মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

কক্সবাজার জেলার গ্রাম আদালত গুলোকে আরো সক্রিয় করতে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। যারা ইউনিয়ন পরিষদের সম্প্রতি নতুন চেয়ারম্যান ও মেম্বার নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের গ্রাম আদালত পরিচালনা সম্পর্কে যথাযথ ধারণা দিতে আগামী ২১ মে সম্মেলন ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। গ্রাম আদালত গুলো আরো সক্রিয় করে গ্রাম আদালতের বিচারকেরা (ইউপি চেয়ারম্যান) সেখানে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে এখতিয়ারের মধ্যে বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করলে জেলার বিচার বিভাগে কিছুটা হলেও মামলার জট কমবে। তৃনমুল পর্যায়ে নাগরিকেরা তার সুফল পাবে।

বুধবার ২৮ এপ্রিল জাতীয় আইনগত সহয়তা দিবস-২০২২ (লিগ্যাল এইড দিবস) উপলক্ষে কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান ও কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল দিবসের এক আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে একথা বলেন।

জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার ও সিনিয়র সহকারী জজ সাজ্জাতুন নেছা লিপি’র নান্দনিক সঞ্চালনায় কক্সবাজার জেলা জজ আদালত ভবনের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় অন্যান্যের মধ্যে সংসদ সদস্য কানিজ ফাতেমা আহমেদ, চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আলমগীর মোহাম্মদ ফারুকী, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক এডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা, কক্সবাজার জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শ্রাবস্তী রায়, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ আবু সুফিয়ান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট ইকবালুর রশিদ আমিন সোহেল, UNHCR এর কর্মকর্তা ইলিয়াস নাগোগি, লিগ্যাল এইড কমিটির প্যানেল আইনজীবী এডভোকেট মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী বক্তব্য রাখেন।

লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইসমাইল আরো বলেন, গ্রাম আদালতের বিচারিক এখতিয়ার ৭৫ হাজার টাকা থেকে আরো বাড়ানোর জন্য উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করা হয়েছে। যাতে গ্রাম আদালতে আরো বেশি মামলা নিষ্পত্তি করা যায়।

সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, আইনজীবীরা আসামীর জামিন নেওয়ার সময় আদালতে খুবই তৎপর ও সক্রিয় থাকেন। কিন্তু মামলার চুড়ান্ত বিচারিক কার্যক্রম অর্থাৎ মামলা ট্রায়ালের সময় সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের আর আদালতে পাওয়া যায়না। এতে আসামী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ন্যায় বিচার ব্যহত ও বিলম্বিত হয়। আইনজীবীদের এ অভ্যাস খুবই পীড়াদায়ক। মামলায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আসামীর নিয়োজিত আইনজীবীদের সংশ্লিষ্ট মামলার বিষয়ে সক্রিয় ও সচেতন থাকার জন্য আইনজীবীদের প্রতি তিনি আহবান জানান।

সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল আরো বলেন, কক্সবাজার অঞ্চলে, বিশেষ করে মহেশখালী এলাকার মামলায় অহেতুক বেশী আসামী করার একটা নেতিবাচক প্রবণতা রয়েছে। এই প্রবণতা সুশাসনের পরিপন্থী, ন্যায় বিচার বিলম্বিত করে, নাগরিক অধিকারের অন্তরায়। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। প্রকৃত অপরাধীদের মামলায় অন্তর্ভুক্ত করে, মামলায় অহেতুক আসামীর সংখ্যা না বাড়িয়ে, নির্দোষ ও নিরীহ ব্যক্তিদের মামলায় না জড়িয়ে, মামলার বিচার কার্যক্রম সুষ্ঠু ও দ্রুততম সময়ে নিষ্পত্তিতে তিনি সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেন।

তিনি বলেন, ২০২০ সালে কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড অফিস দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক ৭৩৬ টি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) করে রেকর্ড সৃষ্টি করা হয়েছিল। তিনি আরো বলেন, কোভিড-১৯ পরিস্থিতিজনিত কারণে লিগ্যাল এইড কার্যক্রম একটু ব্যহত হলেও কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড এর কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করে কক্সবাজারকে দেশের মধ্যে একটি মডেল জেলা হিসাবে গড়ে তোলা হবে। তিনি বলেন, প্রত্যেক আদালতে ন্যুনতম ২ জন করে লিগ্যাল এইড এর আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হবে।

জেলা লিগ্যাল কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইসমাইল আরো বলেন, লিগ্যাল এইড এর পরিধি বাড়িয়ে এর কার্যক্রম আরো বেগবান করতে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার এর পদ সিনিয়র সহকারী জজ থেকে যুগ্ম জেলা জজ পদে উন্নীত করার জন্য উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাব করা হয়েছে। যা সরকার গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে।

সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন,
আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায়-সম্বলহীন এবং নানাবিধ আর্থসামাজিক কারণে বিচার প্রাপ্তিতে অসমর্থ বিচারপ্রার্থী জনগণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন-২০০০’ প্রণয়ন করেন। কিন্তু ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর এ আইনের বাস্তবায়ন কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে যায়। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুনরায় সরকার গঠন করলে আইনগত সহায়তা প্রদান কার্যক্রম সক্রিয়করণের জন্য ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।

তৃণমূল পর্যায়ে সরকারের জনকল্যাণমূলক আইনি সেবার বার্তা পৌঁছে দেওয়া ও সরকারি আইনি সেবার বিষয়ে অধিকতর জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০১৩ সালের মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৮ এপ্রিলকে জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয় এবং তখন থেকে প্রতিবছর দেশব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্যদিয়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস পালন করা হচ্ছে।

“বিনা খরচে আইনি সহায়তা, শেখ হাসিনা সরকার দিচ্ছে এই নিশ্চয়তা” এই প্রতিপাদ্য নিয়ে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় লিগ্যাল এইড এর উপকারভোগী তসলিমা আক্তার ও মোহাম্মদ মিলন তাদের অনুভূতি প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন। সভায় জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের প্রধান সহকারী হাসান ইমতিয়াজ এর ব্যবস্থাপনায় লিগ্যাল এইড বিষয়ক একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। সভার শুরুতে কোরআন তেলাওয়াত করেন-মহেশখালীর সহকারী জজ আবদুল মান্নান, ত্রিপিটক পাঠ করেন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শ্রীজ্ঞান তঞ্চঙ্গাঁ এবং গীতা পাঠ করেন এডভোকেট প্রতিভা দাশ।

সভায় প্যানেল আইনজীবী এডভোকেট মোহাম্মদ আবদুর রশিদ (পুরুষ ক্যাটাগরী) ও এডভোকেট ইয়াসমিন শওকত জাহান রোজীকে (নারী ক্যাটাগরী) বর্ষসেরা প্যানেল আইনজীবীর ক্রেস্ট প্রদান করেন সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল। কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের ২ জন ইন্টার্নি শিক্ষার্থী যথাক্রমে সোনিয়া জেসমিন মৌমিতা ও নেজাম উদ্দিনকে অনুষ্ঠানে ইন্টার্নিশীপের সনদ ও ক্রেস্ট প্রদান করা হয়।

দিবসটি পালন উপলক্ষে কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত দিনব্যাপী কর্মসূচীর মধ্যে বৃহস্পতিবার সকাল ৯ টায় জেলা জজ আদালত চত্বরে পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে বর্নাঢ্য র‍্যালী’র উদ্বোধন করেন কমিটির চেয়ারম্যান ও সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল। এরপর র‍্যালীটি কক্সবাজার শহরের গুরত্বপূর্ণ সড়ক সমুহ প্রদক্ষিণ করে।

র‍্যালী ও আলোচনা সভায় বিজ্ঞ বিচারকদের মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক মোঃ মশিউর রহমান খান, ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক মোহাম্মদ মোসলেহ্ উদ্দিন, ট্রাইব্যুনাল-৩ এর বিচারক মোহাম্মদ আবদুর রহিম, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আবদুল্লাহ আল মামুন, অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাজীব কুমার বিশ্বাস, যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ-১ মাহমুদুল হাসান, যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ-২ মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, সিনিয়র জুডিসিয়াল মাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আবুল মনসুর ছিদ্দিকী, সদরের সিনিয়র সহকারী জজ সুশান্ত প্রসাদ চাকমা, জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হামীমুন তানজীন, জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আখতার জাবেদ, জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আসাদ উদ্দিন মো: আসিফ, জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ এহসানুল ইসলাম, টেকনাফের সহকারী জজ মো: ওমর ফারুক, রামু’র সহকারী জজ মো: মাজেদ হোসাইন সহ জেলা জজশীপ ও ম্যাজিস্ট্রেসীতে কর্মরত বিচারকবৃন্দ, বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

এছাড়া, জিপি এডভোকেট মোহাম্মদ ইসহাক, পিপি এডভোকেট ফরিদুল আলম, কক্সবাজার প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট মোহাম্মদ তাওহীদুল আনোয়ার, স্পেশাল পিপি বৃন্দ, প্যানেল আইনজীবীগণ, আইনজীবী সমিতির বর্তমান ও সাবেক নেতৃবৃন্দ, অন্যান্য আইনজীবীগণ, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক সংস্থা, এনজিও-র উর্ধতন কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে, জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করতে আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ, কক্সবাজার বিচার বিভাগের বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, বিশিষ্টজন সহ সরকারি বেসরকারি দপ্তরের উর্ধতন কর্মকর্তাগণ সহ সংশ্লিষ্ট সকলে বিভিন্ন কর্মসূচীতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ায় সকলকে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার ও সিনিয়র সহকারী জজ সাজ্জাতুন নেছা লিপি জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির পক্ষে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। সরকারের জনকল্যাণমুলক এই লিগ্যাল এইড কার্যক্রম আরো সফল ও প্রসার ঘটাতে ভবিষ্যতে তিনি সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেছেন।