মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

৭ হাজার ৯৯০ পিচ ইয়াবা টেবলেট পাচারের দায়ে এক রোহিঙ্গাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছে। রায়ে একইসাথে আসামীকে ১ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড প্রদান, অর্থদন্ড অনাদায়ে আরো এক বছর বিনাশ্রম কারাদন্ড দিয়েছেন।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আবদুল্লাহ আল মামুন বৃহস্পতিবার ৯ জুন এ রায় ঘোষনা করেন।

মৃত্যুদন্ড দেওয়া রোহিঙ্গা ইয়াবাকারবারী উখিয়া উপজেলার কুতুপালং ক্যাম্প-২, ব্লক ডি’র মৃত আবদুল মোনাফ ও মৃত নামীয় খাতুনের পুত্র মোঃ আরীফ প্রকাশ মৌলভী আরীফ (২৮)।

মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ :
২০১৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর দুপুর আড়াইটার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের উখিয়ার টেলিভিশন উপকেন্দ্রের গেইটের সামনে র‍্যাব-৭, হোয়াইক্ষ্যং অস্থায়ী ক্যাম্প এর একটি টিম এক অভিযান চালায়। অভিযানে রোহিঙ্গা মোঃ আরীফ প্রকাশ মৌলভী আরীফ-কে আটক করা হয় এবং সাদেক উল্লাহ (৩২) নামক আর একজন ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। পরে ধৃত আসামীর হাতে থাকা টিফিন ক্যারিয়ার তল্লাশি করে ৭ হাজার ৯৯০ পিচ ইয়াবা টেবলেট উদ্ধার করা হয়।

এ ঘটনায় র‍্যাব-৭ এর কর্মকর্তা এসআই মোঃ শাহাদাত হোসেন বাদী হয়ে উখিয়া থানায় ২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৬(১) এর টেবিল ১০(গ) ধারায় একটি মাদক মামলা দায়ের করেন। যার উখিয়া থানা মামলা নম্বর : ১৩/২০১৯, জিআর মামলা নম্বর : ১৪৪/২০১৯ এবং এসটি মামলা নম্বর : ৪৩৬/২০১৯ ইংরেজি।

মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) উখিয়া থানার এসআই জিয়া উদ্দিন ২০২০ সালের ৩১ আগস্ট আদালতে চার্জশীট (অভিযোগ পত্র) দাখিল করেন এবং চার্জশীটটি ২০১৯ সালের ২১ জানুয়ারি আদালতে গৃহীত হয়। চার্জশীট নম্বর : ১০৫।

চার্জশীটে হাতেনাতে ধৃত আসামী রোহিঙ্গা মোঃ আরীফ প্রকাশ মৌলভী আরীফ-কে প্রাথমিকভাবে দোষী সাব্যস্থ করে তাকে বিচারের আবেদন জানানো হয়। অপরপক্ষে, পলাতক আসামী সাদেক উল্লাহ নামক কোন মানুষের অস্তিত্ব না থাকায় চার্জশীটে তাকে মামলার দায় হতে তাকে বাদ দেওয়ার আবেদন করেন আইও জিয়া উদ্দিন। কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম জানান, মামলাটি বিচারের জন্য ২০২১ সালের ২১ জুন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালত থেকে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে প্রেরণ করা হয়।

বিচার ও রায় :
অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মামলাটির চার্জ (অভিযোগ) গঠন করা হয়। মামলায় ৯ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ, আসামী পক্ষে সাক্ষীদের জেরা, জব্দ করা আলামত প্রদর্শন, রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদন যাচাই ও পর্যালোচনা, যুক্তিতর্ক শেষে বিজ্ঞ বিচারক আবদুল্লাহ আল মামুন ২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৬(১) এর টেবিল ১০ (গ) ধারায় মাদক পাচারের দায়ে আসামী রোহিঙ্গা মোঃ আরীফ প্রকাশ মৌলভী আরীফ-কে দোষী সাব্যস্থ করে মৃত্যুদন্ড এবং ১ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড প্রদান, অর্থদন্ড অনাদায়ে আরো এক বছর বিনাশ্রম কারাদন্ড দিয়েছেন। ২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা বিচারের রায়ে দেশের বিচার বিভাগে এটি প্রথম মৃত্যুদন্ড বলে বিশ্বস্ত সুত্র জানিয়েছে।

রাষ্ট্র পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন এডিশনাল পিপি অ্যাডভোকেট রনজিত দাশ ও অ্যাডভোকেট সুলতানুল আলম।

রায়ে বিচরকের পর্যবেক্ষণ :
বিজ্ঞ বিচারক আবদুল্লাহ আল মামুন রায়ের পর্যবেক্ষন বলেন, এ মামলায় মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামী রোহিঙ্গা মোঃ আরীফ প্রকাশ মৌলভী আরীফ কারাগারে থাকাবস্থায় বাইরে তাকে জামিন করানোর জন্য একটি শক্তিশালী চক্র ছিলো। যারফলে কক্সবাজার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে তার পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ করে অনেকবার জামিন চাওয়া হয়েছে। পরে মহামান্য হাইকোর্ট থেকে বিবিধ ফৌজদারী মিচ মামলা ৫৭৭৬/২০২২ নম্বর মূলে রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জামিন লাভ করেন। হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে উক্ত রোহিঙ্গা ইয়াবাকারবারী চলতি সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী মামলার ৭ জন সাক্ষী নেওয়ার পর অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মহামান্য হাইকোর্টের দেওয়া জামিনের বন্ড সম্পাদন করে কারাগার থেকে বের হয়ে আসামী পলাতক হয়ে যান। যা বিচার ব্যবস্থাকে এড়িয়ে মহামান্য হাইকোর্ট ও অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সাথে প্রতারণা ও অবজ্ঞার সামিল। পরে ২ জন বন্ড প্রদানকারীকে আদালতে তলব করা হলে তারা উক্ত রোহিঙ্গা ইয়াবাকারবারীর কোন জামিনদারদার হননি, জামিননামায় কোন স্বাক্ষর করেননি। এবিষয়ে তারা কিছুই অবহিত নন বলে আদালতকে জানান। অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে সম্পাদন করা জামিননামা ও বন্ড জনৈক আইনজীবী ও ক্লার্কদের সহয়তায় জাল জালিয়াতি করে সম্পাদন করা হয়েছে বলে আদালতে প্রমাণিত হয়।

এ বিষয়ে পলাতক রোহিঙ্গা ইয়াবাকারবারীর নিয়োজিত, জামিননামা সম্পাদনকারী জনৈক আইনজীবী ও আইনজীবী সহকারীদের আদালতে তলব করা হলে আদালতে তারা নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আদালত তাদের শাস্তি নাদিয়ে প্রথমবারের মতো ক্ষমা প্রদর্শন করে পেশাগত দায়িত্ব পালনে আরো সর্তক থাকার নির্দেশ দেন। ভবিষ্যতে ভিন্ন কোন মামলায় উক্ত আইনজীবী ও আইনজীবী সহকারীর কোন অসংগতি দেখা গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আদালত রায়ের পর্যবেক্ষনে উল্লেখ করেন।

রায়ের পর্যবেক্ষনে বিজ্ঞ বিচারক আবদুল্লাহ আল মামুন আরো বলেন, বাংলাদেশে আশ্রিত হয়ে উক্ত রোহিঙ্গা ইয়াবাকারবারী মাদক পাচার করে বাংলাদেশকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছেন। আসামী একজন পূর্ণ বয়স্ক এবং ইসলাম ধর্মের বিধান সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত। তারপরও মাদক পাচারের মতো জগন্য কাজে লিপ্ত হয়েছে উক্ত রোহিঙ্গা ইয়াবাকারবারী।

রায়ে তাকে আমৃত্যু কারাদন্ড দিলে জনগণের অর্থে রাষ্ট্রকে অহেতুক তাকে ৩০ বছর কারাগারে রাখতে হবে এবং একই কারণে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিলেও রাষ্ট্রের অর্থের ক্ষতি হবে। আর মৃত্যুদন্ড দেওয়া হলে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে জগন্য মাদককারবারীর স্থায়ী অপসারণ হবে এবং এটা অন্যন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত হবে। এসব বিবেচনায় রোহিঙ্গা ইয়াবাকারবারীর মোঃ আরীফ প্রকাশ মৌলভী আরীফের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ আদালতে সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে মৃত্যুদন্ড প্রদান ও এক লক্ষ টাকা অর্থদন্ডের রায় ঘোষণা করা হয়।