লুৎফা বকসী:
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস। একটা সময় আক্রান্ত হল বিশ্বের প্রায় ২২কোটি মানুষ। প্রাণ দিলেন অর্ধ কোটি মানুষ। ২০২০ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশে করোনার ভয়াবহতা লক্ষ্য করি। বাংলাদেশেও মারা যাচ্ছিল শতশত মানুষ। ভয়, আতঙ্ক, দুশ্চিন্তায় কাতর সাধারণ মানুষ। করোনার এই ভয়াবহতা আমাদের করেছে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন, অর্থনৈতিকভাবে অনিশ্চিত, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। করোনা ভাইরাস শারীরিকভাবে আমাদের যতটা না প্রভাবিত করেছে তার চেয়েও বেশি প্রভাবিত করেছে মানসিকভাবে। পৃথিবীর এমন কোনো প্রান্ত নেই যেখানে করোনা ভাইরাস তার ছোবল মারেনি।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। নানা সংকটের মধ্যেও উখিয়ার আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক সেবার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলাম। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘ পালস বাংলাদেশ’ এর একজন কর্মী হিসাবে। এরধ্যে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লাম। সবার মনে আতঙ্ক-করোনায় আক্রান্ত হলাম কিনা। শহরের লিংকরোডের বাড়িতে চিকিৎসা চলছিল। এক দিন দুইদিন এভাবে সপ্তাহ পার। লক্ষণ ভালো দেখা যাচ্ছিল না। আমার অবস্থা দেখে উদ্বিগ্ন স্বামী সাংবাদিক নজরুল ইসলাম বকসী। ছেলে সিদরাতুল মুরসালিন ভাষা ও মেয়ে সিদরাতুল মুনতাহা বর্ণ টেনশনে। আত্মীয় স্বজনেরা চিন্তায় পড়ে গেলেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য আমাকে নেওয়া হলো ঢাকায়। স্কয়ার ও অ্যাপলো হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু সুফল মিলছিল না। এরই মধ্যে কেটে গেল বেশকিছু সময়।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে রোগের বিস্তার বেড়ে গেল।
একদিকে দেশব্যাপী লকডাউন-করোনা ভাইরাসের তীব্র থাবা, অন্যদিকে শাররীক অবস্থার অবনতি-দিশা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মার্চের দিকে লকডাউন কিছুটা শিথিল হল। উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। তখন পুরো ভারতজুড়ে চলছিল করোনার ভয়াবহ থাবা। হাসপাতালে রোগীর ঠাঁই (চিকিৎসার জায়গা) হচ্ছিলনা। এতো মানুষের মৃত্যু হচ্ছিল যে-লাশের দাফন ও সৎকারের ব্যবস্থাও হচ্ছিল না। এমন পরিস্থিতি অর্থাৎ ২০২১ সালের ১৬ মার্চ আমরা সপরিবারে চলে গেলাম ভারতের চেন্নাইয়ে ভেলুর শহরের সিএমসি হাসপাতালে। আমার সঙ্গে বকসী ও দুই ছেলেমেয়ে। পরীক্ষার নিরীক্ষার পর জানা গেল আমি ‘ লিম্ফোমা’ নামক ক্যান্সারে আক্রান্ত। চিকিৎসকেরা বললেন, ছয় ক্যামো সার্কেল এবং ২৫ রেডিও থেরাপি দিতে হবে, টাকাও লাগবে প্রচুর। বিদেশের মাটিতে করোনা-লকডাউন পরিস্থিতিতে হঠাৎ করে এতো টাকা কোত্থেকে পাবো-এনিয়ে নানা চিন্তা মাথায় ভর করে । মায়ের অবস্থা দেখে কান্নাকাটি করছিল দুই সন্তান ভাষা ও বর্ণ। বকসী ভুগছিলেন অস্থিরতায়।
আমাকে ভর্তি করা হল সিএসমি হাসপাতালের ক্যান্সার ইউনিটে।
হাসপাতালে আমার চিকিৎসার খোঁজখবর, চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ, সন্তানদের নিরাপত্তা-খাবার দাবারের ব্যবস্থাসহ নানা ব্যস্থতায় বকসীর কেটে গেল ৯ দিন। হঠাৎ প্রচন্ড জ্বরে আক্রান্ত হলেন বকসী। আমি হুইল চেয়ারের রোগী হওয়ায় বকসীর তেমন খোঁজখবর নিতে পারছিলাম না। ছেলেমেয়েরা অসুস্থ বাবা-মাকে নিয়ে অস্থির। হাসপাতালের বাইরে লাশের সারি। তখন করোনার দ্বিতীয় থাবা চলছিল পুরো ভারতবর্ষজুড়ে। চিকিৎসকের পরামর্শে বকসীর করোনা টেস্ট করা হলো। রিপোর্ট এলো করোনা পজেটিভ। বকসীকে ভর্তি করা হলো আমার ইউনিটের পাশে আরেকটি ভবনের করোনা ইউনিটে। বকসী হয়ে গেলেন করোনা রোগী। ক্যান্সার আক্রান্ত স্ত্রীর সেবা করতে গিয়ে নিজেই হয়ে গেলেন করোনা রোগী। কয়েক দিনের মাথায় বকসীর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটছিল। চিকিৎসকেরা বকসীকে নিয়ে গেলেন রেডজোন ইউনিটে। সেখান থেকে হায়ার ভ্যান্টলেশন তারপর আইসিইউতে। বকসীর অবস্থা সংকটাপন্ন। এরপরের কাহিনী সবার জানা।
নজরুল ইসলাম বকসী আইসিইউর বেডে শুয়ে অনলাইন ( ভিডিও কল ও জুমে) মাধ্যমে আমার অবস্থা, নিজের অবস্থা তুলে ধরছিলেন তাঁর সহকর্মী সাংবাদিক বন্ধু, আত্মীয় স্বজন ও ঘনিষ্টজনের কাছে। চেয়েছিলেন মানবিক সহায়তাও। সেদিন বকসীর আহবানে সাড়া দিয়েছিলেন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। তবে কক্সবাজার প্রেসক্লাবের বেশ কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক ( নাম উল্লেখ করে তাঁদের ছোট করলাম না) চিকিৎসার মোটা দাগের টাকা সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন। এই সহায়তা না পেলে আমাকেও প্রাণে বাঁচানো সম্ভব হতোনা। সাংবাদিকদের এই সহায়তা চির জীবন মনে রাখবো, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ আমরা।
হাসপাতালের আইসিইউতে বকসীর চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। ১৯দিন করোনার সাথে যুদ্ধ করে ১৮ এপ্রিল-২০২১ তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্নাইলাইহী রাজিউন)।
তখনও আমি মৃত্যু শয্যায়। ছেলেমেয়েরা তাদের বাবার মৃত্যুর সংবাদটাও আমাকে ঠিকসময়ে জানাতে চাইছিল না। মৃত্যুর খবর শুনে আমার অবস্থা যদি আরও খারাপ হয়ে যায়-সেই আশঙ্কায়। বকশির মরদেহ দেশে আনার চেষ্টা হয়েছিল অনেক। কিন্তু করোনা বিধিনিষেধ-লডডাউন পরিস্থিতির কারণে মরদেহ কক্সবাজার আনা সম্ভব হয়নি। বকশীর মরদেহ দাফন করা হয় চেন্নাইয়ের ভেলুলের গান্ধিরোডস্থ জামেয়া মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে। বকসীর মৃত্যুর পর আরও ৮ মাস আমি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলাম। দুই ছেলেমেয়ে সার্বক্ষণিক পাশে থাকলেও মনে হত পৃথিবীটা অন্ধকার। যে মানুষটার সঙ্গে ৩০ বছরের পথচলা, সেই মানুষটা পাশে নেই ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল। চিকিৎসা প্রায় শেষ পযায়ে। বাড়ি ফিরতে হবে। কিন্তু মন চাইছিল না, বকসীকে বিদেশের মাটিতে রেখে দেশে ফিরতে। কিন্তু উপায় নেই। আমাদের পেছনে সময় দিতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পড়ুয়া দুই ছেলেমেয়ের জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছিল, পড়াশোনাও বন্ধ বললে চলে। অবশেষ বকসীকে রেখে আমরা কক্সবাজার ফিরলাম ২০২১ সালের নভেম্বরে।
এখন লিংকরোডের বাড়িতে বড্ড একা আমি। ছেলেমেয়েরাও ঢাকা-চট্টগ্রামে, পড়াশোনায় ব্যস্ত। ঘরের বারান্দা-কক্ষে, দেয়ালে টাঙানো নানা ভঙিমায় তোলা বকসীর একাধিক ছবি। এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে বকসীর সাংবাদিকতা জীবনের সাফল্যে অর্জন নানা স্বীকৃতি সনদ, ক্রেস্ট ইত্যাদি। এসবে মন টানেনা, আমার মন পড়ে আছে সেই গান্ধিসড়কের জামে মসজিদ কবরস্থানে, যেখানে বকসী শুয়ে আছেন।
আজ ১৮ এপ্রিল নজরুল ইসলাম বকসীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। বিশ্বাসই হচ্ছেনা মানুষটা আমাদের সঙ্গে নেই। ৩০ বছরের সংসার জীবনে যে মানুষটি ছায়ার মত লেগে থাকতেন, তিনি আজ নেই…। আল্লাহ বকসীকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন, আমিন।
নজরুল ইসলাম বকসীর সাথে আমার পরিচয় ১৯৯২ সালে। প্রথমে আলাপচারিতা, তারপর ঘনিষ্টতা । ১৯৯৫ সালে ২৭ এপ্রিল আমরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হই। সে থেকে দুজনের পথচলা।
টানা ৩০ বছরের সংসার জীবনে বকসীকে এক মুহূর্তের জন্যও দেখিনি, নিজের ব্যক্তিত্ব, স্বকীয়তা বিকিয়ে দিতে।
নিজের স্বীয় বৈশিষ্ট্য ধরে রাখার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন বকসী। ঠান্ডা মাথায় সামাল দিতেন সবকিছু।
বকসী ছিলেন অত্যন্ত উদার,বন্ধু সুলভ, নির্লোভ ও হাস্যোজ্জল মানুষ। শত দুঃখ-কষ্টের মাঝেও তিনি কিছুই হয়নি-এমন ভাব নিয়ে চলতেন। বকসী ছিলেন খুব সদালাপী, সাবলীল, সাদামাটা ও নিরহংকারী একজন মানুষ। উচ্ছাভিলাসী জীবন যাপন এবং মনোভাব পোষণে তাঁর অনিহা ছিল প্রবল।
নজরুল ইসলাম বকসী একজন স্বামী, একজন বাবা, একজন বন্ধু হিসাবে খুবই মার্জিত ব্যবহার করতেন। তিনি নারীবান্ধক মানুষ ছিলেন। নারীর প্রতি বৈষম্য ছিলনা, দৃষ্টিভঙ্গি ছিল উদার-মানবিক। স্ত্রী হিসাবে আমিও যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করতে পেরেছি।
পরিচয় হওয়ার পর থেকে আমার পড়ালেখা ও চাকরির বিষয়ে সবসময় উৎসাহ দিতেন, প্রেরণা যোগাতেন তিনি।
সংসারের বাহ্যিক চাকচিক্যের বিষয়ে বকসী সবসময় উদাসীন ছিলেন। তিনি ব্যস্থ থাকতেন লেখা লেখির কাজে, সাংবাদিকতা নিয়ে। তিনি দীর্ঘদিন চট্টগ্রামের দৈনিক পূর্বকোণ, ঢাকার ভোরের কাগজ, কক্সবাজারের কয়েকটি দৈনিক এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কাজ করেছেন। দায়িত্বশীল একজন সাংবাদিক হিসাবে বকসী নিজের জন্মভুমি সিলেট ও কক্সবাজারে সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পেরেছিলেন।
সাংস্কৃতিক অংগনেও ছিল বকসীর সরব অবস্থান।
সংসারে ছেলেসন্তান ভাষার জন্ম হলো। বাবা হিসাবে বকসীর অন্য রূপ দেখলাম। সন্তানের প্রতি বাবার দায়িত্ব ও কর্তব্য কতটুকু-তা শিখিয়ে গেছেন বকসী।
সংসারে এলো মেয়ে সন্তান বর্ণ। বকসীর স্বভাব পাল্টে গেল। ছেলের চাইতে মেয়েকে বেশী ভালবাসতে শুরু করলেন। নিজের সুখ দুঃখের কথা, জীবনের পাওয়া না পাওয়া কথা, ভবিষ্যতের সবকিছু অকপটে বলতেন মেয়েকে।
সন্তানদের পড়াশোনা, পারিবারিক শিক্ষা,ইসলামি শিক্ষা, সাংস্কৃতি শিক্ষা দিতে অবিচল ছিলেন বকসী। শিশু কাল থেকে ভার্সিটির বয়স পর্যন্ত দু সন্তানকে শক্ত হাতে নাটাইয়ের মত ধরে রেখেছেন তিনি। শাসন, বারণ, আদর সোহাগের কোনটা কমতি ছিলনা।
আমার বাড়ির আত্মীয় স্বজন, শালা শালীর প্রিয়জন ছিলেন বকসী। কৌতুক, ছড়া কবিতা, রম্যগল্পে মাতিয়ে রাখতেন সবাইকে। মুরব্বি ছাড়াও বয়সে ছোট স্বজনদের তিনি কদমবুচি করে সম্মান জানাতেন।
একটা সময় আমরা কক্সবাজার থেকে সিলেট শিফট হই। বকসীর মা ও ভাইয়েরা চেয়েছিলেন আমরা সিলেটে সবাবাস করি। সিলেটে গিয়ে নতুন জীবন গড়ার যুদ্ধে সামিল হই আমরা।
২০০১ সালে বকসী হার্ট অ্যাটার্কের শিকার হন। তখন থেকে জটিল অসুস্থতায় ভুগছিলেন তিনি । কিন্তু কাউকে তা বুঝতে দিতেন না। জীবনকে জীবনের গতিতে চালিয়ে গেছেন শেষ দিন পর্যন্ত। আমি কান্ডারী হিসাবে তাঁর পাশে ছিলাম সবসময়।
সন্তানদের ফেলে রেখে অসুস্থ বকসীকে নিয়ে এক দৌঁড়ে চলে যেতাম ঢাকা হার্টফাউন্ডেশন। কখনো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, কখনো ইন্ডিয়ার ভেলুর অথবা ব্যাংগালোর হাসপাতালে। কঠিন হতাশার মধ্যেও মনোবল হারাতেন না তিনি। সীমাহীন মনের জোর ছিল বলে ২০১০ সালে একবার এবং ২০১৫ সালে দ্বিতীয় বার বকসীকে ওপেন হার্ট সার্জারি (অপারেশন) করানো সম্ভব হয়েছিল।
একটা সময় আমরা সিলেট থেকে আবার ফিরে এলাম কক্সবাজারে। বাকী জীবন আমরা কক্সবাজারেই কাটাবো-এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বকসী। কিন্তু তাঁকে আর ধরে রাখা গেল না।
বকসী ছিলেন দায়িত্বের প্রতি অবিচল এবং অদম্য একজন মানুষ । তিনি বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে, স্মৃতির মানসপটে। তিনি বেঁচে থাকবেন চলার পথে সাক্ষাত হওয়া অজস্র বন্ধুদের মাঝে,পত্রিকার কলামে,কবিতার চরনে, গল্প-উপন্যাসে। কক্সবাজার ও সিলেট তথা দেশবিদেশের অগনিত মানুষের হৃদয়কুন্জে।
লুৎফা বকসী
মরহুম সাংবাদিক নজরুল ইসলাম বকসীর সহধর্মিণী।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।