মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

৭ হাজার ৯৯০ পিচ ইয়াবা টেবলেট পাচারের দায়ে এক রোহিঙ্গাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছে। রায়ে একইসাথে আসামীকে এক লক্ষ টাকা অর্থদন্ড প্রদান, অর্থদন্ড অনাদায়ে আরো এক বছর বিনাশ্রম কারাদন্ড দিয়েছেন।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আবদুল্লাহ আল মামুন গত বৃহস্পতিবার ৯ জুন এ রায় ঘোষনা করেন।

মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত রোহিঙ্গা ইয়াবাকারবারী উখিয়া উপজেলার কুতুপালং ক্যাম্প-২, ব্লক ডি’র মৃত আবদুল মোনাফ ও মৃত নামীয় খাতুনের পুত্র মোঃ আরীফ প্রকাশ মৌলভী আরীফ (২৮)।

যার উখিয়া থানা মামলা নম্বর : ১৩/২০১৯, জিআর মামলা নম্বর : ১৪৪/২০১৯ এবং এসটি মামলা নম্বর : ৪৩৬/২০১৯ ইংরেজি।

রায়ে বিজ্ঞ বিচারকের পর্যবেক্ষণ :

বিজ্ঞ বিচারক আবদুল্লাহ আল মামুন এ মাদক মামলার রায়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পর্যবেক্ষন দিয়ছেন। পর্যবেক্ষনে তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষকে ফাঁকি দিয়ে রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্প থেকে বাইরে এসে এই রোহিঙ্গা ইয়াবাকারবারী চরম অপরাধ করেছেন। আসামী একজন পূর্ণ বয়স্ক, সুস্থ, স্বাভাবিক ব্যক্তি, বিবেচনাবোধ রয়েছে। কম বয়সী বা বুদ্ধিহীন নয়। ইসলাম ধর্মের বিধান সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত। তারপরও মাদক পাচারের মতো জগন্য কাজে লিপ্ত হয়েছে উক্ত রোহিঙ্গা ইয়াবা ইয়াবাকারবারী। বাংলাদেশে আশ্রিত হয়েও উক্ত রোহিঙ্গা ইয়াবাকারবারী মাদক পাচার করে বাংলাদেশকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছেন।

রোহিঙ্গা ইয়াবাকারবারী মোঃ আরীফ প্রকাশ মৌলভী আরীফ ইয়াবা টেবলেট সহ ধৃত হাওয়ার পর মাদকের উৎস প্রকাশ করেনি। সে হয় নিজেই ইয়াবা ব্যবসায়ী, অথবা নিঃসন্দেহে পরিবহনকারী বা ধারণকারী।

রায়ে তাকে আমৃত্যু কারাদন্ড দিলে জনগণের অর্থে রাষ্ট্রকে অহেতুক তাকে ৩০ বছর কারাগারে রাখতে হবে এবং একই কারণে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিলেও রাষ্ট্রের অর্থের ক্ষতি হবে। কারগার থেকে বের হয়ে এই রোহিঙ্গা ইয়াবাকারবারী আবারো একই ধরনের অপরাধে জড়ানোর আশংকা রয়েছে। সেজন্য উক্ত রোহিঙ্গা ইয়াবাকারবারীর জন্য মাদক পাচারের শাস্তি হিসাবে যাবজ্জীবন ও আমৃত্যু কারাদন্ড যুক্তিযুক্ত নয়।

পক্ষান্তরে, তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হলে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে একজন জগন্য মাদককারবারীর স্থায়ী অপসারণ হবে এবং এটা অন্যান্যদের জন্য দৃষ্টান্ত হবে। এসব বিবেচনায় রোহিঙ্গা ইয়াবাকারবারীর মোঃ আরীফ প্রকাশ মৌলভী আরীফের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ আদালতে সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে মৃত্যুদন্ড প্রদান ও এক লক্ষ টাকা অর্থদন্ডের রায় ঘোষণা করা হয়।

মামলার রায়ের পর্যবেক্ষনে বিজ্ঞ বিচারক আবদুল্লাহ আল মামুন আরো বলেন, এ মামলায় মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামী রোহিঙ্গা মোঃ আরীফ প্রকাশ মৌলভী আরীফ কারাগারে থাকাবস্থায় বাইরে তাকে জামিন করানোর জন্য একটি শক্তিশালী চক্র আগে থেকেই সক্রিয় ছিলো। যারফলে, কক্সবাজার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে তার পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ করে অনেকবার জামিন চাওয়া হয়েছে। পরে মহামান্য হাইকোর্ট থেকে বিবিধ ফৌজদারী মিচ মামলা ৫৭৭৬/২০২২ নম্বর মূলে রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আসামী জামিন লাভ করেন। হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে উক্ত রোহিঙ্গা ইয়াবাকারবারী এ মামলায় ৭ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়ার পর অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মহামান্য হাইকোর্টের দেওয়া জামিনের নির্দেশনা মতো বন্ড দিয়ে জামিননামা সম্পাদন করে চলতি সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী কারাগার থেকে বের হয়ে যায়। পরে এ আসামী পলাতক হয়ে যান।

এ অবস্থায় বন্ড দিয়ে জামিননামা সম্পাদন করা ২ জন জামিনদারের বন্ড বাজেয়াপ্ত করতে তাদের আদালতে তলব করা হলে তারা উক্ত রোহিঙ্গা ইয়াবাকারবারীর জন্য আদৌ কোন জামিনদারদার হননি, জামিননামায় কোন স্বাক্ষর করেননি। এবিষয়ে তারা কিছুই অবহিত নন বলে আদালতকে জানান। অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে সম্পাদন করা জামিননামা ও বন্ড কক্সবাজারের জনৈক আইনজীবী ও ক্লার্কদের সহয়তায় অভিযুক্ত ও তার চক্র জাল জালিয়াতি করে দাখিল করেছে বলে আদালতে প্রমাণিত হয়। জাল, ভুঁয়া ও বানোয়াট জামিননামা আদালতে দাখিল করে মহামান্য হাইকোর্টের আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছেন বলে বিজ্ঞ বিচারক তাঁর পর্যবেক্ষনে উল্লেখ করেন।

এ বিষয়ে পলাতক রোহিঙ্গা ইয়াবাকারবারীর জামিননামা সম্পাদনের জন্য কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে নিয়োজিত, জামিননামা সম্পাদনকারী জনৈক আইনজীবী ও আইনজীবী সহকারী (ক্লার্ক) কে আদালতে তলব করা হলে আদালতে তারা নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আদালত তাদের শাস্তি নাদিয়ে প্রথমবারের মতো ক্ষমা প্রদর্শন করে পেশাগত দায়িত্ব পালনে আরো অধিকতর সর্তক থাকার নির্দেশ দেন। ভবিষ্যতে ভিন্ন কোন মামলায় উক্ত আইনজীবী ও আইনজীবী সহকারীর কোন অসংগতি দেখা গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে বিজ্ঞ বিচারক আবদুল্লাহ আল মামুন তাঁর রায়ের পর্যবক্ষনে উল্লেখ করেন।

রায়ের পর্যবেক্ষনে বিজ্ঞ বিচারক আবদুল্লাহ আল মামুন আরো বলেন, উক্ত রোহিঙ্গা ইয়াবাকারবারী হাইকোর্ট থেকে জামিন পেতে আইনজীবী নিয়োগ করেছেন। কিন্তু মামলার বিচার শুরু হলে সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে আদালতে তার পক্ষে কোন আইনজীবী আদালতে ছিলেন না। মামলাটি সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান সম্বলিত আইনের মামলা হওয়ায় রাষ্ট্রীয় খরচে তার জন্য আইনজীবী নিয়োগ দিতে হয়েছে। এতেই প্রমাণিত হয়েছে এই রোহিঙ্গা ইয়াবাকারবারীর শুধুমাত্র জামিন নিয়ে আগ্রহ ছিল। বিচার নিয়ে কোন আগ্রহ ছিলো না। বিচারকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছে। যা মহামান্য হাইকোর্ট ও কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সাথে প্রতারণার শামিল বলে পর্যবেক্ষনে উল্লেখ করা হয়।

মাদক আইনে দেশে প্রথম মৃত্যুদন্ড :

২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা বিচারের রায়ে দেশের বিচার বিভাগে এটি প্রথম মৃত্যুদন্ড বলে বিশ্বস্ত সুত্র জানিয়েছে। সুত্রমতে, এর আগে একই আইনের বিচারে দেশের কোথাও কোন আসামীকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়নি।

রায় নিয়ে বিভিন্ন মহলের অভিমত :

এ রায় ঘোষণা সম্পর্কে কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেন-সরকার মাদকের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছে। একই নীতিতে বিচার বিভাগ আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছে। এ মামলার রায়ে দেশের শত্রু মাদককারবারীদের জন্য সুস্পষ্ট একটা ম্যাসেজ রয়েছে।

রাষ্ট্র পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী কক্সবাজার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের এডিশনাল পিপি অ্যাডভোকেট রনজিত দাশ বলেন-এ মামলায় রাষ্ট্র পক্ষ ন্যুনতম সময়ের মধ্যে সকল সাক্ষী, আলামত ও অন্যান্য এভিডেন্স যথাযথভাবে উপস্থাপন করেছে। রাষ্ট্র পক্ষ আদালতে মামলাটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে বিজ্ঞ বিচারক মামলাটির যথার্থ রায় প্রদান ও গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন।

কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জিয়া উদ্দিন আহমদ বলেন, এ মামলার রায় ও পর্যবেক্ষণে দেশপ্রেম ও দূরদর্শিতা ফুটে উঠেছে এবং রাষ্ট্রের নীতির আইনানুগ প্রতিফলন ঘটেছে। এ রায় সমাজ ও রাষ্ট্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে অ্যাডভোকেট জিয়া উদ্দিন আহমদ মন্তব্য করেন।

‘আমরা কক্সবাজারবাসী’ নামক সংগঠনের সভাপতি, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কক্সবাজার জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মোহাম্মদ আলী বলেন, রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের মধ্যে আরো নিয়ন্ত্রণে না আনলে কক্সবাজারে মাদক, খুন, অস্ত্র সহ অন্যান্য জগন্য অপরাধ আরো বৃদ্ধি পাবে। আইনশৃংখলা পরিস্থিতির আরো অবনতি হওয়ার আশংকা রয়েছে। রোহিঙ্গারা কক্সবাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলবে। তাঁর মতে, গত বৃহস্পতিবার কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ঘোষিত মামলার রায়ে সংশ্লিষ্ট সবার কাছে একটা ম্যাসেজ যাবে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কক্সবাজার জেলার সাধারণ সম্পাদক ও কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি সাংবাদিক মাহবুবুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গাদের হারানোর কোন ভয় নেই। এজন্য তারা সহজে অপরাধ কর্মে জড়িয়ে পড়ে। তাঁর মতে, রোহিঙ্গারা শুধু কক্সবাজারের জন্য নয়, পুরো দেশের জন্য ক্ষতিকর। তাই সময় থাকতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করতে হবে। গত বৃহস্পতিবার কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রায় প্রদান করা মাদক মামলা সম্পর্কে সাংবাদিক মাহবুবুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গাদের সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করার পাশাপাশি আইনী পদক্ষেপগুলো সমাজে নিঃসন্দেহে সুফল বয়ে আনবে।