরিচ্যুত করার উদ্দেশ্যে হিংসার বশবর্তী হয়ে মূলত প্রতিষ্ঠান প্রধান ও অভিযুক্ত শিক্ষকদের দমন করতে অন্যরা এসব ঘটনা সাজিয়েছিলেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরো উঠে আসে, দুই শিক্ষকের নৈতিক ও চারিত্রিক ব্যত্যয় ঘটেছে বলে ভিকটিম কিংবা ভিকটিমের অভিভাবকের কেউ অভিযোগ করেনি। কিন্তু তৃতীয় পক্ষ হিসেবে ৪৭ শিক্ষকেরাই সর্বপ্রথম এটি উত্থাপন করেন।
ফলে, এটাই স্পষ্ট বিদ্যালয়ের কার্যক্রম ব্যাহত করে চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতি ও উত্তেজনাকর পরিবেশ সৃষ্টি করতে এ কাহিনি সাজিয়েছিলেন। কারণ ৪৭ শিক্ষকের স্বাক্ষর করা তালিকায় বেবি চন্দ ৩২ নম্বরে ও শার্লিন সুবেরিও ইউজিন ১৫ নম্বর সিরিয়ালে অভিযোগপত্রে সই করেন।
তদন্ত প্রতিবেদনের পাশাপাশি কমিটি আরও সুপারিশ করেছেন, এ ঘটনার সাথে জড়িত শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টান্তমূলক আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার। যাতে পুনরায় এ ধরনের ঘটনা না ঘটে।
এছাড়াও তদন্তে অন্য কোন শিক্ষক জড়িত কিনা তা শনাক্তে নতুন কমিটি গঠনের সুপারিশ করে শিক্ষার্থীদের মোবাইল ব্যবহার নিয়ে সজাগ দৃষ্টি, শিক্ষক দলীয়করণের দিকে কর্তৃপক্ষের নজর, সিনিয়র জুনিয়র শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলি রোধসহ প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিষ্ঠান প্রধানের বিরুদ্ধে কথা বলা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেবার সুপারিশ জানিয়েছেন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সূত্রে আরো জানা যায়, গত ২৬ মে উল্লিখিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৪৭ জন শিক্ষকের সইতে দুই শিক্ষক সুরোজিত পাল ও রকিব উদ্দিনের বিরুদ্ধে 'চারিত্রিক ও নৈতিক স্খলন' এর অভিযোগ আসে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৭ মে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ও পরিচালনা কমিটির সভাপতি সিস্টার শিল্পী সেলিন কস্তা, ফাদার লেনার্ড সি রিবেরু ও ফাদার টেরেন্স রড্রিক্স, ভিকার জেনারেল, চট্টগ্রামের আর্চ ডায়োসিস বিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদারের নির্দেশে ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেন। গত ৫ জুন ওই তদন্ত কমিটি ১২ পৃষ্ঠার একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
উক্ত কমিটি তদন্ত প্রক্রিয়ায় অভিযুক্ত শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষার্থীর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ও অভিভাবকদের সাক্ষাৎকার গ্রহণসহ তাঁদের স্ব স্ব নম্বর ও যাবতীয় সোশ্যাল মিডিয়া সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই বাছাই করেন।
এতে তদন্তকারী কমিটি জানতে পারেন উক্ত শিক্ষার্থী শিক্ষকের নামে ফেসবুক আইডিসহ আরো বিভিন্ন নামে একাধিক আইডি ব্যবহার করেছেন। রয়েছে তার ৫ টি হোয়াটসঅ্যাপ আইডিসহ ইনস্টাগ্রাম ও টিকটক অ্যাকাউন্ট।
তদন্তে বেশ চাঞ্চল্যকর যে তথ্য বেরিয়ে এলো। তা হলো-একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বেবি চন্দ ও শার্লিন সুবেরিও ইউজিনের নির্দেশে শিক্ষক রকিব উদ্দিনের নামে ৩ টি ফেক আইডি খোলে ওই শিক্ষার্থী।
এছাড়াও তাঁর বান্ধবীরা সুরোজিত পালের নামেও ফেসবুক আইডি খোলার কথা স্বীকার করেন। এসব আইডিতে যুক্ত করেন শিক্ষক ধীমান চৌধুরি, এলভিন সুজন দাশ, বেবি চন্দ, তৈয়বা সুলতানা, নীল রাসেল সোহার, রুমা ভট্টাচার্য কে।
তদন্তকালে কমিটির সদস্যদের ওই শিক্ষার্থী জানায়, শিক্ষক বেবি চন্দের নির্দেশে শিক্ষার্থী ও বান্ধবীরা মিলে দুই শিক্ষক সুরোজিত ও রকিবকে ফাঁসাতে এসব কর্মকাণ্ড করেছেন। যে-সব কথা স্বীকার না করতে বেবি চন্দ তাঁদের অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদেরও ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছেন বলেও জানান।
তাঁতে এটাই স্পষ্ট, দুই শিক্ষককে ফাঁসাতে কিছু শিক্ষক ৫ ভাগ বেতন বৃদ্ধির কথা বলে ৪৭ জন শিক্ষকের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে অভিযোগ দিয়েছেন। তদন্ত প্রতিবেদনে এসব উঠে আসার সাথে সাথে এটাও নিশ্চিত হয়েছে কমিটি, এসব ঘটনার মাস্টার মাইন্ড ছিলেন পর্দার আড়ালে থাকা শিক্ষক বেবি চন্দ ও শার্লিন সুবেরিও ইউজিন।
একই ঘটনাকে ভিন্নখাতে উপস্থাপন করতে তড়িৎগতিতে পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে দুই শিক্ষক কর্তৃক যৌন নিপীড়ন করেছেন বলে ১১ জুন নগরীর কোতোয়ালি মডেল থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা (নং-২৪) করেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর মা।
পরে মামলায় অভিযুক্ত জীব বিজ্ঞানের শিক্ষক রকিব উদ্দিন (৩৫) কে বিকেলে গ্রেফতার করে পুলিশ। অভিযুক্ত অন্যজন অর্থনীতি বিষয়ের শিক্ষক সুরোজিত পাল (৩৩)।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৯ জুন সকাল ১০টার দিকে টিফিন বিরতির সময় অভিযুক্ত দুই শিক্ষক কৌশলে ভুক্তভোগী ওই ছাত্রীকে ৬ তলার বাথরুমের পাশে নিয়ে যান। সেখানেই অবাঞ্ছিতভাবে ওই ছাত্রীকে স্পর্শ করে শ্লীলতাহানি করেন।
তাঁদের এমন আচরণে ভয় পেয়ে চিৎকার দিলে ওই ঘটনা কাউকে না জানানোর হুমকি দিয়ে কৌশলে ঘটনাস্থল থেকে চলে যান তারা। ভুক্তভোগী ছাত্রী ভয়ে বিষয়টি কাউকে জানায়নি। স্কুল ছুটির পর বাসায় এসে কান্নাকাটি শুরু করে। পরবর্তী সময়ে ছাত্রীর মা কান্নার কারণ জানতে চাইলে ঘটনার বিস্তারিত বলে। পরে মা বাদি হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার এসআই মো. নওশের কোরেশি বলেন,' আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। ওটা যেহেতু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব স্পটেই তাঁদের সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে। মামলাটি তদন্তাধীন তাই মামলার স্বার্থে এখন কিছু বলা যাচ্ছে না।'
কোতোয়ালি থানার দায়িত্ব প্রাপ্ত অফিসার ইনচার্জ রিপন কুমার দাস বলেন, ‘পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে শ্লীলতাহানির অভিযোগে দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন এক অভিভাবক। অভিযুক্ত একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তদন্তে প্রকৃত ঘটনা উন্মোচন হবে।