দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। দেশি-বিদেশি ভ্রমণপিয়াসী মানুষের কাছে পছন্দের প্রবাল দ্বীপটি। কিন্তু সেন্টমার্টিনে অতিরিক্ত পর্যটক যাওয়ার ফলে দূষণের কবলে পড়েছে দ্বীপটি। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দ্বীপের চারপাশের প্রবাল। এখন দ্বীপটিকে বাঁচাতে হলে সেন্টমার্টিনে কোনও পর্যটক রাতযাপন করতে পারবে না। হোটেল-মোটেলও থাকতে পারবে না। স্থানীয়দেরও সেন্টমার্টিন থেকে সরাতে হবে।

বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ড. তৌহিদা রশীদ সেন্টমার্টিনকে বাঁচাতে এমন কথাই বলেছেন। বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট (বোরি) আয়োজিত আন্তর্জাতিক সমুদ্র বিষয়ক গবেষণা সম্মেলনের তার এমন অভিমত ব্যক্ত করেন।

বোরির মহাপরিচালক ড. তৌহিদা রশীদ বলেছেন, এসিডিটি এবং দূষণ প্রক্রিয়ার ফলে সেন্টমার্টিনের প্রবাল খসে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পানি যখন স্বচ্ছ এবং পরিমাণ কম থাকে তখন সূর্যের আলো সরাসরি প্রবালে গিয়ে পড়ে। এর ফলে প্রবালের গঠনটা হয়। কিন্তু সেন্টমার্টিনে দেখা যাচ্ছে অতিরিক্ত দূষণ, এসিডিটির পরিমাণ এতো বেশি বেড়ে গেছে প্রবালের গঠন সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া প্রবাল দিন দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। প্রবালের মূল উপাদান হচ্ছে ক্যালসিয়াম কার্বোনেট। পিএইচ কতটুকু হলে প্রবালের স্বাস্থ্য ভালো থাকে এমন একটা বিষয় আছে। যখন পিএইচ কমে যাচ্ছে তখন এসিডিফিকেশন (মহাসাগরের অম্লতা বৃদ্ধি) প্রক্রিয়ার দিকে যাচ্ছে। ফলে প্রবালের স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যায় এবং ভেঙে যায়। এটাই সেখানে হচ্ছে।

সেন্টমার্টিনকে বাঁচাতে হলে দুটি পরামর্শ দিয়ে সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের এই মহাপরিচালক বলেন, সেন্টমার্টিনকে রক্ষা করতে প্রথমত দূষণ একেবারেই বন্ধ করতে। দ্বিতীয়ত দ্বীপটিতে পর্যটকরা যাবে কিন্তু রাত্রিযাপন করতে পারবে না। একদমই থাকা যাবে না। বিরক্ত একেবারেই করা যাবে না। পর্যটকরা যাবে এবং চলে আসবে। সেখানে কোন হোটেল-মোটেল রাখা যাবে না। যেহেতু সেন্টমার্টিনকে মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া (সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা) ঘোষণা করেছে সরকার সেহেতু এখানে থাকা-খাওয়ার কোন ব্যবস্থা করা যাবে না। এমনকি যারা ওখানে বসবাস করছে স্থানীয় মানুষ সরকারের উচিত তাদেরকেও অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা। কারণ সেখানে কোন মানব বসতির সুযোগ থাকবে না। যেহেতু বিরল একটি দ্বীপ শুধুমাত্র দেশি-বিদেশি পর্যটকরা ঘুরতে যাবে এবং ঘুরে চলে আসবে। এরকম যদি করা যায় তাহলে প্রবাল ধ্বংস বন্ধ হবে।

এদিকে তার বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছেন পরিবেশবাদীরা। সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালকের বক্তব্য বাস্তবায়ন করলেই সেন্টমার্টিনকে বাঁচানো যাবে বলে মনে করছেন তারা।

পর্যটকদের যাতায়াত, যত্রতত্র প্লাস্টিকের বর্জ্য ফেলা, অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ, পর্যটকদের অসচেতনতা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের কারণে সেন্ট মার্টিনের জীব-বৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পরিবেশ অধিদফরের মতে, পরিবেশ দূষণের কারণে দ্বীপটির প্রবাল, শৈবাল, সামুদ্রিক কাছিম, লাল কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুকসহ নানা জলজ প্রাণী এবং জীব-বৈচিত্র্যও এখন বিলুপ্ত হবার পথে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি করিম উল্লাহ কলিম বার্তা২৪.কম-কে বলেন, তাঁর পরামর্শকে আমরা স্বাগত জানাই। এখন যেভাবে অবাধে পর্যটক যাচ্ছে সেটি চলতে থাকলে অচীরেই ধ্বংস হয়ে যাবে প্রবাল দ্বীপ। প্রবালের উপর ভর করেই দ্বীপটি টিকে আছে। প্রবালই না থাকলে দ্বীপ কেমনে থাকবে!

তবে বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)’র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বার্তা২৪.কম-কে বলেন, আজকে উনি যে কথাটি বলেছেন সেটি কাঙ্গালের কথা বাসি হলে ফলে এরকম অবস্থা। আমরা বিগত ২০/২৫ বছর ধরে একথাগুলো বলে যাচ্ছি। কথাগুলো দেশের আইনেও আছে আদালতও বারবার একই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কিন্তু পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অনড় অবস্থানের কারণে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি দিনদিন অবনতি হয়েছে। যদি আমরা সেন্টমার্টিনের পর্যটন শিল্পকে বাঁচাতে চাই তাহলেতো প্রথমে সেন্টমার্টিনকে বাঁচাতে হবে। আমরা স্বর্ণের ডিম পাড়া হাঁসের মতো প্রথমে হাঁসটাকে মেরে ফেলছি তারপর আাশা করছি আরও বেশি ডিম পাবো। সেটাতো হতে পারে না।

বেলার প্রধান নির্বাহী বলেন, আইন, আদালত এবং পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের যে অবস্থান আছে, পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উচিত সেটাকেই মেনে নেওয়া। আইন, আদালত আর জনস্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে পর্যটনকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের উচিত সেন্টমার্টিনে যেসব হোটেল-মোটেল আছে তার বেশিরভাগ ভেঙে দেওয়া। আগে সেন্টমার্টিনকে বাঁচাতে হবে পরে পর্যটনের কথা ভাবা যাবে। রাত্রিযাপ নতো একেবারেই নিষিদ্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে ধীরে ধীরে পুনর্বাসন করতে হবে।