বণিক বার্তা: অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন, পরিবেশবিরোধী কার্যক্রম ও বাণিজ্যের কারণে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপের পরিবেশ দ্রুত নষ্ট হচ্ছে। প্রাকৃতিকভাবে সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণার পরও এ দ্বীপে পর্যটকদের ভিড় থামছে না। এ কারণে সিটি ট্যাক্সের আদলে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ঘুরে বেড়ানোর জন্য ইসিএ ফি আরোপ করতে যাচ্ছে সরকার। তাছাড়া রাতযাপনের জন্য ইসিএ ফির কয়েক গুণ বেশি অর্থ গুনতে হবে পর্যটকদের।

বাংলাদেশের দ্বীপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পর্যটক সমাগম হয় সেন্ট মার্টিনে। এ দ্বীপের ভারসাম্য রক্ষায় সরকার বিভিন্ন সময়ে একাধিক পদক্ষেপ নিলেও শতভাগ প্রতিপালন করা সম্ভব হয়নি। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতায় প্রায় সব উদ্যোগই ভেস্তে যায়। নিয়ম না থাকলেও নামে-বেনামে স্থাপনা নির্মাণ, পরিবেশবিরোধী কার্যকলাপ, নৌযান পরিচালনার ক্ষেত্রে নিয়ম লঙ্ঘনের মাধ্যমে দ্বীপের পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে। এ কারণে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে স্থানীয় বাসিন্দা ও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত অবকাঠামো ছাড়া আর কোনো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন ছাড়া স্থাপনা নির্মাণ করতে পারবে না। সম্প্রতি এ সিদ্ধান্ত নেয়ার পর সেন্ট মার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।

জানা গেছে, পর্যটকদের ভিড় সামলাতে না পারায় দ্রুত সময়ের মধ্যে সেন্ট মার্টিনে যেতে ইসিএ ফি আরোপের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ভ্রমণে যেতে যাত্রীপ্রতি ১ হাজার টাকা ফি আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে রাতযাপনের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ২ হাজার টাকা দিতে হবে পর্যটকদের। মূলত নিউইয়র্ক শহরে প্রচলিত সিটি ট্যাক্সের আদলে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ইসিএ ফি হিসেবে দ্বীপ ঘুরে দেখার জন্য ল্যান্ডিং ফি পদ্ধতি প্রয়োগের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে।

সেন্ট মার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গঠিত ফাংশনাল কমিটির দ্বিতীয় বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারি এসব সিদ্ধান্ত নেয় কমিটি। এর আগে ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা এবং টেকসই পর্যটন উন্নয়নে প্রণীত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নসংক্রান্ত একটি সভায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও সংস্থার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এ কমিটি গঠন করা হয়। একই মাসের ২০ তারিখে কমিটির প্রথম বৈঠকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সুরক্ষায় বেশকিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ওই সভায় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন ব্যতীত দ্বীপটিতে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। পাশাপাশি পর্যটন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অংশীজনদের সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়।

সংশ্লিষ্ট নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সেন্টমার্টিন দ্বীপ রক্ষায় অবকাঠামো নির্মাণে সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থান নেয়ার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এছাড়া জমি ব্যবহার নীতিমালা, জেটি ব্যবস্থাপনা, পর্যটন পরিবহন ছাড়াও দ্বীপের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় ১২টি বৃহৎ পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে পর্যটন পরিবহনের ক্ষেত্রে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত পর্যটক নিরুৎসাহিত করতেই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা) মুহাম্মদ সোলায়মান হায়দার বণিক বার্তাকে বলেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপ রক্ষা ও পর্যটন সীমিত করার বিষয়ে একগুচ্ছ পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। স্থাপনা নির্মাণসহ বিভিন্ন বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়ে নীতিগতভাবে ঐকমত্যে পৌঁছেছে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা। আরো বেশ কয়েকটি বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে। প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন করলেই দ্বীপটি রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার কার্যক্রম হাতে নেয়া হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ফি আদায়ের বিষয়টি চারটি পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। প্রথম পরিকল্পনায় পর্যটক পরিবহনে অনুমোদিত জাহাজ কর্তৃপক্ষ নির্ধারিতসংখ্যক যাত্রীর দ্বীপে অবতরণ ফি ও রাতযাপন ফি নির্ধারিত ব্যাংকে জমা রাখবে এবং জেলা প্রশাসক সরকার নির্ধারিত উপায়ে অর্থ সংরক্ষণ করবে ও সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান করবে।

দ্বিতীয় পরিকল্পনা হচ্ছে, স্থানীয় প্রতিনিধি অর্থাৎ জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, এনজিও, পুলিশ সুপার, বিআইডব্লিওটিএর প্রতিনিধির মাধ্যমে কমিটি গঠন করা হবে।

তৃতীয় পদ্ধতিটি হচ্ছে, জাহাজ কর্তৃপক্ষ তাদের ভাড়ার সঙ্গে অবতরণ ও রাতযাপন ফি আদায় করে সরকারি হিসাবে জমা দিয়ে অবতরণ কেন্দ্রে অবহিত করবে। ব্যবস্থাপনা কমিটি টিকিটের একাংশ সংগ্রহ করে জেলা প্রশাসক বরাবরে প্রেরণ করবে। জেলা প্রশাসক দৈনিক ব্যাংক হিসাব বিবরণীর সঙ্গে রসিদ যাচাই করে প্রত্যয়ন করবেন। পর্যটকদের কাছ থেকে ফি আদায়ের চতুর্থ পরিকল্পনা পদ্ধতিটি হচ্ছে জাহাজ কর্তৃপক্ষ অ্যাপসের মাধ্যমে অবতরণ ও রাতযাপন ফি আদায় করে সরকারি কোষাগারে নির্দিষ্ট হিসাবে জমা দেয়া। অবতরণ ব্যবস্থাপনা কমিটি টিকিটের একাংশ সংগ্রহ করে ব্যাংক হিসাবের সঙ্গে মিলিয়ে নেবে। এক্ষেত্রে হোটেল-মোটেল কিংবা রেস্টহাউজ কর্তৃপক্ষ চেক ইন করার সময় রাতযাপন টিকিট রয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করবে। ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়মিত হোটেলের রেজিস্টার পরীক্ষা করবেন।

এদিকে সেন্টমার্টিনের সুরক্ষা ও পর্যটক নিয়ন্ত্রণের উচ্চপর্যায়ের তৃতীয় বৈঠক আজ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ওই বৈঠকে সরকারের ২৭টি সংস্থার উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা অংশ নেবেন।

নাম প্রকাশ না করে সংশ্লিষ্ট একটি সংস্থার প্রতিনিধি বণিক বার্তাকে বলেন, শিগগিরই এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকার মাঠে নামবে।