কফিল উদ্দিন আনু :

কক্সবাজারের উখিয়ার চাঞ্চল্যকর ফোর মার্ডার ঘটনার প্রায় সাড়ে তিন বছর অতিবাহিত হতে চললেও এ পর্যন্ত হত্যা কাণ্ডের কোনো ক্লু উদঘাটন করতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই কক্সবাজার। ২০১৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে উখিয়ার রত্নাপালং ইউনিয়নের পূর্ব রত্নাপালং বড়ুয়া পাড়ায় খুন হন রুকেন বড়ুয়ার পরিবারের চার সদস্য। পরদিন ২৬ সেপ্টেম্বর মামলা রুজু হওয়ার পর সন্দেহজনক ভাবে রুকেন বড়ুয়ার ভাইঝি নিহত সনি বড়ুয়ার মা রিপু বড়ুয়া, নিহত মিলা বড়ুয়ার বড় বোনের স্বামী অসীম বড়ুয়া দ্বীপচান ও রুকেন বড়ুয়ার ভাগিনীর স্বামী উজ্জ্বল বড়ুয়াকে গ্রেপ্তারপূর্বক আদালতে প্রেরন করা হলেও তারা হত্যা কান্ডের সাথে জড়িত মর্মে কোন ধরনের তথ্য দিতে পারেনি মামলার তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই। এ ছাড়াও সন্দেহভাজন অন্তর বড়ুয়া, অসীম বড়ুয়া, বাবুল বড়ুয়া, আনন্দ বড়ুয়া নিতু, ভাগ্যধন বড়ুয়া ও সোমানন্দ বড়ুয়া প্রকাশ টমটমচালক লুধা বড়ুয়া সহ আরো অনেককে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেও কোন ধরনের কুল কিনারা খুঁজে পায়নি তদন্তকারী সংস্থা।

আদালত সূত্রে জানা যায়, বিগত ২০১৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সকাল বেলায় উখিয়ার পূর্ব রত্নাপালং বড়ুয়া পাড়ার রুকেন বড়ুয়ার দালান বাড়ির পূর্ব পাশের্^র উত্তরের কক্ষ থেকে রুকেন বড়ুয়ার মা সুখি বড়ুয়া (৭০) ও পশ্চিম পাশের্^র উত্তর কক্ষ থেকে স্ত্রী মিলা বড়ুয়া (২৫) এবং মধ্যম কক্ষ থেকে ছেলে রবিন বড়ুয়া (৫) ও ভাইঝি সনি বড়ুয়া (৬) এর গলাকাটা মৃতদেহ উদ্ধার করে উখিয়া থানা পুলিশ। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ থাকায় এবং দালান বাড়ীর ছাঁদের দরজা খোলা থাকায় পুলিশ দালান বাড়ীর ছাঁদের দরজা দিয়ে বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করে মৃতদেহগুলো উদ্ধার করে। ওই ঘটনায় নিহত মিলা বড়ুয়ার বাবা শশাঙ্ক বড়ুয়া বাদী হয়ে ২৬ সেপ্টেম্বর রাতেই অজ্ঞাতনামা আসামীদের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। যার মামলা নং- ৪৭। মামলাটি কিছুদিন উখিয়া থানা পুলিশ তদন্ত করে এবং পরবর্তীতে মামলাটির তদন্তভার পিবিআই কক্সবাজার গ্রহণ করে।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, হত্যাকান্ডের ঘটনার রাতে ২৫ সেপ্টেম্বর রাত ৯টা ১৭ মিনিটে নিহত মিলা বড়ুয়ার বাবা শশাঙ্ক বড়ুয়া (বাদী) মিলা বড়ুয়ার সাথে মুঠোফোনে কথা বলেন। বাদীর ধারনা, ২৫ সেপ্টেম্বর রাত ৯টা ১৭ মিনিটের পর থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর ভোর ৬ টার মধ্যে যেকোন সময়ে অজ্ঞাতনামা আসামীরা হত্যাকান্ডের ঘটনাটি সংঘটিত করেছে।

এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, রুকেন বড়ুয়ার পিতা প্রবীন বড়ুয়া রোগে ভোগে দীর্ঘ বছর পূর্বে মৃত্যুবরন করেন। তৎ সময় হতে রুকেন বড়ুয়ার বড় ভাই রবিসন বড়ুয়া ও দীপু বড়ুয়া সংসারের হাল ধরেন। অতি কষ্টের সংসারে এক সময় দীপু বড়ুয়া আরব আমিরাত দুবাই যান। পরবর্তীতে রবিসন বড়ুয়া ও দিপু বড়ুয়ার সহযোগিতায় রোকেন বড়ুয়া কুয়েত যান। এর পরে তাদের কষ্টের সংসারে আস্তে আস্তে স্বচ্ছলতা ফিরে আসে। এক সময় রুকেন বড়ুয়া বিপুল টাকা সম্পদের মালিক হয়ে আলাদা ভাবে দালান ঘর নির্মাণ করে বসবাস করে আসছিলেন।

এদিকে রোকেন বড়ুয়ার বড় ভাই শিপু বড়ুয়া পরিবারের অজান্তে চকরিয়া থানাধীন মানিকপুর গ্রামের রিপু বড়ুয়াকে বিবাহ করেন। বিবাহটি পরিবারের লোকজন মেনে না নেয়ায় বিশেষ করে রুকেন বড়ুয়ার ভয়ে শিপু বড়ুয়া তার স্ত্রী রিপু বড়ুয়াকে নিয়ে মানিকপুর সহ বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করেন। এক সময় রোকেন বড়ুয়া কুয়েত দেশে থাকাকালীন সময়ে মা সুখী বড়ুয়া উক্ত শিপু বড়ুয়া ও তার স্ত্রী রিপু বড়ুয়াকে পুরনো মাটির দেওয়াল ঘরের একপাশের্^ থাকার জায়গা করে দেন। শিপু বড়ুয়াকে ঘরে জায়গা দেয়ার কারনে রোকেন বড়ুয়া প্রচন্ড রেগে যান। যার কারনে রুকেন বড়ুয়া ২/৩ বছর পর পর দেশে এসে শিপু বড়ুয়া ও তার স্ত্রী রিপু বড়ুয়াকে বসত ঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য বহু বার মারধর করেন। এক কথায় রুকেন বড়ুয়া তার ভাবী রিপু বড়ুয়া ও তার সন্তানদেরকে মোটেও সহ্য করত না।

হত্যাকান্ড ঘটনা ঘটার মাস ছয়মাস পূর্বে রুকেন বড়ুয়া দেশে আসে এবং ঘটনার প্রায় মাস খানেক পূর্বে কুয়েত দেশে চলে যান। ওই সময়ে রুকেন বড়ুয়া দেশে অবস্থানকালীন সময়ে রুকেন বড়ুয়া তার ভাবী রিপু বড়ুয়াকে স্বামী সন্তানকে নিয়ে বসত ঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য মারধর করে। তাছাড়া পারিবারিক অজ্ঞাত কারনে রুকেন বড়ুয়া ও তার মা সুখি বড়ুয়ার মধ্যে তুমুল বাকবিতন্ডার মত ঘটনাও ঘটেছিল।

হত্যাকান্ডের দিন সন্ধ্যায় শিপু ও রিপু বড়ুয়ার মেয়ে সনি বড়ুয়া রুকেন বড়ুয়ার ঘরে আসলে তার দাদী সুখি বড়ুয়া সনি বড়ুয়াকে রুকেন বড়ুয়ার ঘরে রেখে দেন। ওই রাতেই নৃশংস হত্যাকান্ডের ঘটনাটি সংঘটিত হয়।

হত্যাকান্ড সংঘটিত হওয়ার পূর্বে ২৫ সেপ্টেম্বর বিকাল বেলায় রুকেন বড়ুয়ার স্ত্রী মিলা বড়ুয়া ও একমাত্র পুত্র রবিন বড়ুয়া কোটবাজারে বাজার সওদা করতে আসেন। রুকেন বড়ুয়ার বড় বোন বেনু বড়ুয়া মিলা বড়ুয়াকে বাজার করতে সহযোগিতা করেছিল। ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর অর্থাৎ ২৬ সেপ্টেম্বর সকাল বেলায় রুকেন বড়ুয়ার বড় বোন বেনু বড়ুয়াকে বিলাপ করে বলতে শুনা গেছে, ঘটনার দিন রাতে ঘরে মেহমান আসার কথা ছিল। ঘরে একটি কালো পলিথিনে আপেলের সন্ধানও পাওয়া গিয়েছিল! কিন্তু পরবর্তীতে বেনু বড়ুয়ার বিলাপ কণ্টে বলা ঘরে মেহমান আসার কথা রহস্যজনক কারনে গোপন হয়ে যায়। পারিবারিক কোন্দলের কারনে উক্ত রোকেন বড়ুয়া নিজেই সন্ত্রাসী ভাড়া করে কৌশলে হত্যা কান্ডের ঘটনাটি সংঘটিত করতে পারে বলে এলাকাবাসী সহ সচেতন মহলের অভিযোগ।

মামলায় আটক হওয়া অসীম বড়ুয়া দ্বীপচান ঘটনার সাথে জড়িত নয় দাবী করে জানান, রুকেন বড়ুয়ার স্ত্রী মিলা বড়ুয়া আমার শালী অর্থাৎ আমার ছোট বোনের মত। রুকেন বড়ুয়া পূর্ব শত্রুতার জের ধরে পিবিআইকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আমাকে আটক করিয়েছিলেন। ধুরন্দর চতুর রুকেন বড়ুয়া তার পারিবারিক কোন্দলের কারনে ভাড়াটে কিলার দ্বারা সে নিজেই হত্যাকান্ডের ঘটনাটি সংঘটিত করতে পারে।

এলাকাবাসী সূত্রে আরো জানা যায়, ঘটনার সময় রুকেন বড়ুয়া কুয়েত ছিলেন। পরদিন অর্থাৎ ২৭ সেপ্টেম্বর রুকেন বড়ুয়া দেশে আসেন। ঘটনার কিছু দিন পর হতে রুকেন বড়ুয়া হিংশ্র হয়ে উঠেন। প্রথমে তার ভাই শিপু বড়ুয়াকে ঘর ছাড়া করেন এবং পরে বড় ভাই রবিসন বড়ুয়াকে ঘর ছাড়া করে পুরনো ঘরটি সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙ্গে ফেলেন। তাছাড়া জায়গা সম্পত্তির লোভে পড়ে টাকার জোরে উক্ত রুকেন বড়ুয়া তার জেঠাত ভাই আনন্দ বড়ুয়া নিতু, বাবুল বড়ুয়াকে সহ আরো অনেককে বিভিন্ন ভাবে হয়রানী করেন। এমনকি রুকেন বড়ুয়ার বসত ভিটা সংলগ্ন আনন্দ বড়ুয়া নিতুর একটি সুপারী বাগান স্বয়ং রোকেন বড়ুয়া জোর দখলে নিয়ে আনন্দ বড়ুয়া নিতুকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে স্বপরিবারকে এলাকাছাড়া করেন। এছাড়া রুকেন বড়ুয়া তার জেঠা টুনুরাম বড়ুয়ার পরিবার, মামা শিশু বড়ুয়ার পরিবারকে সহ এলাকার অনেককে ধারালো দা হাতে হত্যার চেষ্টাও করেছেন। এক কথায় যার সাথে শত্রুতা সৃষ্টি হয় তাকেই ফোর মার্ডার মামলায় আসামী করবে বলে হুমকিও দেন। যার কারনে এলাকার কেউ প্রাণ ভয়ে ও মিথ্যা মামলায় ফাঁসার ভয়ে রুকেন বড়ুয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। রোকেন বড়ুয়া অল্প সময়ের মধ্যে জিরো থেকে এত সম্পদ ও টাকা পয়সার মালিক বনে যাওয়াও প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করছেন এলাকাবাসী। উক্ত রোকেন বড়ুয়া সহ বড় বোন বেনু বড়ুয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে থলের বেড়াল বেরিয়ে আসবে বলে দাবী এলাকাবাসীর ।

পিবিআই কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার মো. সরওয়ার আলম বলেন, এটি একটি চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা। এর তদন্তের দায়িত্ব আমি নিজে পালন করছি। এটি সার্বক্ষণিক আমাদের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মনিটরিং করছেন। তবে এ মামলার বিষয়ে কথা বলার সময় এখনো আসেনি।