অনলাইল ডেস্ক:
পশ্চাতের যুগ থেকে বেরিয়ে আসতে আমরা শিক্ষাগ্রহণ করে থাকি। শিক্ষা মন ও আত্মার সর্বোচ্চ বিকাশ সাধনে সহযোগিতা করে। শিক্ষাবিদ তৈরিতেই সীমাবদ্ধ নয়, শিক্ষা মূল্যবোধ এবং দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের প্রক্রিয়া। আর সেই শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ে চলছে নানারূপী বাণিজ্য। কর্মকর্তারা নিজের জীবনের বিলাসিতার জন্য কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বই তুলে দিচ্ছে গরুর গোয়ালঘর, পাট কিংবা ফসলি ক্ষেতে। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের নামে বই দেওয়া হচ্ছে কর্তৃপক্ষের নেই কোনো তদারকি। বাস্তবে প্রতিষ্ঠান আছে কি মাঠে? সেখানে কতগুলো শিক্ষার্থী আছে, তারা করছে কী? তাহলে ঘুরে দেখি কি অবস্থা অফিস আর মাঠে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নীলফামারী ডিমলা উপজেলার কথা সেখানে উপজেলা মাধ্যমিক ও শিক্ষা অফিস সূত্রে ৯৪টি ইবতেদায়ীতে গড়ে ১৫ হাজার শিক্ষার্থী। প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণিতে রয়েছে ৬ হাজার, ৩ শ্রেণিতে ৪ হাজার ও চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণিতে ৬ হাজার শিক্ষার্থী। অন্যদিকে ১২৫টি রেজিস্ট্রেশনকৃত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। গড়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৮ হাজার। প্রতি ক্লাসে রয়েছে ৩ হাজার ৬০০ জন শিক্ষার্থী। ইতোমধ্যে বই বিতরণ শেষ, বিদ্যালয়ে নিয়মিত হচ্ছে পাঠদান। আসলে কী পাঠদান চলছে, নাকি বিদ্যালয়ের মাঠে ফসল দুলছে।
সরেজমিনে যেমন ছিল প্রতিষ্ঠান
মাঠ পর্যায়ে ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার গয়াবাড়ী মাস্টারপাড়া শিশু মঙ্গল বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে প্রায় ২ শতাধিক শিক্ষার্থী দেখানো হলেও নেই কোনো শিক্ষার্থী কিংবা পাঠদানের ব্যবস্থা। বিদ্যালয়ের মাঠ ও রুমে লাগানো হয়েছে পাট, গরুর ঘাস আর সবজি। পড়ে রয়েছে মাঠের ওপরে টিনশেডে একটি চারচালা ঘর, নেই বেড়া, নেই তার দ্বার। বিদ্যালয় কবে হবে জাতীয়করণ, নেই তার কোনো হদিস। প্রতিষ্ঠানটিতে ইতোমধ্যে তিন সেট শিক্ষক বদলিও হচ্ছে। বিনিময়ে কমিটির ঘরে যাচ্ছে মোটা অংকের অর্থ।
দক্ষিণ খড়িবাড়ী বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে আরেক প্রতিষ্ঠানে গিয়ে জানা গেছে, বিদ্যালয়টি চালু করেছিল কিন্ডারগার্টেন হিসেবে। পরে প্রতিষ্ঠাতা আব্দুর রাজ্জাক শিক্ষা কর্মকর্তাকে দিয়ে করে নিয়েছে রেজিস্ট্রেশন। কিছুদিন পরে দেখা মিলেনি কোনো শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষকের। টিনশেড ঘর ঠিকই পড়ে রয়েছে, বিদ্যালয়েও যাচ্ছে বই। সেখানে দেখানো হয়েছে ১৮০ জন শিক্ষার্থী। তাহলে কী তারা আসলেই নিয়মিত ক্লাসে যাচ্ছে। যাচ্ছে বটে, অন্য প্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ-অষ্টম শ্রেণিতে। পরীক্ষা এলেই দেখানো হচ্ছে নকল ফলাফল।
পূর্ণাঝার ইবতেদায়ী স্বতন্ত্র মাদ্রাসাতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঠিকই দাঁড়িয়ে আছে। তবে শিক্ষার্থীর রূপ বদলে গেছে। অর্থাৎ ওই মাদ্রাসায় মানুষের পরিবর্তে পালিত হচ্ছে গরু। একটি ঘর স্থাপন থাকলেও সেখানে ব্যবহার হচ্ছে গোয়াল ঘর হিসেবে। প্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষক রয়েছেন প্রতিষ্ঠাতার স্ত্রী নিজে। তা ছাড়া শিক্ষক হিসেবে রয়েছেন তারই ছোট ভাই। হাল ছাড়েননি, তাদের প্রতিষ্ঠানও একদিন জাতীয়করণ অথবা এমপিও হবে।
তেমনি হাল ছাড়েননি ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত জটুয়া খাতা স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার কমিটি কিংবা শিক্ষকরাও। বেশ কিছু দিন আগেই নিয়োগ দিলেন শারমিন আক্তার নামের শিক্ষককে। কমিটির বাণিজ্য হলেও উন্নত হয়নি প্রতিষ্ঠানের ২৮ বছরে দাঁড়িয়েছে এক ঘর। কখনো প্রাইভেট সেন্টার, কখনো মক্তব ঘর। একসময়ে সেখানে চালু ছিল উপবৃত্তিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা কালক্রমে হারিয়েছে সব।
কী বলছেন প্রধান শিক্ষকরা
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রধান শিক্ষক জানান, আমরা প্রতিষ্ঠানে ৪৫ সেট বই পেয়েছি। ১২৫ সেট বই আমাকে দেয়নি। যদিও আমার প্রতিষ্ঠানের নামে ১২৫ সেট বই লেখা রয়েছে সেটা মাধ্যমিক স্যার ভালো জানবেন বাকি বই কোথায় আছে। প্রতিষ্ঠান প্রতি ৫০০ টাকা নিয়েছে তিনি। আমি নিজেই দুই ইউনিয়নের টাকা তুলে আবু জাফরের হাতে দিয়েছি। তিনি মাধ্যমিক স্যারের কাছে দিয়েছে।
নাম প্রকাশে আরেকজন প্রধান শিক্ষক জানান, প্রতি ক্লাসে ১৫ সেট বই পেয়েছি। আমার কাছে ৫০০ টাকা চেয়েছিল ১৫০ টাকা দিয়েছি।
একাধিক প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নতুন বছরে শিক্ষার্থীদের বই দেওয়ার জন্য ৫০০-৩০০ টাকা হারে নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়ন ভাগ করে লোক নিয়োজিত করা হয়েছে। টাকাগুলো প্রথম ধাপে উপজেলা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের কাছে জমা হয়েছে পড়ে উপজেলা মাধ্যমিক কর্মকর্তা আব্দুল হালিমের কাছে জমা হয়েছে।
তাহলে বিদ্যালয় গোয়ালঘর কেন
প্রতিষ্ঠাতা তাদের নিজের লোকজন নিয়োগের মাধ্যমে গড়ে তুলেন প্রতিষ্ঠান। সেখানে প্রতি শিক্ষকের কাছে করেছে নিয়োগ বাণিজ্য। দেখানো হতো হাজারো স্বপ্ন। রাত পোহালেই মিলবে জাতীয়করণ। কিন্তু বাস্তবে কখনও স্বপ্নপূরণ হয়নি। নিয়োগকৃত শিক্ষকরা একদিকে টাকা দিয়ে বন্দি, অন্যদিকে বেতন ছাড়া পাঠদান। তাদের অনেকেই এখন বিভিন্ন পেশায় সরকারি চাকরি করছেন। বিদ্যালয়ে কখনো আসেনি, কমিটির লোকজন বই নিয়ে আসলেও তা বিক্রি হয়েছে হকারের কাছে। দীর্ঘদিন বিদ্যালয় রুমগুলো পড়ে থাকায় কোথাও গরুর ঘর, কোথায় পূর্বের আবাদি জমি, কোথাও আবার বসতঘর।
তাহলে বিগত দিনের ফলাফল এলো কীভাবে
উপজেলার এসব প্রতিষ্ঠানের কয়েকটি ছাড়া নিজস্ব শিক্ষার্থী না থাকলেও রয়েছে শিক্ষা অফিসের প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ইবতেদায়ি মাদ্রাসার পরীক্ষার ফলাফল। প্রত্যেক ক্লাসে উত্তীর্ণের পরিসংখ্যান, রয়েছে সন্তষজনক ফলাফল। এমনকি পেয়েছে বৃত্তি ও সাধারণ বৃত্তি।
পাটক্ষেত যদি বিদ্যালয় তাহলে শিক্ষার্থী কোথায়
উপজেলা শিক্ষা অফিসের ফলাফলের তালিকা নিয়ে কয়েকটি এলাকায় গিয়ে জানা গেছে, সেই সময়ে কেউ ষষ্ঠ শ্রেণিতে, কেউ সপ্তম শ্রেণিতে আবার কেউ অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। বয়স ও উচ্চতা কম থাকায় বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক, ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা মিলে তাদের জোগাড় করতেন। সেই সুবাদে তারা পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী/বোর্ড পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতেন। এ নিয়েই চলত সেই প্রতিষ্ঠানের জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন।
শিক্ষা বিভাগ যা বলছে
ডিমলা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল হালিম কালবেলাকে বলেন, উপজেলায় আসলে কতগুলো স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান আছে তা জানা নেই। আর কতগুলো প্রতিষ্ঠানে বই বিলি দেওয়া হয়েছে সে বিষয়টা আমার জানা নেই। দুপুরে কী তরকারি দিয়ে ভাত খেলাম তাও স্মরণ নেই। আমার কোনো কিছুই স্মরণ থাকে না।
এক লাখ বই বিতরণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বই বিতরণের বিষয়গুলো আমার অ্যাকাউন্ট্যান্ট জানেন, আমি কিছুই জানি না।
পরিদর্শন ছাড়াই আপনি এতগুলো প্রতিষ্ঠানকে কেন বই দিলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পরিদর্শনের কোনো কারণ আসে না, আর পরিদর্শন করবই বা কেন।
প্রতিষ্ঠানেই গোয়ালঘর হিসেবে পড়ে আছে তবুও বই দিচ্ছেন কেন, জবাবে শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, গোয়ালঘরে বই দিচ্ছি না। প্রতিষ্ঠানপ্রতি ৫০০ টাকা নিচ্ছেন এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কেউ টাকার বিষয়টি বলতে পারবে না।
সূত্র: কালবেলা