কাফি আনোয়ার
ক্রমাগত দূষণ ও দখলে অস্তিত্বসঙ্কটে পড়ছে ঈদগাঁও উপজেলার ঐতিহ্যবাহী প্রধান নদী ফুলেশ্বরী।
দিন দিন এই নদী একদিকে যেমন ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে, অন্যদিকে নদীর মুল্যবান জমি ভূমিদুস্যদের দখলে চলে যাচ্ছে।
ভৌগোলিক তথ্যমতে, দেশের পুর্বদক্ষিণ সীমান্তবর্তী অঞ্চল বান্দরবানের মৈভার( মৈন পাহাড়) পর্বতশৃঙ্গ থেকে উৎপন্ন হয়ে ফুলেশ্বরী নদীর
আনুমানিক ৪২ কিমি পাহাড়ি ও সমভূমি পাড়ি দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।
পার্বত্য জেলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী, কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলার গর্জনিয়া ঈদগড়, ঈদগাঁও উপজেলার ঈদগাঁও, ইসলামাবাদ,জালালাবাদ,পোকখালী ইউনিয়নের উপর দিয়ে সর্পিল গতিতে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিমে মহেশখালী চ্যানেলে মিশেছে।
যে সকল অঞ্চলের উপর দিয়ে এই নদী প্রবাহিত হয়েছে সেই সকল অঞ্চলের জীবন-জীবিকা,সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও সমৃদ্ধি সর্বাংশে এই নদীর উপর নির্ভরশীল।
এই দীর্ঘ পথে নদীর দুপারে তৈরী হয়েছে বিস্তীর্ণ পলি ও পলি দো-আশঁ মাটির উর্বর প্লাবণ সমভূমি।
যা এই অঞ্চলের ৫ লক্ষ জনগোষ্ঠীর কৃষিপ্রধান গ্রামীণ অর্থনীতিতে এনেছে সজীব ও স্বনির্ভর সচ্ছলতা আর সমৃদ্ধি। দেশের খাদ্যনিরাপত্তায় রাখছে অনন্য সাধারণ ভূমিকা।
সময়ের বিবর্তনে শ্বাপদসঙ্কুল জনপদে সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও সভ্যতাসৃষ্টির সূতিকাগার এই ফুলেশ্বরী নদী নিজেই মরাবন্ধ্যা জলস্রোতে পরিণত হয়েছে।
কক্সবাজার জেলার বৃহত্তম বাণিজ্যিক উপশহর ঈদগাঁও বাজার, ঈদগাঁও বাস-স্টেশন ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার পচনশীল ও অপচনশীল শতশত মন বর্জ্য ফেলা হচ্ছে এই নদীতে। ফলে দুষিত হচ্ছে নদীর পানি, হারিয়ে যাচ্ছে নদীর প্রাণবৈচিত্র্যতা এবং ধ্বংস হচ্ছে নদীর প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান ও জীবসত্ত্বা। নদীতীর ভরাট ও দখলের ফলে সরু ও সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে নদীর প্রশস্ততা। এতে নদীর পানিধারণ ক্ষমতা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। যা প্রতি বর্ষা মৌসুমে বন্যা ও নদীভাঙনের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
সরেজমিনে, গতকাল ফুলেশ্বরী নদী উত্তর পারের ( কবি মুহম্মদ নূরুল সড়ক) ঈদগাহ জাহানারা বালিকা বিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী পয়েন্টে ( যা ঈদগাঁও উপজেলা সদর দপ্তর থেকে ৫০মিটার দূরত্বে) দেখা গেছে, নদীর উত্তর পাড়ের অভ্যন্তরে পর্বতপ্রমাণ বর্জ্যের স্তুপ। যার মধ্যে অধিকাংশই অপচনশীল পলিথিন ও মেডিক্যাল বর্জ্য।
প্রতিদিন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী রাতের আধাঁরে ওই নদীর বাশঁঘাটা সেতু ও বাসস্টেশন সেতু পয়েন্ট দিয়ে ফেলছে মুরগী খামারের বর্জ্য,ফল ও তরকারী বর্জ্য, মাছ ও মুরগী কাটা উচ্ছিষ্ট বর্জ্য, হোটেল রেস্তোরাঁর বর্জ্য'সহ গৃহাস্তালি বর্জ্য।
নদীতীরে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা অধিকাংশ আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনের মানব পয়োবর্জ্য পাইপলাইনের মাধ্যমে ফেলা হচ্ছে নদীর অভ্যন্তরে। এতে নদীর পানি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে।
শুষ্ক মৌসুমে অনিয়ন্ত্রিত ও নিয়মবিরুদ্ধ বালু উত্তোলনের ফলে নদীর অমূল্য সম্পদ প্রাকৃতিক বাস্তসংস্থান ধ্বংস হচ্ছে। নদীর অভ্যন্তরে তৈরী হচ্ছে গভীরখাদ, চোরাগুপ্তা গর্ত। এতে ফুলেশ্বরী নদী উদ্বেগজনক প্রতিবেশ সংকটের মুখোমুখি হওয়ার পাশাপাশি যৌবন ও জৌলুস হারিয়ে পড়েছে অস্তিত্বসংকটের মুখে।
সমাজ বির্বতনের ধারাবাহিকতায় মানুষের জীবন ও জীবিকা, কৃষ্টিকালচার, সাহিত্য-সংস্কৃতি, কৃষি, যোগাযোগ ও অর্থনীতির সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত এদেশের নদীসমুহের অস্তিত্ব আজ বিলীন হওয়ার পথে।
ক্রমাগত দূষণ, অবৈধ দখলের ফলে নদীর চিরায়ত রূপ ও গতিপ্রকৃতি যেমন বিলুপ্ত হতে চলছে তেমনি মানুষের জীবিকা ও জীবনযাত্রা, পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্যতা,বাস্তুতন্ত্রও মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন ( বাপা), কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি কলিম উল্লাহ বলেন, ফুলেশ্বরী নদী কক্সবাজার জেলার বৈচিত্র্যময় একটি নদী। এভাবে একটি নদীকে অস্তিত্ব সঙ্কটে ঠেলে দেয়া
দেশের পরিবেশ আইন, নদী রক্ষা আইনের সরাসরি বরখেলাপ এবং জীবন্ত সত্ত্বা হিসেবে স্বীকৃত নদীকে হত্যা করার সামিল।
বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশনের হিসাবমতে দেশের ৭০০ টি নদ-নদীর মধ্যে প্রতিটি নদ-নদী-খাল দখল দূষণে হারিয়ে ফেলেচে নিজের স্বকীয় সত্ত্বা ও রূপ।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন সারাদেশে ৪৭ হাজার নদী অবৈধ দখলদারকে চিহ্নিত করেছে। তৎমধ্যে কক্সবাজার জেলার প্রধান নদী বাঁকখালীর অবৈধ দখলদার হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে ৯৯ জন, আরও ১জন বাঁকখালী নদীর উভয় তীর দখলের অভিযুক্ত, ঈদগাও’র ফুলেশ্বরী নদীর ১৭জন ,উখিয়া উপজেলার রেজুখালের অবৈধ দখলদার ৮জন , টেকনাফ উপজেলার কাইয়ুকখালী খালের অবৈধ দখলদার ২৫ জন, চকরিয়া উপজেলার মাতামুহুরী নদীর অবৈধ দখলদার ২১জন এবং একই উপজেলার বুড়া মাতামুহুরী খালের অবৈধ দখলদার হিসেবে ১৮জনকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তবে প্রকৃত দখলদারের সংখ্যা বাস্তবে আরও বেশি।
‘পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যতা সংরক্ষণ উন্নয়ন ’ শিরোনামে বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয়ভাগে রাষ্ট্রের মূলনীতির ১৮(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ , জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন, বণ্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন। পাবলিক ট্রাস্ট ডক্ট্রিন ও বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, পরিবেশ প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, সকল উন্মুক্ত জলাভূমি, সমুদ্র, নদ-নদী, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড়, ঝিল, সমুদ্রসকত, নদীর পাড়, পাহাড়-পর্বত, টিলা, বন, বাতাস পাবলিক ট্রাস্ট সম্পত্তি এবং ওই সকল সম্পত্তি দেশের বর্তমান ও ভবিষৎ নাগরিকদের জন্য সংরক্ষিত। এই সকল সম্পত্তির উপর জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত।
কিন্তু কে মানে কার কথা। নদী-খালগুলি ক্রমাগত দূষণ ও প্রভাবশালীদের অবৈধ দখলে চলে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে নদীর প্রাণ ও প্রাণবৈচিত্র্যতা। নদীগুলি পড়েছে চরম অস্তিত্বসংকটে। নদীসংশ্লিষ্ট সরকারী দপ্তরগুলোর দৃশ্যমান কোন ভূমিকাও অদৃশ্য। ক্ষেত্রবিশেষে নদী দখলদারদের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের রহস্যময় যোগসাজশের অভিযোগও উঠছে।
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের একটি ঐতিহাসিক রায় নদীদূষণ ও দখলদারদের বিরুদ্ধে কড়া সতর্কবার্তা জারির মাধ্যমে নদীপ্রেমী ও নদীনির্ভর জনগোষ্ঠীকে আশাবাদী করে তুলেছে। সেই সাথে নদী ও পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে যোগ করেছে নতুনমাত্রা।
২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারী বিচাপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচাপতি মো. আশরাফুল কামাল সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈতবেঞ্চ তুরাগ নদী’সহ দেশের সকল নদ-নদী,খাল-বিল ও জলাশয়কে জীবন্ত সত্ত্বা (লিগ্যাল পারসন) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পাশাপাশি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে আইনগত অভিভাবক (পারসন ইন লোকো প্যারেন্টিস) ঘোষণা করে। ওই রায়ে আরো বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সরকারী ইজারার মাধ্যমে নদী তীরের জমি দখল করে স্থাপনা তৈরী করে থাকলে সেই ইজারাও বাতিল বলে গণ্য হবে ।
নদীকে জীবন্ত সত্ত্বা (লিগ্যাল পারসন) ঘোষণায় বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ রাষ্ট্র। বর্তমান সরকার বা বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮, বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০, বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫, বাংলাদেশ পানি ব্যবস্থাপনা নীতি , জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন ২০১৩, বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্যতা সংরক্ষণ আইন ২০১৭, জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইন ২০১০’সহ প্রতিটি আইনে রিবেশ প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, সকল উন্মুক্ত জলাভূমি, সমুদ্র,নদ-নদী, খাল, বিল , হাওড়-বাঁওড়, ঝিল, সমুদ্রসৈকত,নদীর পাড়, পাহাড়-পর্বত,টিলা,বন,পরিবেশ সংরক্ষণের উপর আইনগত সুরক্ষা দেয়ার অঙ্গীকার করার পাশাপাশি ওই সকল আইন দ্বারা পাবলিক ট্রাস্ট সম্পত্তিকে সুদৃঢ়ভাবে বর্তমান ও ভবিষৎ নাগরিকের জন্য প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। সরকারের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলাসহ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের মাধ্যমে দেশের নদ-নদী-,খাল-বিল,জলাাশয়,হাওড়-বাঁওড়,ঝিল,সমুদ্রসৈকতকে রক্ষার করতে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির বিকল্প নেই । নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে , দেশ বাঁচলে বাঁচবে মানুষ ও প্রকৃতি। এটাই সচেতন মহলের অভিমত।