বার্তা পরিবেশক:

দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনকে বাঁচাতে পর্যটক নিয়ন্ত্রণ ও রাত্রিযাপন নিষিদ্ধের দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর নিকট স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদ  স্মারকলিপি প্রদান করেছেন। ২৯ নভেম্বর কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো: মামুনুর রশীদ এর মাধ্যমে  স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। এসময় তিনি বলেন, সরকারও চাইছেন সেন্টমার্টিনের পরিবেশ  সুরক্ষা থাকুক। প্রকৃতি পরিবেশ সুরক্ষা থাকলেইতো সেন্টমার্টিনের গুরুত্ব বাড়বে পর্যটকদের কাছে। আর দ্বীপের প্রকৃতি পরিবেশ না থাকলে পর্যটকও আসবেনা।  এই স্মারকলিপির মাধ্যমে বিষয়টি আরো জোরালো হয়েছে যে, সেন্টমার্টিন দ্বীপের পরিবেশ যেমন সুরক্ষা হবে তেমনি পর্যটন শিল্পও রক্ষা হবে। 

কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের দেয়া স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, কক্সবাজারে এখন প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসে লিপ্ত রয়েছে কিছু স্বাথার্ন্বেষী লোভী ব্যবসায়ী। পা্রকৃতিক নৈ:স্বর্গিক সৌন্দর্য্যের লীলা ভুমি দেশের একমাত্র  প্রবালদ্বীপ ধ্বংস যজ্ঞে নেমেছে। তারা সোনার ডিমপাড়া হাঁস সেন্টমার্টিনকে একবারে কেটে খেয়ে ফেলতে চায়।

বাংলাদেশের দক্ষিনে বঙ্গোপসাগরের বুকে  জেগে উঠা অতি ক্ষুদ্র  দ্বীপ সেন্টমার্টিন। এর আয়তন মাত্র ৩ বর্গ মাইল , যা কিলোমিটারে  ৭.৮ বর্গ কিলোমিটার।  এখানে বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১২  হাজার। রয়েছে দুই শতাধিক টি আবাসিক হোটেল। ( অধিকাংশ বহুতল ভবন) । কোনটির অনুমোদন নেই।  স্কুল-হাসপাতাল সহ অনেক সরকারি বেসরকারি ভবন রয়েছে। এই দ্বীপের ধরন হচ্ছে সমুদ্রে ভাসমান নৌকা। মাত্র ৩  বর্গ মাইলের এই নৌকাতুল্য সেন্টমার্টিন দ্বীপে ১২ হাজার মানুষ, দুই শতাধিক আবাসিক হোটেল, সরকারি ভবনসহ ৩০০০ বসতবাড়ির চাপ সহ্য  করতে পারবে কিনা??? 

এরমধ্যে প্রতিবছর  পর্যটন মৌসুমের অন্তত ছয় মাস ১০  হাজারের বেশি পর্যটক রাত্রিযাপন করেন। যার কারণে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এ দ্বীপটির জীববৈচিতত্র্য  ধ্বংস হয়ে গেছে।  দুর্গন্ধে পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় সেন্টমার্টিন রক্ষায়  কক্সবাজার  বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের  দাবী হচ্ছে,  (১) ৩ বছর পর্যটন যাতায়ত বন্ধ করে মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন ও নীতিমালা প্রনয়ন, তা যদি সম্ভব না হয় তাহলে (২) নিবন্ধনের মাধ্যম প্রতিদিন ৬শ পর্যটক যাওয়ার অনুমতি (৩)  পর্যটদের রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ করা। 

দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের অবস্থা অত্যন্ত শংকটাপন্ন। নানাভাবে অত্যাচারের কারনে পরিবেশ প্রতিবেশ ধ্বংস হয়েছে। হুমকির মুখে পড়েছে কোরালসহ জীববৈচিত্র্য। ফলে মুর্মুষু হয়ে পড়েছে সেন্টমার্টিন। 

প্রতিদিন ১০ হাজার পর্যটক আর স্থানীয় ১২ হাজার মানুষের চাপে সেন্টমার্টিনদ্বীপ নুয়ে পড়েছে। ২২ হাজার মানুষের মলমুত্র, ময়লা আবর্জনায় দুষিত হয়ে উঠেছে  প্রবাল দ্বীপ। দুই শতাধিক ইট কংক্রিটের হোটেল, বহুতল ভবনের জন্য নেই পয়:নিস্কাসন ব্যবস্থা, বৈদ্যতিক পাম্প দিয়ে প্রতিনিয়ত  সেন্টমার্টিন স্তরের মিষ্টি পানি উত্তোলন, শৈবাল, প্রবাল,  কচ্ছপ, লাল কাকড়া,শামুক ঝিনুকসহ নানা জলজ প্রানি নিধন, খোলা পায়খানা ও নাানা পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকান্ডের কারনে এখন এই দ্বীপের আগের প্রকৃতির রুপ নেই। দুর্গন্ধে ভারি হয়ে উঠছে পরিবেশ। বলতে গেলে  এই প্রবাল দ্বীপটি  মৃতপ্রায়।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দ্বীপের জীববৈচিত্র রক্ষায় ১৯৯৯ সালে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে সরকার। স্বচ্ছ পানি ও চারপাশ জুড়ে প্রবাল পাথর বেষ্টিত মনোলোভা পুরো দ্বীপটিই যেন নৈস্বর্গিক। বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থিত এ দ্বীপ। দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন সামুদ্রিক কাছিমের প্রজনন ক্ষেত্রও। সেন্টমার্টিনে ৬৮ প্রজাতির প্রবাল, ১৫১ প্রজাতির শৈবাল, ১৯১ প্রজাতির মোলাস্ক বা কড়ি-জাতীয় প্রাণী, ৪০ প্রজাতির কাঁকড়া, ২৩৪ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৫ প্রজাতির ডলফিন, ৪ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ২৮ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী, ১২০ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১৭৫ প্রজাতির উদ্ভিদ, ২ প্রজাতির বাদুড় সহ নানা প্রজাতির বসবাস ছিল। এসব প্রাণীর অনেকটাই এখন বিলুপ্তির পথে। জলবায়ু পরিবর্তনের কঠিন সময়ে মানবসৃষ্ট দূষণের কারণে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে নানা প্রাণী।

পর্যটনকে পুঁজি করে পরিবেশ সংকটাপন্ন দ্বীপটিতে বৃদ্ধি পেয়েছে জন সমাগম। তাই অতিরিক্ত পর্যটক এ দ্বীপের ভারসাম্যের জন্য হুমকি এবং জীববৈচিত্র ধ্বংস করছে বলে পরিবেশ সমীক্ষায় উঠে এসেছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের পাশে আরেকটা দ্বীপ ছেঁড়া দ্বীপ। দ্বীপের চারদিকে রয়েছে প্রবাল, পাথর, ঝিুনক, শামুকের খোলস, চুনা পাথর সহ প্রায় কয়েক শত প্রজাতির সামুদ্রিক জীব। জনশূন্য ছেঁড়া দ্বীপের অপরূপ দৃশ্য দেখতে কাঠের অথবা স্পীড বোটে ছুটে যাচ্ছে পর্যটকরা। এতে দিন দিন এ দ্বীপের জীববৈচিত্র, পরিবেশ প্রকৃতি মারাত্বভাবে হুমকির মুখে পড়েছে। 

সেন্টমার্টিন দ্বীপ পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা এবং সংবেদনশীল। এখানে যদি কোন রকম পরিবেশগত বা যে কোন কারনে বিপর্যয় হয় তাহলে এটি পুনরুদ্ধার করা কঠিন কাজ হবে। দ্বীপটিকে রক্ষা করার জন্য প্রাকৃতিক যে অবয়ব ছিল এগুলি যদি ব্যাহত হয় তাহলে দ্বীপের বিপর্যয় হবেই। দ্বীপের বিভিন্ন উদ্ভিদরাজী সহ বহু প্রাণী ইতিমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। সামুদ্রিক কাছিম সহ বিভিন্ন প্রাণী সেন্টমার্টিন ও ছেড়া দ্বীপে ডিম পাড়তে আসতো। জরিপ করে দেখা গেছে এর সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে গেছে। অতিরিক্ত মানুষ সমাগম এবং রাত্রে বাতি জ্বালানো, ডিম পাড়া সহ বিচরনের পরিবেশ না থাকায়  এসব কচ্ছপের  দ্বীপে আসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এজন্য এখই যদি পদক্ষেপ নেয়া না হয় তাহলে বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব হবেনা। 

সেন্টমার্টিনে পর্যটক আগমন বৃদ্ধি পাওয়াকে পুজিঁ করে গত দুই দশকে এ দ্বীপে বহু হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট গড়ে উঠেছে অবৈধভাবে। গড়ে তুলেছে অনেক বহুতল ইমারত। এসবের একটিতেও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র বা অনুমতি নেই। এসব স্থাপনা করতে গিয়ে পাথর উত্তোলনের পাশাপাশি সমুদ্র সৈকতের বালি আহরণ করা হয়েছে। এ দ্বীপে আগে তাল গাছ সহ অনেক উচু গাছপালা ও কেয়াবন ছিল, তাও কেটে স্থাপনা নির্মান করা হয়েছে। জিও টেক্সটাইল দিয়ে সীমানা প্রাচীর নির্মান করা হয়েছে। ব্যবসায়ীকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য এসব ব্যবসায়ীরা দ্বীপের প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট করছে । 

সেন্টমার্টিন দ্বীপের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্থর খুবই পাতলা। এখানে অতিরিক্ত পর্যটক আগমনের কারনে পর্যটন মৌসুমে অতি মাত্রায় সুপেয় পানি উত্তোল করা হয়। যার দরুন দ্বীপের নলকূপে লবণাক্ত পানি দেখা দিয়েছে। এতে সেন্টমার্টিনের স্থানীয় বাসিন্ধাদের জীবনযাপনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। 

দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের অবস্থা অত্যন্ত শংকটাপন্ন। নানাভাবে অত্যাচারের কারনে পরিবেশ প্রতিবেশ ধ্বংস হয়েছে।  মুর্মুষু হয়ে পড়েছে সেন্টমার্টিন। এখনি রক্ষা করা না গেলে এই দ্বীপটি সাগরেই বিলীন হয়ে যাবে। এই জন্য প্রয়োজন সেন্টমাটিনকে চাপ ও ভারমুক্ত করা। আর এই জন্য পর্যটন যাতায়ন নিয়ন্ত্রন করতে হবে।  তাই  প্রবালদ্বীপটি বাঁচাতে  আমাদের দাবি হচ্ছে পর্যটক নিয়ন্ত্রণ ও স্থানীয়দের উন্নয়নে প্রকল্প গ্রহণ। (১) ৩ বছর পর্যটন যাতায়ত বন্ধ করে মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন ও নীতিমালা প্রনয়ন, (২) আর এই সময় জীবনধারনের জন্য প্রয়োজনীয় বিকল্প জীবন ধারনে সহায়তা করা (বিশেষ করে যারা পর্যটন শিল্পের উপর নির্ভরশীল)।   যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে (৩) নিবন্ধনের মাধ্যম প্রতিদিন ৬শ পর্যটক যাওয়ার অনুমতি (৪) পর্যটদের রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ করা। আপনার সহযোগিতায় দেশের মৃতপ্রায় একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন বাঁচবে,  পরিবেশ প্রকৃতি আর জীববৈচিত্র্য সুরক্ষার মাধ্যমে  ইকোট্যুরিজম প্রতিষ্ঠিত হবে, আর এতে পর্যটন শিল্প আরো বেশি প্রসারিত হবে। 

স্মারকলিপি প্রদানকালে উপস্থিত ছিলেন, কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি সাংবাদিক দীপক শর্মা দীপু, সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক মোহাম্মদ জুনাইদ, কর্মকর্তা ডা: চন্দন কান্তি দাশ, যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক রায়হান উদ্দিন চৌধুরী, কামাল উদ্দিন, রাজীব দেবদাশ।