মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :
কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও কক্সবাজার প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এডভোকেট ছালামত উল্লাহ’র প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ সোমবার ৬ মে। ২০২১ সালের আজকের এদিনে বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ রাত ৮ টা ১০ মিনিটের দিকে চট্টগ্রাম শহরের পার্কভিউ হাসপাতালে হার্ট অ্যাট্যাক করে ইন্তেকাল করেন।
কক্সবাজারের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব, বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের অধিকারী এডভোকেট ছালামত উল্লাহ ১৯৩৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কক্সবাজার শহরের বাহারছরার সাবেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা মরহুম নজীর আহমদ ও রত্নগর্ভা জয়নাব বেগমের জ্যেষ্ঠ সন্তান।
মরহুমের সন্তান সোহেল সাইফুল্লাহ জাজি সিবিএন-কে জানান, এডভোকেট ছালামত উল্লাহ’র প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে শহরের বিভিন্ন এতিমখানায় খাবার বিতরণ, মসজিদে দোয়া মাহফিল, কবর জেয়ারত সহ দিনব্যাপী কর্মসূচী গ্রহন করা হয়েছে। একইভাবে জামায়াত ইসলামীর কক্সবাজার জেলার সাবেক আমীর এডভোকেট ছালামত উল্লাহ’র প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে সংগঠনটি বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করছে বলে সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে।
এড. ছালামত উল্লাহ’র সংক্ষিপ্ত জীবনী :
সফল মানুষ ছালামত উল্লাহ এডভোকেট ১৯৩৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার শহরের বাহারছড়ায় এক ঐতিহ্যবাহী বুনিয়াদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম নজীর আহমদ ও মাতা মরহুমা রত্নগর্ভা জয়নাব বেগমের জ্যেষ্ঠ সন্তান এডভোকেট ছালামত উল্লাহ। মরহুম নজীর আহমদ ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা। কক্সবাজার শহরের দক্ষিণ বাজারঘাটার তার নামে নামকরণকৃত ‘এডভোকেট ছালামত উল্লাহ সড়ক’ এ তিনি বসবাস করতেন।
তিনি ১৯৫৫ সালে কক্সবাজার সরকারি হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৫৭ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে আই.এ এবং ঢাকা সলিমুল্লাহ কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন কৃতিত্বের সাথে। তিনি ১৯৬৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.বি ডিগ্রি লাভ করেন রেকর্ড সংখ্যক মার্ক পেয়ে।
স্কুলজীবনে তিনি ফুটবল খেলা ও স্কাউটিং-এ বেশ সুনাম অর্জন করেন। ১৯৫৩ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় স্কাউটস জাম্বুরিতে কক্সবাজার সরকারি হাইস্কুল থেকে তিনি গ্রুপলিডার হিসেবে টিমের প্রতিনিধিত্ব করেন।
দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ী এড. ছালামত উল্লাহ ১৯৬৫ সালের ১৩ আগস্ট কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির একজন নবীন সদস্য হিসাবে যোগদান করেন। কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির ৯ শতাধিক সদস্যের মধ্যে মৃত্যুকালে তাঁর ক্রমিক নম্বর ছিলো ‘এক’। তিনবার কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচিত সভাপতি হিসাবে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এড. ছালামত উল্লাহ বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টেরও একজন তালিকাভূক্ত আইনজীবী ছিলেন।
বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন এড. ছালামত উল্লাহ দীর্ঘদিন যাবৎ সাংবাদিকতার সাথেও জড়িত ছিলেন। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস), এসোসিয়েট প্রেস অব পাকিস্তান (এপিপি), ইংরেজি দৈনিক ডেইলী অবজারভার, দৈনিক জনপদ প্রভৃতি পত্রিকার কক্সবাজার প্রতিনিধি হিসাবে তিনি কাজ করেছেন। কক্সবাজার জেলায় সাংবাদিকতার বিকাশে এবং কক্সবাজার প্রেসক্লাব গঠনে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি কক্সবাজার প্রেসক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তাঁর নেতৃত্বে কক্সবাজারে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির কক্সবাজার শাখা গঠিত হয়। তিনি দীর্ঘদিন তদানিন্তন বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন।
দৃঢ় নৈতিকতা সম্পন্ন এড. ছালামত উল্লাহ ছাত্রজীবন থেকে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া, ধর্মীয় ও বিভিন্ন কল্যানকর প্রতিষ্ঠানের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তৎকালীন কক্সবাজার মহকুমা মুসলিম ছাত্রলীগের জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন এড. ছালামত উল্লাহ। কক্সবাজার ইসলামী সমাজ কল্যাণ সংসদের সভাপতি ও বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার কক্সবাজার জেলার সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন সুদীর্ঘ সময়। তিনি দীর্ঘকাল যাবৎ কক্সবাজার জেলার স্কাউট কমিশনার এবং বাংলাদেশ স্কাউটস কক্সবাজার জেলার সহ-সভাপতি ছিলেন।
এছাড়া কক্সবাজার রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির ভাইস চেয়ারম্যান ও রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির আজীবন সদস্য ছিলেন এড. ছালামত উল্লাহ। তিনি তদানিন্তন কক্সবাজার মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। কক্সবাজার শহরের বড়বাজার জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি দায়িত্বে ছিলেন।
ছালামত উল্লাহ কক্সবাজার ইসলামিয়া বালিকা কামিল মাদ্রাসা, কক্সবাজার আইন কলেজ, কক্সবাজার মহিলা কলেজ, কক্সবাজার সিটি কলেজ, কক্সবাজার আলহেরা একাডেমী এবং কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজ সহ অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক অবদান রাখেন। তিনি দীর্ঘদিন কক্সবাজার আইন কলেজের অধ্যাপক এবং ভাইস প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন। সফল রাজনীতিবিদ এড. ছালামত উল্লাহ জামায়াতে ইসলামী কক্সবাজার জেলার আমীর-এর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জামায়াত ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। কক্সবাজারের বাংলা সাহিত্যের বিকাশে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। কক্সবাজারের নবীনদের লিখা হাতের লেখা প্রথম সাহিত্য পত্রিকা তাঁরই উদ্দ্যোগে প্রকাশিত হয়। তিনি তৎকালীন কলকাতার ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার ছোটদের বিভাগে লিখতেন নিয়মিত। তিনি ‘আমেরিকা ও আমেরিকার দিনগুলো’, ‘কোরআনের আলোকে সাংবাদিতা’ সহ আরো বেশ কিছু গ্রন্থের রচয়িতা।
১৯৯৬ সালে এড. ছালামত উল্লাহ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ভিজিটর্স প্রোগ্রামে (International Visitor Program) যোগদান করেন। উল্লেখ্য যে, এই প্রোগ্রামে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান (১৯৫২), মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদত (১৯৬১), পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খান (১৯৪৯), শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট রানা সিংহ প্রেমাদাসা (১৯৬৬) এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দীরা গান্ধী (১৯৬১) অংশ গ্রহণ করেন।
আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি, ক্যালিফোর্নিয়া, কলম্বিয়া, বার্লিংটন, ফ্রিপোর্ট, স্যানডিয়াগো, শিকাগোসহ বিভিন্ন শহর ও অঞ্চল সফর করেন। তিনি ১৯৯৯ সালে মক্কাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘রাবেতা আল-আলমে ইসলামী’ কতৃক আমন্ত্রিত হয়ে উক্ত সংস্থার অতিথি হিসেবে পবিত্র হজ্জ্ব পালন করেন এবং দেশে ফেরার সময় আরব আমীরাতের বাংলাদেশ সমিতি ও ইসলামিক সেন্টার-এর সদস্যদের আমন্ত্রণে আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবী, দুবাইসহ বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেন।
ক্ষণজন্মা এই পুরুষ মৃত্যুকালে এক কন্যা নাসরিন সুলতানা, তিন পুত্র যথাক্রমে আমেরিকা প্রবাসী কবি সাহেদ সা’দ উল্লাহ, রিয়াজ মোহাম্মদ শাকিল ও সোহেল সাইফুল্লাহ জাজি, স্ত্রী এবং অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে যান।
অত্যন্ত স্বজ্জন, ভদ্র, বিনয়ী, সহজসরল, পরোপকারী ও সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত এড. ছালামত উল্লাহ ইন্তেকালের পরদিন অর্থাৎ ২০২১ সালের ৭ জুন জোহরের নামাজের পর কক্সবাজার কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে এই বিস্ময়কর প্রতিভাসম্পন্ন মানুষটির বিশাল নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। নামাজে জানাজা শেষে কক্সবাজার শহরের বাহারছড়া জামে মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে এড. ছালামত উল্লাহ-কে তাঁর পিতা-মাতার কবরের পাশে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।