তোফায়েল আহমদ
সাগর পাড়ের শহর কক্সবাজারের বাসিন্দা হয়ে কত-না গর্ববোধ করি। আজ নিজের কাছেই প্রশ্ন রাখছি-এমন কক্সবাজারই কি চেয়েছিলাম ? যে কক্সবাজারে এমন একটা দিন ছিল-যখন এখানকার মানুষগুলো মেহমানদারি করতে গিয়ে পর্যটকদের নিজের গাছের ডাবটিও কেটে খাইয়েছেন সেই কক্সবাজারের অমানুষগুলো এখন পর্যটকের মুখের ডাবটি কেড়ে খেয়ে ফেলছেন। আহা কি দিন ছিল, যে বাহারছড়া মহল্লার প্রবীণ মানুষগুলো এখানে বেড়াতে আসা দেশী-বিদেশী পর্যটকদের সেবার হাত বাড়িয়েছেন আজ তাদেরই উত্তরসুরিরা (সবাই নয়) একি কান্ড করছে !
আমি এবং আমরা কক্সবাজারবাসী আজ লজ্জিত। দেশী গণমাধ্যমে যেনতেন কিন্তু বিদেশী গণমাধ্যমেও কক্সবাজার সাগর পাড়ে বেড়াতে আসা নারী পর্যটক গণধর্ষনের শিকার হওয়ার বিষয়টি আজ ব্যাপক প্রচার পেয়েছে। এতে করে আমরা কত লাভবান নাকি ক্ষতিগ্রস্থ হলাম তার হিসাব বিবরণী মিলানো বড়ই কঠিন। এমনিতে কতিপয় পর্যটন ব্যবসায়ীর যেন রোষের শিকার আমরা স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীরা। কেননা কক্সবাজারের পর্যটনকে বাঁকা থেকে সোজা পথে চলার জন্য যখনই গণমাধ্যমকর্মীরা সোচ্ছার হয়েছে তখনই নানাভাবে গণমাধ্যমকর্মীদের উপর দোষ চাপানোর একটি যেন মহড়া চালানো রিতীমত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে কিছু অসাধূ ব্যবসায়ীদের।
আমরা বলছি, বিশ্বের দীর্ঘতম সাগর পাড়ের শহর কক্সবাজারে ভ্রমণে আসা পর্যটকদেও মেহমান হিসাবে দেখার জন্য। বলছি তাদের সেবার মনোভাব নিয়ে দেখার কথা। বলছি আমরা, পর্যটকদের সাথে ভাল ব্যবহার দিতে। বলছি হোটেল-মোটেলের কক্ষভাড়া কমিয়ে সহনশীল ভাড়া নেয়ার কথা। বলছি, হোটেল-রেস্তোরার দালালি প্রথা বাদ দিতে। আর এতে কিছু অসাধু মানুষ ক্ষীপ্ত হয়ে উঠে গণমাধ্যমকর্মীদের উপর। এক সময় পাড়া-মহল্লার সদ্দ্র্ারগণ সমাজকে ভাল এবং এলাকার উন্নয়নের জন্য তাগিদ দিতেন। পরবর্তীতে জনপ্রতিনিধি এবং সুশিল সমাজ এমন কাজটির তদারকিও করতেন। এরপর আমলারাও এগিয়ে এসেছেন সমাজের ভালটা রেখে খারাপটাকে বর্জনের আইন চর্চা করতে। কিন্তু এখন কে আছেন এমন কাজটা করার ? কিছুতেই দাবি করছি না গণমাধ্যমকর্মীরা আছেন। তবুও একবার চোখ বন্ধ করে চিন্তা করে দেখুন সমাজটা গোল্লায় যাওয়া থেকে রক্ষার জন্য কারা সবচেয়ে বেশী চিল্লাচিল্লি করে থাকেন ?
আমার বিবেক আজ আমার কাছেই প্রশ্ন করছে-আমি কি করছি ? আমি সত্যির পক্ষে নাকি মিথ্যাকেই বরং লাল-সবুজের রং দিয়ে ফুলিয়ে-ফাঁফিয়ে একটি জঘন্য অপরাধকে ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করছি। বৃহষ্পতিবার সাত-সকালে যখন ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে কক্সবাজার সাগর পাড়ে বেড়াতে আসা দম্পতির গণধর্ষনের শিকারের খবরটি পেলাম তখনই খবরের তথ্য উপাত্ত সংগ্রহে বের হয়ে কাজে নেমে যাই। ঘটনা শুনার পর মাথায় কেবল ঘুরপাক খাচ্ছিল -দুগ্ধপোষ্য আট মাসের শিশুটির কথা। যে শিশুটি বড় হয়ে জানতে পারবে, তার দশ মাস দশ দিন গর্ভে রাখা জননী তাকে নিয়ে এই সেই কলংকের কক্সবাজারে বেড়াতে এসে হায়েনাদের কবলে পড়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। একাত্তরের এই ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেও বাংলার অগণিত মা-বোন হায়েনাদের ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। তবে সেই হায়েনারা ছিল পাকিস্তানী এবং এদেশের দোসররা। আজ ধর্ষণের শিকার হয়েছে আমাদের গর্বের স্থান কক্সবাজারের হায়েনাদের হাতে। ধিক হায়েনার দল!
যেটি না বললেই নয়-পর্যটক নারী ধর্ষণের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে ভাল লেগেছে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে যে আমেরিকা কিনা বাংলাদেশের এলিট ফোর্স-র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র্যাব) নিয়ে নেতিবাচক তথ্য প্রচার করেছিল সেই বাহিনীরই একদল সদস্য সংবাদ পাবার সাথে সাথেই ছুটে গিয়ে ধর্ষিতা পর্যটক নারীর সেবায় এগিয়ে এসেছেন। সেই র্যাব সদস্যরাই বিজয়ের এই ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে হায়েনাদের কবল থেকে উদ্ধার করেছে একজন ধর্ষিতা পর্যটক নারীকে। মানবতার কাজটি কত দ্রুত গতিতে র্যাব সদস্যরা করেছেন তা জানার পর আমার কেবল জানতে ইচ্ছা করে-মিঃ আমেরিকা এবার কি বলবেন ? কেবল তাই নয় র্যাব সদস্যরাই খুঁজে বের করেছেন জিয়া গেষ্ট ইন নামের একটি হোটেলের ম্যানেজার হয়ে রিয়াজুদ্দিন ছোটন নিজেই সেই হায়েনার দলেরই একজন সক্রিয় সদস্য। অপরদিকে পর্যটক নারী ধর্ষণের এমন পৈশাচিক ঘটনাটিকে ‘সন্দেহজনক’ ঘটনা বানানোর জন্য কারও কারও আপ্রাণ চেষ্টার বিষয়টি আঁচ করতে পেওে নিজেই লজ্জিত হচ্ছি। মনে মনে বলি-আমরা কখন অমানুষ থেকে মানুষ হব ?