নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশের অন্যতম বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) কোস্ট ফাউন্ডেশনের ‘আরএইচএল’ প্রকল্পের পরিচিতি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বুধবার (১৫ মে) দুপুরে জেলা পরিষদের কনফারেন্স হলে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডঃ শফিকুর রহমান।

অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন কোস্ট ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক (এন্টারপ্রাইজ ডেভেলপমেন্ট) মো. বারেকুল ইসলাম চৌধুরী।

সহকারী পরিচালক ও কক্সবাজার আঞ্চলিক টীম লিডার জাহাঙ্গীর আলমের সঞ্চালনায় ওয়ার্কশপে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন, জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. সাহাব উদ্দিন, ভেটেরিনারি কনসালটেন্ট ডা. রফিকুল ইসলাম, মৎস্য ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের উপ-পরিচালক মোঃ রায়হান, কক্সবাজার পৌরসভার কাউন্সিলর এস আই এম আক্তার কামাল আজাদ, সদর উপজেলা কৃষি অফিসার মোঃ জাহিদ হাসান।

পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর সহায়তায় কর্মশালায় মাল্টিমিডিয়া প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে ‘আরএইচএল’ প্রকল্পের বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করেন মোহাম্মদ আবু নাঈম।

তিনি তথ্য দেন, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জীবন ও সম্পদের ঝুঁকি কমাতে কাজ করছে কোস্ট ফাউন্ডেশন। এই লক্ষ্যে তারা আরএইচএল প্রকল্প হাতে নিয়েছে।

চরম জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় তাঁদের উন্নত ও টেকসই বিকল্প জীবিকার উপায় প্রদান করাই কোস্টের অন্যতম লক্ষ্য।

উপস্থাপিত তথ্যমতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার জনগোষ্ঠী মূলত তিনটি ঝুকির মধ্যে পতিত হচ্ছে:

(ক) জলবায়ু সংবেদনশীল জীবিকা:
উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ বাসিন্দা মৌসুমী কৃষি এবং কৃষি মজুরিভিত্তিক শ্রমের ওপর নির্ভরশীল, যা অত্যন্ত জলবায়ু-সংবেদনশীল। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের (সুমদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অনিয়মিত বৃষ্টি; সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাস) ফলে প্রতিনিয়ত উপকূলীয় এলাকার জনগোষ্ঠীর জীবিকা উপার্জনের সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে, জনগোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ স্থানান্তর (internal migration) বৃদ্ধি পাচ্ছে।

(খ) নিচু এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ বসতি:
উপকূলীয় বাসিন্দাগণ স্থানীয় বাঁশ, কাঠ ও মাটি দিয়ে তৈরি বাড়ীতে বসবাস করে, যা ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং উচ্চ জোয়ারে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জলবায়ু-সহনশীল আবাসনের অভাব একটি গুরুতর দারিদ্র্যের ফাঁদ তৈরি করে, কারণ উপকূলীয় বাসিন্দাদের আয়ের বেশিরভাগ ঘর-বাড়ী মেরামতের জন্য ব্যয় করতে হয়, এমনকি স্থানীয় বাসিন্দাগণ ধার-দেনা করেও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছাসে ক্ষতিগ্রস্ত ঘর-বাড়ী মেরামত করে থাকেন।

(গ) নিরাপদ পানীয় জলের অভাব:
সমূদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে উপকূলীয় এলাকায় দেখা যাচ্ছে তীব্র খাবার পানির সংকট।

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জীবন ও সম্পদের ঝুঁকি হ্রাস করা এবং চরম জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় তাঁদের উন্নত ও টেকসই বিকল্প জীবিকার উপায় প্রদানের লক্ষ্যে জিসিএফ-এর অর্থায়নে পিকেএসএফ “Resilient Homestead and Livelihood Support to the Vulnerable Coastal People of Bangladesh (সংক্ষেপে RHL)” শীর্ষক প্রকল্পটি গত ১০-১৩ জুলাই ২০২৩ সময়ে অনুষ্ঠিত জিসিএফ-এর ৩৬তম বোর্ড সভায় অনুমোদন পায়।

প্রকল্পটি সাতটি উপকূলীয় জেলার (কক্সবাজার, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও খুলনা) ২৯টি উপজেলার আনুমানিক ৩৬২, ৪৭৫জন লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা পাবে। পাঁচ বছর মেয়াদী প্রকল্পটির মোট বাজেট ৪৯.৯৮ মিলিয়ন ইউএস ডলার, যার মধ্যে ৪২.২০ মিলিয়ন ইউএস ডলার জিসিএফ প্রকল্প সহায়তা (grant) হিসেবে প্রদান করবে অবশিষ্ট ৭.৭৮ মিলিয়ন ইউএস ডলার সহায়ক তহবিল) এবং in-kind contribution হিসেবে পিকেএসএফ ও সহযোগী সংস্থা প্রদান করবে। প্রকল্পটির উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে:

(১) উপকূলীয় এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তন সহনশীল বাড়ি নির্মাণ/পুনঃনির্মাণ/বসতভিটা উচুকরণ,

(২) কাঁকড়া হ্যাচারি। নার্সারী স্থাপন ও জলবায়ু পরিবর্তণ সহনশীল কাঁকড়া চাষ,

(৩) মাঁচা পদ্ধতিতে ছাগল/ভেড়া পালন,

(৪) বসতবাড়ীর আঙিনায় লবণাক্ততা সহনশীল সবজি চাষ,

(৫) বাড়ীর আঙ্গিনায় এবং কাঁকড়া ঘেরে ম্যানগ্রোভ বনায়ন ইত্যাদি।

পাঁচ বছর মেয়াদী প্রকল্পটি বাংলাদেশের সাতটি উপকূলীয় জেলার জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়ের জলবায়ু পরিবর্তনে টিকে থাকার সক্ষমতা (Climate resilience) এবং আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে সুবিধাভোগীদের জীবন ও জীবিকার মান উন্নয়ন করবে। পিকেএসএফ-এর ১৬টি সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে প্রকল্পটি মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পের “প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা” নির্বাচনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতকর্তা, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতকল্পে একটি কমিটি গঠন করা হয়। গঠিত কমিটি “প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা” নির্বাচনের জন্য প্রকল্প দলিলে বর্ণিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নিম্নোক্ত ১৬টি সংস্থাকে নির্বাচন করে।

ওয়ার্কশপে জানানো হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। প্রায় প্রতি বছর এ দেশ বড় ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত বাংলাদেশের জনগণের দৈনন্দিন জীবন-জীবিকায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ফলশ্রুতিতে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকে সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন কর্মকান্ড বাস্তবায়ন করছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় যে কয়েকটি আন্তর্জাতিক তহবিলের সংস্থান রয়েছে; তন্মধ্যে United Nations Framework Convention on Climate Change (UNFCCC) বা জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক জাতিসংঘ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের আওতায় দুটি তহবিল Green Climate Fund (GCF) এবং Adaptation Fund (AF) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ২০১০ সালে ১৬তম Conference of the Parties (COP)-এর সিদ্ধান্তক্রমে GCF গঠন করা হয়। এর উদ্দেশ্য হলো গ্রীন হাউস গ্যাসের নির্গমন কমানো বা প্রশমন (Mitigation) করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের সাথে অভিযোজন (Adaptation) কার্যক্রমে উন্নয়নশীল দেশসমূহকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করা। উন্নত দেশসমূহ ২০২০ সাল হতে জলবায়ু পরিবর্তন খাতে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এ অর্থ অভিযোজন ও প্রশমন উভয় খাতে সমান ভাগে ব্যয় করা হবে। উন্নত দেশসমূহ কর্তৃক প্রদত্ত এ অর্থের একটি অংশ GCF এর মাধ্যমে ব্যয় করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) Green Climate Fund এবং Adaptation Fund এ-দু’টি তহবিলের Accredited Entity হিসেবে কাজ করার স্বীকৃতি অর্জন করেছে এবং GCF এর অর্থায়নে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য সংবেদনশীল, জলবায়ু পরিবর্তন উপকূলীয় অঞ্চলের বসবাসকারীদের জীবন ও জীবিকার ওপর নতুন নিতিবাচক প্রভাব তৈরি করছে। ১৯টি জেলা নিয়ে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল গঠিত, যা দেশের মোট ভূমির প্রায় ২০% এবং চাষযোগ্য জমির ৩০% এর বেশি। এ উপকূলীয় অঞ্চলে ৩৫ মিলিয়নেরও বেশি লোকের বাসস্থান, যার মধ্যে ৩০% এরও বেশি দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। প্রতি দশ বছরে উপকূলীয় এলাকার গড় তাপমাত্রা ০.০৯৭° সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং উপকূলীয় এলাকা ইতিমধ্যে উচ্চ লবণাক্ততার (১৫ পিপিটি) সংস্পর্শে এসেছে। ১৯০১ থেকে ২০১০ সালে মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর ১.৭ মিমি বেড়েছে এবং ১৯৯৩ থেকে ২০১০ পর্যন্ত প্রতি বছর ২.৮৭০.৮ মিমি বেড়েছে। এটি ২১০০ সালের মধ্যে ০.৫৩ থেকে ০.৯৭ মিটারের মধ্যে বৃদ্ধির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে যা বিশ্বব্যাপী অন্যান্য অঞ্চলের গড় বৃদ্ধির হার থেকে বেশি।

ওয়ার্কশপে কক্সবাজার হাশেমিয়া কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা রহমত সালাম, কক্সবাজার পৌরসভার কাউন্সিলর জাহেদা আক্তার, খুরুশকুল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ শাহজাহান, চৌফলদন্ডি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমানসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি অফিস ও দপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।