মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেছেন, একটি রাষ্ট্র শক্তিশালী তখনই হয়, যখন সে দেশের বিচার বিভাগ স্বাধীন ও শক্তিশালী থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ শক্তিশালী হওয়ায় রাষ্ট্রের ভিতও মজবুত রয়েছে।

জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস-২০২৪ উপলক্ষে রোববার (২৮ এপ্রিল) সকালে কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের সম্মেলন কক্ষে কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড কমিটি আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন। তিনি বলেন, তিনি প্রধান বিচারপতি থাকাবস্থায় যখন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ হতো তখন প্রধানমন্ত্রী বলতেন, প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় বা রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের কারো নিকট থেকে কোন আবদার বা চাপ আসলে সাথে সাথে তাঁকে জানাতে বলেছিলেন। সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে দুটি ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নম্বর দিয়েছিলেন। সেখানে যাতে আমি যোগাযোগ করি। সাবেক প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন, বিচার বিভাগ আরো শক্তিশালী ও আরো স্বাধীন হউক। তিনি আরো বলেন, তিনি যখন প্রধানমন্ত্রীকে বললেন, বিচারক আইনজীবীদের জন্য আদালত প্রাঙ্গণে ভবন আছে, বসার জায়গা আছে কিন্তু আদালতে আসা বিচারপ্রার্থীদের জন্য বসার, বিশ্রাম নেওয়ার কোন জায়গা নাই। বিচারপ্রার্থী ও তাদের স্বজনেরা আদালতের কাজে আসলে দুর্ভোগে পড়তে হয়। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর কথার গুরুত্ব দিয়ে তাঁর প্রস্তাব মতে ৬৪ জেলার আদালত এলাকায় বিচারপ্রার্থীদের বসার জন্য “ন্যায়কুঞ্জ” স্থাপনের নির্দেশ দেন। কোভিড-১৯ পরিস্থিতি, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যুদ্ধ সহ বিভিন্ন পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব বেশি ভাল না হওয়া সত্বেও প্রায় ৩০০ কোটি ব্যয়ে দেশের ৬২ টি জেলায় “ন্যায়কুঞ্জ” স্থাপন করা হয়েছে। কক্সবাজার সহ বাকী ২ টি জেলায় “ন্যায়কুঞ্জ” নির্মান কাজ শুরু হয়েছে। আদালত প্রাঙ্গণে “ন্যায়কুঞ্জ” স্থাপনের ফলে এখন বিচারপ্রার্থী, তাদের স্বজন ও আদালতে আসা বিভিন্ন সেবাপ্রার্থীদের জন্য বসার ও বিশ্রামের জায়গা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, মানুষ অপেক্ষাকৃত দ্রুততম সময়ে যাতে বিচার পায়, সেজন্য সম্মিলিতভাবে সবাইকে কাজ করতে হবে। এতে নাগরিক অধিকার নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস আরো বাড়বে।

সাবেক প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী আরো বলেন, দেশের বিচারকেরা প্রায় সকলেই সৎ, পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবান ও পেশাদারিত্ব নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু আদালতে বিচারকদের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে যতো মামলা নিষ্পত্তি হয়, আবার একই সময়ে তার চেয়েও বেশি মামলা দায়ের হয়। তাই মামলা জট কমাতে লিগ্যাল এইড এর মাধ্যমে এডিআর পদ্ধতির গুরুত্ব খুব বেশি। সকলেই যাতে বিচার পায়, সেজন্য লিগ্যাল এইড এর সৃষ্টি। এজন্য লিগ্যাল এইড কার্যক্রম আরো অধিকতর গতিশীল করতে হবে। তিনি কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের মামলা নিষ্পত্তি, কাবিনের টাকা আদায়ের হার সহ সার্বিক কার্যক্রমের ভিডিও কনটেন্ট দেখে ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি আরো বলেন, সীমিত সম্পদ হওয়া সত্বেও বিচার বিভাগের উন্নয়নে, বিচার বিভাগের বিভিন্ন সংকট ও সমস্যা সমাধানে বর্তমান সরকার আন্তরিকতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। ২৬৯ কোটি ব্যয়ে সরকার সুপ্রীম কোর্টে রেকর্ড রুম নির্মাণ করে দিয়েছে।

তিনি বলেন, সকল নাগরিকের তাঁর অধিকার সম্পর্কে জানারও অধিকার রয়েছে। বিরোধ নিয়ে নিয়মিত বিচারিক কার্যক্রমে যাওয়ার আগে সমঝোতা ও আপোষ মিমাংসার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি করার বিষয়টি হতে হবে বিচারক ও আইনজীবীদের প্রধান উদ্দেশ্য।

কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ এবং জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির সভাপতি মুনসী আব্দুল মজিদ এর সভাপতিত্বে “স্মার্ট লিগ্যাল এইড, স্মার্ট দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ” প্রতিপাদ্য নিয়ে পালিত হওয়া দিনব্যাপী অনুষ্ঠান মালার আলোচনা সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, কক্সবাজারের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক (জেলা জজ) মোহাম্মদ মোসলেহ উদ্দিন, কক্সবাজারের চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল্লাহ আল মামুন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (উন্নয়ন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা) রুবাইয়া আফরোজ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) জসিম উদ্দিন, জিপি অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ইসহাক, ইউএনএইচসিআর-এর সিনিয়র প্রটেকশন অফিসার হিরোশি মিয়াউচি, কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ তাওহীদুল আনোয়ার, কক্সবাজার প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকার পরিচালনা সম্পাদক মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির প্যানেল আইনজীবী অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী প্রমুখ।

সিনিয়র সহকারী জজ সায়মা আফরীন হীমা’র সঞ্চালনায় আলোচনা সভার শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন জেলা ও দায়রা জজ মুনসী আব্দুল মজিদ, জেলা লিগ্যাল এইড কক্সবাজার জেলা কমিটির সার্বিক কার্যক্রমের উপর বক্তব্য রাখেন এবং ভিডিও কনটেন্ট উপস্থাপন করেন জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার (ভা:) ও সিনিয়র সহকারী জজ আবদুল মান্নান। এছাড়া আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা আইআরসি’র প্রতিনিধি মোস্তাফিজুর রহমান আইনী সহায়তার উপর ভিডিও পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপন করেন।

সভায় কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির সুবিধাভোগী আনোয়ারা বেগম ও হামিদ হোছাইন তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করেন। আলোচনা সভার শুরুতে অনুবাদ সহ কোরআন তেলাওয়াত করেন রামু’র সিনিয়র সহকারী জজ আব্দুল মান্নান, গীতা পাঠ করেন অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ চতুর্থ আদালতের বেঞ্চ সহকারী প্রনব কান্তি শর্মা ও ত্রিপিটক পাঠ করেন যুগ্ম জেলা ও দায়রা দ্বিতীয় আদালতের বেঞ্চ সহকারী সেতু বড়ুয়া।

সভাপতির বক্তব্যে কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মুনসী আব্দুল মজিদ বলেন, লিগ্যাল এইড আইন সরকারের অনবদ্য সৃষ্টি। এই আইন দেশের সকল নাগরিকের বিচার পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকারের পরিপূর্ণতা এনে দিয়েছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকায় তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান জেলা ও দায়রা জজ মুনসী আব্দুল মজিদ। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি সাবেক প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন জেলা ও দায়রা জজ মুনসী আব্দুল মজিদ।

আলোচনা সভার পর প্রধান অতিথি সাবেক প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী লিগ্যাল এইড মেলা পরিদর্শন করে সন্তোষ প্রকাশ করেন। সভায় শ্রেষ্ঠ প্যানেল আইনজীবী যথাক্রমে পুরুষ ক্যাটাগীরতে অ্যাডভোকেট আবদুর রশিদ ও মহিলা ক্যাটাগরীতে অ্যাডভোকেট ইয়াসমিন শওকত জাহান রোজীকে পুরস্কার প্রদান করা হয়। একইসাথে ৬ জন ব্লাড ডোনারকেও পুরস্কৃত করা হয়।

দিবসটি উপলক্ষে লিগ্যাল এইড এর তাৎপর্য তুলে ধরে বিচারক ও আইনজীবীদের লেখা নিয়ে কক্সবাজারের বহুল প্রচারিত পত্রিকা দৈনিক কক্সবাজার রোববার (২৮ এপ্রিল) ক্রোড়পত্র বের করে।

এছাড়া, দিবসটি পালন উপলক্ষে রোববার সকাল ৮ টায় কক্সবাজার জেলা জজ আদালত প্রাঙ্গণে কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ এবং জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান মুনসী আব্দুল মজিদ বর্নাঢ্য র‍্যালীর উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের পর র‍্যালীটি কক্সবাজার শহরের প্রধান সড়ক গুলো প্রদক্ষিণ করে।

কক্সবাজারে দিবসের দিনব্যাপী পালিত অন্যান্য কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে অভিজ্ঞ আইনজীবীদের মাধ্যমে জেলা জজ আদালত প্রাঙ্গণে আগ্রহী সেবাপ্রার্থীদের বিনামূল্যে দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইনী সেবা প্রদান, স্বেচ্ছায় রক্তদান, ফ্রী ব্লাড গ্রুপিং, ফ্রী মেডিকেল চিকিৎসা সেবা, ওজন পরিমাপ, ডায়াবেটিস পরীক্ষা, আইনী বইপত্র ও লিগ্যাল এইড সংক্রান্ত বইপত্রের স্টল, লিগ্যাল এইড মেলা অনুষ্ঠিত হয়। কক্সবাজার জেলা জজ আদালত প্রাঙ্গণে দিনব্যাপী মেলা ও এসব অনুষ্ঠানমালা চলে। একইদিন “জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস-২০২৪” উপলক্ষে প্রচার প্রচারণার অংশ হিসাবে দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে বাংলাদেশ বেতার কক্সবাজার স্টেশনে কক্সবাজারের জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার (ভা:) ও সিনিয়র সহকারী জজ আবদুল মান্নান কর্তৃক পাঠ করা কথিকা প্রচার করা হয়।

অনুষ্ঠানমালায় বিচারক, আইনজীবী, জেলার বিভিন্ন সরকারি দফতর ও সংস্থার প্রতিনিধি, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি, জাতীয় ও আন্তজার্তিক বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধি, বিশিষ্টজন, লিগ্যাল এইড কমিটির সুবিধাভোগীরা অংশ নেন। দিবসটি উপলক্ষে পুরো কক্সবাজার শহর উৎসবমুখর হয়ে উঠে।