মোঃ জয়নাল আবেদীন টুক্কু:
কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার ১০ উপজেলায় প্রায় ৬৫ হাজার একর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। এ তামাক প্রক্রিয়াজাত করার জন্য নির্মিত হয়েছে ৩০ হাজার তামাক চুল্লি। চট্রগ্রাম বন সার্কেলের লামা, বান্দরবান, পাল্পউড ডিভিশন, চট্রগ্রাম দক্ষিণ ও কক্সবাজার উত্তর ও দক্ষিণ বন বিভাগের সংরক্ষিত ও অশ্রেণী ভুক্ত বনাঞ্চল থেকে বিভিন্ন প্রজাতির কচি কচি বৃক্ষরাজি কেটে লাখ লাখ মন জ্বালানী কাঠ পুড়ানো হচ্ছে। এসব পরিবেশ বিধ্বংসী কাজে অনৈতিক সহযোগিতা করে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট বন বিভাগের দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারীরা।
প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত জ্বালানী কাঠ ভর্তি পি-কাপ, ট্রাক ও মিনি ট্রাক বন বিভাগের ডেকি কল বিনা বাধায় পেরিয়ে পুলিশের সামনে দিয়ে তামাক চুল্লিতে পাচার হলেও তা দেখার কেউ নেই। এ অভিযোগ স্ব স্ব এলাকার পরিবেশবাদী সচেতন মহলের। অপরদিকে অভিযোগ উঠেছে যেসব জমিতে রবি শষ্য ও ধান চাষের জন্য সরকার কর্তৃক ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে কিছু কৃষক ভর্তুকির সার ব্যবহার করছে তামাক চাষে।

তামাক চাষে সার পাচারে জড়িত বিসিআইসির ইউনিয়ন ও সার ডিলাররা জড়িত থাকলেও কৃষি বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট উপজেলার দায়িতপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তারা সার পাচারকারী ডিলারদের বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে রবি শষ্য ও ধান চাষে জড়িত কৃষকদের অভিযোগ। বর্তমান তামাক
চাষের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে পার্বত্য বান্দরবান জেলা সদর, লামা, আলীকদম, থানচি, নাইক্ষ্যংছড়ি, রুমা,রুয়াংছড়ি এবং
কক্সবাজার জেলা সদর, রামু,চকরিয়া,পেকুয়া ও উখিয়া উপজেলা। ২ জেলার ১০ উপজেলায় প্রায় লক্ষাধিক তামাক চাষিকে আগাম দাদন দিয়ে পরিবেশ বিধ্বংসী তামাক চাষে উৎসাহ যোগাচ্ছে বৃট্রিশ আমেরিকান ট্যোবাকো, ঢাকা ট্যোবাকো ও আবুল খাইর ট্যোবাকোসহ আরোও বেশ কয়েকটি তামাক কোম্পানী।
১৯৮৮ সাল থেকে প্রায় ৩০বছর যাবৎ পরিবেশ বিধ্বংসী এ তামাক চাষ হয়ে আসছে এসব এলাকায়। রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া-গর্জনিয়া ও কাউয়ারখোপ এবং নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দোছড়ি, বাইশারী ও সোনাইছড়িসহ বিভিন্ন ইউনিয়ন সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায়, সবকয়টি তামাক কোম্পানির সহায়তায় ৯ হাজার ৩ শত হেক্টর জমিতে তামাক চাষ করছে। এছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগে আরো প্রায় ২ হাজার একর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য মতে নাইক্ষ্যংছড়িতে আবাদি জমির পরিমাণ ১১২৩৭ হেক্টর। তামাক চাষ হয়েছে ১ হাজার ৫৭ হেক্টর জমিতে।
লামা উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য মতে লামা উপজেলায় আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ১১ হাজার ৫শত হেক্টর। ২০১১ইং সালে উপজেলা চাষী স্বার্থরক্ষা কমিটির তামাক চাষ বন্ধ ও ন্যায্য দাম পাওয়ার বিষয়ে বান্দরবান জর্জ কোর্টে তামাক চাষের বৈধতা নিয়ে রিট করলে আদালত তামাক চাষ নিয়ন্ত্রনে রাখতে সর্বমোট ১ হাজার হেক্টর চাষের অনুমতি দেয়। কিন্তু বাস্তবতা এর বিপরীত। সমগ্র জেলা ঘুরে দেখা যায় এক ফসলি, দুই ফসলি ও তিন ফসলি জমি সহ সরকারী রিজার্ভ, নদীর দু’পার তামাক চাষের দখলে চলে গেছে।
বেপরোয়া তামাক চাষের ফলে আর্থিক সচ্ছলতা দিলেও পরিবেশ ও সমাজের নানা ক্ষতি, সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যহানি গড়ছে নিরবে। আরো জানা যায়, বর্তমানে লামা উপজেলায় ৫ হাজার ৫ শত জন চাষী তামাক চাষে জড়িত।
লামা পৌরসভার কৃষক, নীলকান্ত বড়ূয়া, মংবাচিং মার্মা সহ একাধিক কৃষকের সাথে কথা বলে জানা যায়, কৃষি পণ্য চাষ করে তেমন কোন সহায়তা পাওয়া যায় না। তাই আমরা আগে ধান ও শস্য চাষ করলেও বর্তমানে তামাক চাষ করছি। তামাক কোম্পানীর ফিল্ড অফিসাররা চাষাবাদে হাতে কলমে আমাদের শিক্ষা দেয় এবং নানাবিধ সহায়তা করে। সে তুলনায় কৃষি বিভাগের সহায়তা অপ্রতুল। কৃষক আবুল মনছুর,হামিদসহ অনেকে জানান
উপজেলা কৃষি অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাজে অবহেলা, দায়িত্ব পালনে অনিহা, কৃষকের সাথে দূরত্ব, সরকারের কৃষি উন্নয়নে গৃহীত নানান প্রকল্প কৃষককে অবহিত না করা, সার ডিলারদের সাথে সখ্যতা তৈরি করে সার পাচার বাণিজ্য, কৃষি উপকরণ বিতরণে পক্ষপাতিত্ব, কৃষকদের সাথে নিয়মিত কৃষি সমাবেশ না করা, বীজ বিতরণে অনিয়ম, পণ্য বিপননে অসহযোগিতা সহ ব্যাপক দুর্নীতির কারণে সিংহভাগ আবাদি জমি আজ তামাকের দখলে চলে গেছে বলে জানায় তারা। কৃষকরা অভিযোগ করে বলেন, আমরা ধান ও শস্য চাষে সার চাইলে পাইনা। কিন্তু তামাক চাষীদের প্রয়োজন মত সার দেয়া হয়। সরকারের ভর্তুকির সার তামাকে ব্যবহার করছে। এই বিষয়ে অসাধু সার ব্যবসায়ী ও কৃষি অফিসের দায়িত্বরত কর্মচারীরা জড়িত।
তামাকের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির বিষয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পঃ পঃ কর্মকর্তা ডাঃ এ জেড এম সেলিম উদ্দিন বলেন, তামাক গ্রহণে মানুষের ক্যান্সার, হার্টের বিভিন্ন রোগ, স্ট্রোক, শ্বাসকষ্ট ও পায়ে পচন এবং ধুয়াবিহীন তামাক জর্দা ও সাদাপাতা ব্যবহারের ফলে খাদ্যনালীতে ক্যান্সারসহ নানা শারীরিক জটিলতায় আক্রান্ত হতে পারে। বাংলাদেশে প্রতি বছর তামাকের কারণে প্রায় এক লক্ষ লোক মৃত্যুবরণ করে। এছাড়া ৩ থেকে ৪ লক্ষ লোক তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের কারণে অসুখ ও অক্ষমতাজনিত কুফল ভোগ করে। মরণ চাষ তামাক নিয়ে বান্দরবান কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, যেভাবে তামাক চাষের আবাদ বাড়ছে তা যথারীতি অত্র জনপদের জন্য হুমকি স্বরুপ। ধান ও শস্য চাষে কৃষকদের ফিরিয়ে আনতে সরকার কর্তৃক স্বল্প সুদে কৃষি ঋণ, কৃষি উপকরণ সহজলভ্য সহ নানান পদক্ষেপ সরকার ইতিমধ্যে গ্রহণ করেছে। তামাক চুল্লিতে কাঠ পুড়ানো বিষয়ে নাইক্ষ্যংছড়ির নবাগত রেঞ্জ কর্মকর্তা মনজুরুল হাসান চৌধুরী জনান তিনি কয়দিন আগে যোগদান করেছেন এর পরেও তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান এ প্রতিবেদককে।