মর্জিয়া বেগম
শিশু মন একটি অলিখিত সাদা কাগজ। শিশুদের শিখন ক্ষমতা যাচাই করেই শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়। তাদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে কখনও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার সুফল আশা করা যাবে না।
পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমে সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি ২ দিন কার্যকর করা হয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বার্ষিক ছুটি কিছুদিন কমেও যেতে পারে। যা পূর্বের ও বর্তমানের ছুটির তালিকা তুলনা করলেই বুঝা যায়। পূর্বে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকসহ মাদ্রাসার বার্ষিক ছুটির সমন্বয় ছিল ৮৫ দিন। যা বর্তমানে মাধ্যমিক,উচ্চ মাধ্যমিকে ৭৬ দিন ছুটি নির্ধারণ করেছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। যেখানে অতীতের সমন্বিত ছুটির রেকর্ড ভেঙে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ছুটি একলাফে ২২ দিন কমিয়ে মাত্র ৫৪ দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। তার মধ্যে প্রধানশিক্ষকের হাতে নামেমাত্র ৩ দিন সংরক্ষিত ছুটি রেখেছেন। অথচ মুক্তপাঠে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম রুপরেখা -২০২১ বাস্তবায়নের ছুটি বিধিতে ৭৬ দিন উল্লেখ আছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর মাধ্যমিকের সমান ছুটির রেওয়াজ ভুলে গিয়ে প্রাথমিক শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকের মাঝে বিশাল এক ছুটি বৈষম্যের দেয়াল সৃষ্টি করেছেন। যা কখনও কাম্য নয়।একই পরিবারে মাধ্যমিক ও প্রাথমিক পড়ুয়া শিশু থাকলে সহজেই অনুমেয় ও উপলব্ধি করতে পারবে বৈষম্য।
প্রাথমিকের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ সাধনের কথা চিন্তা করে যেখানে বেশি ছুটি প্রয়োজন সেখানে কম ছুটি নির্ধারণ করে কী এমন সুফল বয়ে আনতে চান বুঝতে পারছি না!
রমজান মাস সিয়াম সাধনার মাস। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের রমজানের কষ্ট ও ইবাদতের কথা বিবেচনায় এনে রমজান মাস ছুটি ঘোষণা করে এসেছেন দীর্ঘ এক দশক ধরে। তাঁর জন্য তিনি ভূয়সী প্রশংসিতও হয়েছেন।
২০২৩ সালে এসে ছুটির তালিকায় মাধ্যমিক,উচ্চমাধ্যমিক ও মাদ্রাসাসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী,শিক্ষকরা পবিত্র রমজান মাসের শুরু থেকে সম্পূর্ণ মাস ব্যাপী ছুটি ভোগ করতে পারার বিধান থাকলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা মার্চের ২৩ তারিখ থেকে এপ্রিলের ৭ তারিখ পর্যন্ত রোযা রেখে এই তীব্র গরম উপেক্ষা করে শ্রেণি কার্যক্রম চালিয়ে নিবেন। যা উপলব্ধিতে অভিভাবক ও কচিকাঁচা শিশুদের মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে ।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিশু রোযা রাখেন। রমজান মাসে সহীহ শুদ্ধ করে কোরআন শিখেন। এই সিয়াম সাধনার মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বাদ দিয়ে কোমলমতি শিশুদের শিখন শেখানো কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
পরিবারের বড় সন্তান রোযা রেখে যখন বিশ্রাম নেবেন তখন একই পরিবারের ছোট সন্তান রোযা রেখে বই খাতা ব্যাগ নিয়ে স্কুলে দৌঁড়াবেন। যা খুবই অমানবিক ও অপমানজনক।
এই রমজানে সবচেয়ে বেশি বিড়ম্বনার শিকার হবেন মহিলা শিক্ষকরা। তাঁরা সারাদিন রোযা রেখে,নামাজ পড়ে,কোরআন পড়ে,স্বামী সংসার সামলিয়ে বিকালের ইফতার রেডি করার মতো গুরু দায়িত্ব পালনে হিমশিম খেতে হবে। ইফতারের পর তারাবীহ নামাজ আদায় করতে না করতে আবার মধ্যরাতের সেহেরি রেডি করতে হবে প্রাথমিকের একজন নারী শিক্ষককে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একজন মমতাময়ী মা হয়ে এ কষ্ট উপলব্ধি করেই রমজান মাস ছুটি ঘোষণা করেই এসেছিলেন এতোদিন যাবৎ। যা ২০২৩ সালে এসে প্রাথমিক ডিপার্টমেন্টে বিধি বাম হয়ে দাঁড়াল।
এবছরের বার্ষিক ছুটিতে ছুটি বৈষম্যে শুধু রমজান মাস নয়,এছাড়াও সকল প্রকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যখন ১২ দিন শীতকালীন অবকাশ যাপন করবেন, সেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা নামে মাত্র ৩ দিন শীতকালীন অবকাশ যাপনের প্রহসনে ডুব দেবেন। যা খুবই হাস্যকর।
এছাড়াও প্রাথমিক শিক্ষকরা ভ্যাকেশনাল ডিপার্টমেন্টের কর্মচারী। ভ্যাকেশনাল ডিপার্টমেন্টের কর্মচারী হওয়ার কারণে তারা শ্রান্তি বিনোদন,অর্জিত ছুটিসহ বিভিন্নক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন।তাই তাদেরও মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষকদের মতো ভ্যাকেশনাল ছুটি ভোগ করার অধিকার রয়েছে। বিনা কারণে ভ্যাকেশনাল ছুটি কমিয়ে প্রাথমিক শিক্ষকদের সামাজিক ও মানসিকভাবে হেয় করা উচিত নয়।
প্রাথমিক শিক্ষকদের মানসিকভাবে অসন্তুষ্ট রেখে কখনো মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করা সম্ভব নয়। কর্তৃপক্ষের কাছে বিনীত অনুরোধ, বাস্তবতা অনুধাবন করে প্রাথমিক শিক্ষার্থী,শিক্ষক ও অভিভাবকদের কল্যাণের স্বার্থে; মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের সাথে সমন্বয় করে ২০২৩ সালের প্রাথমিকের বার্ষিক ছুটির তালিকা সংশোধন করে বার্ষিক ৭৬ দিন ছুটি নির্ধারণ করা হোক।
লেখক: সহকারী শিক্ষক, খুনিয়াপালং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রামু,কক্সবাজার।